পিতৃস্নেহ ও একটি বাইক

মোহীত উল আলম »

গত ১৩ মার্চ ইত্তেফাকের শেষের পৃষ্ঠায় একটা মর্মান্তিক খবর পড়লাম। রাজবাড়ীর ছেলে রাজন শেখ, বয়স ১৬, দশম শ্রেণির ছাত্র, বাবার কাছে একটি বাইক দাবি করেছিল। বাবা রাজি না হওয়াতে সে গলায় ফাঁস নেয়। উদ্ধার করে তাকে হাসপাতাল থেকে সুস্থ করিয়ে আনার পর বাবার মন নরম হয়ে যায় একমাত্র ছেলের জন্য। তিনি আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ছেলেকে একটা বাইক কিনে দেন। আত্মহত্যা চেষ্টার তিনদিন পরে সড়কপথে রাজন ঐ নতুন বাইকেই এক বন্ধু সহকারে বিদ্যুতের খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়ে মুহূর্তেই পরপারে চলে যায়।
এই ঘটনাটি জনমনে নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ১৬ বছরের ছেলের হাতে বাবা বাইক তুলে দিলেন কেন? কিন্তু ছেলে যদি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় বাবার তখন উপায় কী থাকে? বাবা যদিও হয়ত ভাবতে পারেন যে ছেলে তাঁকে ইমোশনাল ব্ল‍্যাকমেইল করছে, কিন্তু সেটা করে থাকলেও ছেলে যদি ফাঁস নেবার মতো সাহস করে ফেলে তখন সেটা আর ইমোশনাল ব্ল‍্যাকমেইলের পর্যায়ে থাকে না। আর বাইক দিলেই যে ছেলে দুর্ঘটনা করে ফেলবে সেটাতো নাও হতে পারতো!
আরও দুটো প্রশ্ন উঠে আসছে। ছেলে ১৬ বছর বয়সে বাইকের আবদার করতে পারছে, তার একটা অর্থ হলো বাবার একমাত্র ছেলে হওয়ায় সে সম্ভবত ছোট বেলা থেকে এই ধরনের আবদারের প্রশ্রয়ে বড় হচ্ছিল। সে-ই ছোটবেলার প্রশ্রয়গুলো খেলনা গাড়ি থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ওর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে খেলনা গাড়ি থেকে সাইকেল, সাইকেল থেকে মোবাইল, মোবাইল থেকে বাইকে অগ্রসরমান হয়েছে। আর বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজ আগের চেয়ে অর্থবান হওয়াতে এবং ভোগবাদী মানসিকতা তৈরি হওয়াতে, আর সাথে সাথে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পাকা রাস্তা যথেষ্ট পরিমানে তৈরি হয়ে গেছে বলে, বাইকে চলাচল অত্যধিক হারে বেড়ে গেছে, এবং রাজনের মতো ইয়াং ছেলেরাই বাইক নিয়ে মহোৎসবে নেমেছে। রাজনৈতিক মিছিলের শোডাউনের সময় বাইকের সমাবেশ দারুণ দৃশ্য তৈরি করে। যা হোক, রাজন দুর্ঘটনা করেছে বলে ওরটা জানা গেছে, কিন্তু বাইক দুর্ঘটনাটা হরহামেশাই হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, রাজনের আবদারটা সেই মাইমেটিক ডিজায়ার (বা অনুকরণশীল ইচ্ছা) থেকেও তৈরি হতে পারে। ওর আছে আমার থাকবে
না কেন? তৃতীয়ত, রাজনের চরিত্রে যে অস্বাভাবিক আবেগী ব্যবহারের প্রকাশ পায় (কেন না, সব এক-মাত্র-পুত্র রাজনের মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না), তাতে এটাও ভাবার কারণ থাকে যে সে হয়ত মানসিকভাবে সুস্থ ছেলে ছিল না, অথবা তার সম্ভবত বাবার ওপর অভিমান পুরোপুরি অবসিত হয় নি, এবং সে জন্য সে এত জোরে (১০৫ কিমি পার আওয়ার, মতান্তরে ১৫০) বাইক চালিয়ে নিজের জীবনতো সাঙ্গ করলোই, সাথে নিয়ে গেল বন্ধুর প্রাণ। বাপের ওপর প্রতিশোধ। অথবা হয়ত বাইক চালানো ভালোভাবে রপ্ত করার আগেই সে মহাসড়কে বাইক ছুটিয়েছিল। আমরা শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিছু করতে
পারি না।