পথ দেখানো মানুষ

রুশো মাহমুদ »

সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা পথ নির্দেশ করেন। আশার কথা বলেন, চলার পথে আলো ফেলেন। প্রতিকূলতা ঠেলে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস দেন। শেকড়ের সাথে বাস করেন। অদম্যের মন্ত্র যাঁর জানা আছে। সমাজটা এখনো বাসযোগ্য এরকম কিছু মানুষ আছেন বলে। সব অর্থে এরা এক একজন নায়ক। আমাদের সময়ের নায়ক।
স্বাধীনতার পর প্রিয় শহর চট্টগ্রামের নানা বাঁক বদল হয়েছে। সেটা হয়েছে রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সংবাদপত্রসহ নানা ক্ষেত্রে। নাগরিক সমাজ বিকাশের এই রূপান্তরে কয়েকজন ‘নায়ক’ কাজ করেছেন, কখনো নেপথ্যে বা কখনো প্রকাশ্যে। আবুল মোমেন তাঁদের একজন।
একজন আধুনিক মানুষ বলতে যা বোঝায় আবুল মোমেন তার পুরোটাই। কারো কাছে ‘স্যার’। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠের ‘মোমেন ভাই’। এ কথা আমরা হয়ত সবাই জানি না। রাজনীতির সক্রিয় মানুষ না হয়েও স্বৈরাচার ও সামরিক জান্তাবিরোধী আন্দোলনে তার খসড়ায় তৈরি করা লিফলেট আমাদের উদ্দীপ্ত করেছে। প্রকৃত অর্থেই তিনি একজন সব্যসাচী।
ফুলকির শুরুর দিককার ছোট বাঁশবেড়ার ঘরে নিয়মিত বসতো পাঠচক্র- ‘অচিরা’। যার মধ্যমণি ছিলেন আবুল মোমেন। এই পাঠচক্র থেকে এক ঝাঁক তরুণ সাহিত্যপ্রেমী বেরিয়ে এসেছেন। চট্টগ্রামসহ দেশের শিল্প সাহিত্য অঙ্গনে এখন তাঁদের পাকা অবস্থান।
পচাত্তরে পট পরিবর্তনের পর আমাদের যখন বাঙালিত্ব ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছিল তখন ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখ আয়োজনের সাহসী ভূমিকায় আবুল মোমেনও ছিলেন একজন। যে সময়টায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে হতো অনেক ইনিয়ে বিনিয়ে। সেই বিরূপ সময়ে এক অভিনব কৌশলে বিজয়মেলার নামে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আসা হল নগরবাসীর সামনে। এই মেলার নেপথ্যের একজন শক্তিশালী কুশীলব ছিলেন আবুল মোমেন। সাদাকালো যুগের স্থানীয় দৈনিক ‘পূর্বকোণ’ প্রকাশনার সূচনালগ্নের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, প্রায় সব কাজই করেছেন তিনি। কাগজটি সে সময়ে দেশের আধুনিকতম কাগজের পরিচিতি পায়। কাগজটির প্রাণপুরুষ ছিলেন আবুল মোমেন।
বর্তমানে দেশের শীর্ষ দৈনিক ‘প্রথম আলো’ নামটিও তাঁর নির্বাচন। ‘অধিনায়ক’ নামটি মোমেন ভাইয়ের বড় প্রিয়। আমিসহ কয়েকজন যখন একটি স্থানীয় পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখন প্রাথমিক পরামর্শটুকু পাই আমরা আবুল মোমেনের কাছে। মোমেন ভাইকে পত্রিকার নামকরণের জন্য বলি। তিনি তিনটি নাম দেন-অধিনায়ক, সুপ্রভাত, আর পূর্বাঞ্চল। আমরা মাঝেরটি বেছে নিই। অধিনায়ক নামটি যে তাঁর খুব প্রিয় তখন বলেননি, পরে বলেছেন। তিনি মনে করেন এমন একটা কাগজ দরকার যেটা সমাজকে নেতৃত্ব দেবে। পরে অবশ্য মোমেন ভাইয়ের দেয়া নামে ঢাকার খ্যাতিমান সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু ‘অধিনায়ক’ নামে একটি পত্রিকার ডিক্লারেশন নিয়ে রেখেছেন।
একজন নেতার যা থাকা দরকার, আবুল মোমেনের তা আছে। নাগরিক সমাজ গঠনের নানা আয়োজনে নিজেকে সব সময় সম্পৃক্ত রেখেছেন। তাঁর পথ নির্দেশ, তার পরামর্শ আর উপদেশ আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সংকটে ছায়া মেলে তাঁর কাছে গেলে। তিনি শুধু আমাদের নায়ক নন, তিনি অধিনায়ক।

আলোর অভিযাত্রী। একুশে পদক প্রাপ্তিতে আবুল মোমেন সংবর্ধনা পর্ষদের বিশেষ প্রকাশনা। ২২ মার্চ ২০১৭ [পুনর্মুদ্রণ]