যেভাবে কবির সঙ্গে দেখা

ওমর কায়সার »

ডিসি পাহাড়ের নিচে বড় শিরিষ গাছের মূলে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা কজন। চারদিকে সবুজ গাছপালা। মানুষজন নেই। তারপরও পরিবেশটা শান্ত ছিল না। বড় বড় গাছের ডালপালা পাতায় পাতায় অজস্র টিয়ে পাখির ডাক চারদিক মুখর করে রেখেছিল। একঝাঁক উড়াল দেয়। অন্য ঝাঁক এসে গাছের ডালে পাতার আড়ালে চলে যায়। আমরা কেউ কারো কথা শুনছিলাম না। পাখির কূজন আমাদের আড্ডার মধুরতায় বিঘ্ন ঘটালে আমরা পার্ক থেকে বেরিয়ে পড়ি। রাস্তার ওপারে তখন পাজামা-পাঞ্জাবিপরা একটা লোক হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখিয়ে অজয় (দাশগুপ্ত) আমাকে বলল- ওই লোকটাকে চিনিস?
লোকটাকে ভালো করে দেখলাম। চোখেমুখে প্রশান্তির ভাব। পা ফেলছে আলতো করে। যেন মাটি আঘাত পাবে এমন সাবধানে। কাঁধে একটা ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ। বন্ধুকে বললাম – উনি কবি।
অজয় বলল- তুই চিনিস তাহলে?
আমি বললাম, না তো।
-তাহলে কী করে বললি উনি কবি?
-চালচলন, হাঁটাচলা দিয়েই তো বোঝা যায়। অজয় বলল, আয়, চল। তাঁর সঙ্গে কথা বলি।
দ্রুত রাস্তা পার হয়ে সেদিন সেই লোকটির সঙ্গে কথা বললাম। অপরিচয়ের বাধাটুকু কেমন সহজে সেদিন ডিঙিয়ে ফেললাম বুঝতেই পারিনি। অজয় বলল, মোমেন ভাই ওর নাম কায়সার। লেখালেখি করে। লোকটি মূলত কবি। সময়টা আশি দশকের শুরুর দিকে। তখন সময়টা কবি-সাহিত্যিক আর সৃজনশীল, প্রগতিশীল মানুষের জন্য খুব সহজ ছিল না। সে বড় দুঃসময়ের দিন। সামরিক শাসনের কঠিন নজরদারি পার হয়ে মুক্তমতের চর্চা দুরূহই ছিল। এ সময় আমরা ছিলাম লক্ষ্যহীন। কী করা যায়? কী করতে হবে, বুঝতে পারছিলাম না।
আমাদের দিন চলছিল অপরিকল্পিতভাবে। শুধু সময় কাটানোর আড্ডা, গন্তব্যহীন পথচলায় জীবন চলছিল। তেমন একটা সময়ে হঠাৎ করে একটা আশ্রয়স্তম্ভ যেন খুঁজে পেয়েছি আমাদের বাউন্ডুলে তারুণ্যের দিনে। তিনি আমাদের পথচলাকে সহজ করে দিলেন। একটা মানচিত্র দেখালেন কীভাবে কোথায় যেতে হবে। ১৯৮৩ সালের সেই একটা দিন। সেই থেকে এখনো আছি কবির ছায়ায় মায়ায়। কবিতা পত্রিকা অচিরাকে ঘিরে তিনি সংগঠিত করলেন অচিরা পাঠচক্র। আমাদের সবাইকে সেখানে নিয়ে গেলেন। সেই পাঠচক্র চলল দশ বছর ধরে। আমাকে ফুলকি আর পূর্বকোণে সংযুক্ত করলেন।
আবুল মোমেন মূলত কবি। তিনি ভাবতেন, কবিতাকে সাজাতে, কবিতাকে নান্দনিক করে তুলতে যেমন শব্দ, ছন্দ আর অলংকার অপরিহার্য, তেমনি যুতসই কর্ম দিয়ে পৃথিবীটাকেই সাজাতে হবে, দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। এটা তিনি বিশ্বাস করেন। মানুষের অসুখ হলে যেমন চিকিৎসার দরকার, তেমনি দেশ যখন অসুস্থ হয়, তারও সেবার দরকার। সেটাই তাঁর ব্রত। সৃজন ও মননের যৌথ সম্মিলনে ঋদ্ধ কবি আবুল মোমেন দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সাহিত্যের নানা শাখায় যেমন কাজ করেছেন, তেমনি কাটাচ্ছেন এক অসাধারণ কর্মমুখর জীবন। নিজেকে প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে তিনি কবিতাকে প্রাধান্য দিলেও একজন শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সমালোচক, কলাম লেখক হিসেবেও তাঁর পরিচয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে তাঁর অবদান তাৎপর্যময়। তাঁর মেধার দ্যুতি চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সংবাদপত্র জগতকে করেছে আলোকিত। তাঁর হাত ধরে নতুন পত্রিকা যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি সাংবাদিকতার মানকে তিনি নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। একটা মানুষের এত পরিচয়, জ্ঞান ও কর্মের পরিধি এত বিস্তৃত, তারপরও একটা পরিচয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হন। সেটা হলো, তিনি ফুলকির মোমেন ভাই। শিশুদের স্বপ্নের জগত ফুলকি মোমেন ভাই আর শীলা মোমেনের তিলে তিলে গড়া এমন একটা প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পথ দেখাচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যেন এই ফুলকি থেকেই জেগে উঠছে। ফুলকি হলো ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ফুল। তার সৗরভে আমোদিত হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক।
সম্পাদক, ফুলকি ট্রাস্ট