টানেলের নিরাপত্তার বিষয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে

পরামর্শক প্যানেল সদস্য ড. বসুনিয়া

সুপ্রভাত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে কথা হয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্সের (বিএসিই) সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু টানেলের পরামর্শক প্যানেলের সদস্য অধ্যাপক ড. এম শামীম জেড বসুনিয়ার সঙ্গে।

সুপ্রভাত: টানেল নির্মাণে আপনারা কোন বিষয়ে সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছেন?
বসুনিয়া: এখানে প্রতিটি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপরও নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে হলে- নিরাপত্তার বিষয়ে জোর বেশি দেওয়া হয়েছে। এখানে দুটো টানেল পাশাপাশি আছে। দুটো প্রায় আড়াই কিলোমিটার লম্বা, ডাই মিটার প্রায় ১২ মিটারের মতো অর্থাৎ ৪০ ফুটের কাছাকাছি। ইনসাইডে এখানে একটা টানেলের মধ্যে ২ লাইনের একটা রাস্তা আছে। টানেলটা যেহেতু একটা সার্কুলার, তার ঠিক নিচে থেকে ২ থেকে আড়াই মিটার একটা স্ল্যাভ করা হয়েছে। স্ল্যাভটি হলো রোড ওয়েব। আপনারা যখন দেখবেন সাইডটা একটা কার্ভ। ওই অংশটায় ভূমির নিচে দুই থেকে আড়াই মিটার জায়গাটা আছে, তা অনেক কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। টানেলে কিছু হলে লোকজন কোথায় যাবে? কীভাবে বের হবে? সেখানে গেইট আছে কিছু দূর পরপর। লোকজন কাছের গেইটটা খুলে বের হয়ে যেতে পারবে। টানেলের মুখটা কোন দিকে কত সেটা বোঝার জন্য ডিস্টেন্স ইনডিকেটর আছে। হয়তো কেউ দেখলো- এক দিকে ১ হাজার মিটার, অন্যদিকে ১৫ ’শ মিটার। যেদিকে দূরত্ব কম সেদিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে।

সুপ্রভাত: টানেলটির ওপরে মাটি, তার ওপরে নদী ও সাগরের মোহনার পানি রয়েছে। এক্ষেত্রে পানির লবণাক্ততা কনস্ট্রাকশন ম্যাটারিয়ালের ক্ষতি করবে কি?
বসুনিয়া: টানেলটি বোরিং করছে ফোর সি বা সিসিসিসি (চীনা কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড)। এটি একমাত্র প্রজেক্ট, যেটির সময় মতো কাজ শেষ হয়েছে। কোভিডের মধ্যে দিয়ে কাজ শেষ হয়েছে এবং যত বাজেট ছিলো, সেই বাজেটেই কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই টানেল করার সময় সাসটেইন্যাবলিটি ও সেফটি বিষয়ে আমরা খুবই কেয়ারফুল ছিলাম। একই সাথে চায়না কোম্পানিরা কেয়ারফুল ছিলো। একবার যদি টানেলটার কাজ শেষ করা হয়, তখন অনেকগুলো কাজ আর রিপিট (পুনরায়) করা যাবে না। তাই টানেলের পুরো জিনিসটাই কংক্রিট দিয়ে বাানানো হয়েছে, টানেলের আউটারে সাতটা পার্ট আছে, দুই মিটার করে। পার্টগুলোর সমস্ত কিছু চায়না থেকে এসেছে। এখানে শুধু বাংলাদেশ কন্সট্রাকশনের টেকিনোলজি, যেটা আফ্রিকাকে ফলো করে; সেটা আমরা করেছি। চারপাশে যে স্ল্যাভটা সাত ভাগে বিভক্ত, সবকিছু চায়না থেকে এসেছে। একেকটা স্ল্যাভের সাথে একেকটা পার্ট। প্রত্যেকটা একদম আলাদা। কারণ টানেলটি কিছুদূর পরপর বাঁক নিয়েছে । তাই আলাদা আলাদা করে সবকিছু করা হয়। প্রত্যেকটা পার্ট লাগানোর পরে কেমিক্যাল দিয়ে ফিল (পূরণ) করা হয়।

সুপ্রভাত: অবকাঠামো হিসেবে টানেল আমাদের জন্য নতুন। তাই এখানে কোন ক্ষেত্রে কাজ করাটা আপনাদের কাছে কঠিন মনে হয়েছে?
বসুনিয়া: এই টানেলের সবচেয়ে কঠিন সময়টা ছিলো- দুইটা টানেলের পাশাপাশি দূরুত্ব প্রায় ১২ মিটার। এই দুইটি টানেল জোড়া লাগোনোটা বেশ কঠিন সময়। কারণ এটা পানির মধ্যে দিয়ে মাটির তলে। একটু ব্যতিক্রম হলেই সাথে সাথে সমস্ত পানি ঢুকে যেত। তাই কাজটি করার সময় টানেলে দুই মুখ লিকুউড নাইট্রোজেন দিয়ে ফ্রোজেন করা হয়। মাইনাস ৩০ ডিগ্রি করা হয়। তখন আমি বেশ কয়েকবার ঘুরে ঘুরে দেখেছি। এ জোড়া লাগানোর কাজগুলো ম্যানুয়ালি হয়েছে। খুবই কঠিন কাজ ছিল। এই ট্যানেল আমাদের জন্য বিরাট পাওয়া, আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বড় অভিজ্ঞতা।

সুপ্রভাত: টু সিটি ওয়ান টাউনের বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
বসুনিয়া: টানেলের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার বিরাট উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। পুরো সিটিতে না ঘুরে টানেল দিয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণে চলে যাওয়া যাবে। এখন ঢাকা থেকে এলে কাউকে আর পুরো শহর ঘুরে বাড়ি যেতে হবে না। টানেল দিয়ে কয়েক মিনিটেই বাড়ি পৌঁছাবে। টানেলের শেষ মাথায় আনোয়ারা সাইটে আবার বড় করে সার্ভিস স্টেশন করা হয়েছে। সেখানেও লোকজন যাবেন, সেবা পাবেন। ছোট ছোট বাড়ি করে কটেজ করা হয়েছে। ওখানে সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি প্ল্যানে নদীর দক্ষিণ পাড়ের অংশকেও ইনক্লুড (অন্তর্ভূক্ত) করে আবাসন, পর্যটন ও শিল্প-কারখানার পরিকল্পনা করা যাবে। শুধু আনোয়ারা নয়, এর পাশাপাশি বাঁশখালী, পটিয়া এবং চন্দনাইশেও নগরের ফ্যাসিলিটি দেওয়া যাবে।

সুপ্রভাত: যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু বলা হচ্ছে এ উন্নয়নে জনসম্পৃক্ততা থাকছে না। এটি কেন?
বসুনিয়া: দেখেন, যখন ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হলো তখন আমি ওটার বিরোধিতা করেছি। কিন্তু এখন আমার বাসায় আসার আগে এ এক্সপ্রেসওয়ে ঘুরে আসতে বেশ ভালো লাগে। তবে একটা জিনিস কি- এই এক্সপ্রেসওয়েতে কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নাই। কয়জন আর প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে ঘুরতে পারে। উন্নয়নের সবগুলো কাজে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। এরজন্য বেবিট্যাক্সি (অটোরিকশা) বা মোটরসাইকেল চলার অনুমতি দিতে হবে। সময় যেহেতু কম লাগবে, মানুষের আগ্রহও থাকবে। কম ভোগান্তিতে মানুষ এপার-ওপার যেতে পারবে। মানুষ তো সুবিধা ভোগ করবেই। যেমন পদ্মা ব্রিজের মধ্যে দিয়ে আসছে। বিরাট একটা অংশের মানুষ উপকৃত হয়েছে। টানেল মাধ্যমে দুই পারের মানুষ উপকৃত হবে। এত বড় বড় প্রকল্প, সর্বসাধারণ যদি সুবিধা ভোগ না করে তাহলে কীভাবে হবে। টানেলে এই সুবিধা দিতে হবে।

সুপ্রভাত: বলা হচ্ছে, টানেলের গতিবেগ শুরুর দিকে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার রাখলেও পরে ৮০ কিলোমিটার করা হবে। তাই দূর্ঘটনা এড়াতে সিএনজি অটোরিকশা ও মোটর সাইকেলকে অনুমতি দেবে না। এ প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
বসুনিয়া: আমি তা জানি না, কেন নিরাপদ নয়। গতি ৮০ হলে সিএনজি ও মোটর সাইকেল যারা চালাবেন তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তারা যদি নিয়ম-নীতি না মানে, তাহলে তাকে থামাতে হবে। আগে-ভাগে বলাটা ঠিক হবে না। আমার মনে হয় যেতে দেওয়া উচিত। যদি আইন না মানে তাহলে কঠোরভাবে পানিশমেন্টের ব্যবস্থা করা হোক। কিছু কিছু মানুষের ভুল আচরণের জন্য উন্নয়নের সুফল সবাই পাবে না, তা হয় না।