জেলেদের জরাজীর্ণ জীবন

ফৌজদারহাট উত্তর সলিমপুর দেলেপাড়া গাঁ

হুমাইরা তাজরিন »
ফৌজদারহাটের উত্তর সলিমপুরের দেলেপাড়া গাঁ। যেখানে বসবাস করেন প্রায় আড়াই হাজার জেলে পরিবার। বাংলাদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর জীবনমানের পরিবর্তন আসলেও জেলেরা কাটাচ্ছেন জরাজীর্ণ জীবন। তাদের এই অবহেলিত জেলেজীবনের ওপর আলোকপাত করেছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের ছাত্র দিপ্তেনু সাহা। দিপ্তেনুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম বর্ষের ২য় সেমিস্টারের একাডেমিক থিসিসের বিষয় ছিলো ‘হাউজিং ফর ফিশারম্যান কমিউনিটি’।
হরিলাল জলদাস নামের এক জেলে বলেন,‘আমাদের জীবিকা হলো মাছ ধরা। এটাই করেই আমরা বেঁচে থাকি। এতোবছর আমরা এখানে আছি; অথচ এখনও মাছ রাখার মতো একটা আড়তের ব্যবস্থা আমাদের নেই। যার কারণে পাইকারি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হয়। জাল বোনা ,জাল রাখা থেকে পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থাও নেই। মন্দিরগুলোর অবস্থাও ভালো না। সেখানে যে বছরে ছয়মাসে একটা বড়ো পূজা করবো তার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নাই। আমরা অমানবিক পরিশ্রম করি। রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি, শীতে কাঁপি। কিন্তু আমাদের জীবনের কোনো পরিবর্তন নেই। আমাদের যে ভাতা দেয়া হয় তা খুবই নগন্য। সরকারের কাছে আমাদের আর্জি, সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে গৃহায়ণের ব্যবস্থা করে আমাদের জীবনমান উন্নয়নে এসব সংকট নিরসন করা হোক।
২৬ জানুয়ারি বিকেলে সরেজমিন দেলেপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, দূর থেকে ভেসে আসছে জালের গন্ধ। পরিত্যক্ত মাছ ধরার সরঞ্জাম এখানে ওখানে পড়ে রয়েছে। টংয়ের দোকানে দলবেঁধে আড্ডা দিতে দেখা যায় জেলেদের। প্রতিটি ঘরের অবস্থা জরাজীর্ণ। বেশিরভাগ ঘরই জোড়াতালির কাঠে আগলে রাখা হয়েছে। কাঁচা ঘরের সংখ্যা মোট ঘরের ৬০ শতাংশ। যার বেশিরভাগেরই টিন, বেড়ার অবস্থা শোচনীয়। জং ধরে ক্ষয়ে গেছে বিভিন্ন জায়গায়। ভাঙা বেড়াকে ঢাকা হয়েছে ছেঁড়া কাপড় দিয়ে। সেমিপাকা ঘরের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ। কেউ কেউ পাকা ঘর তুলেছেন তবে তার অনেকটাই কাঠামো। যার সংখ্যা ৫ শতাংশ। রয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। পানি বা আবর্জনা নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও স্বস্তিদায়ক নয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করছেন তারা। শিশুদের জন্য নেই প্রাক- প্রাথমিক বিদ্যালয়। কেউ কেউ গোষ্ঠীর বাইরে গিয়ে পড়াশোনায় এগোলেও বেশিরভাগেরই অক্ষরজ্ঞান নেই। কোনো কমিউনিটি হাসপাতালও নেই সেখানে। নেই সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা। কেবল তিনটি মন্দির রয়েছে। শিব মন্দির ,কৃষ্ণ মন্দির ও দুর্গা মন্দির। পূজার সময়ে এসব মন্দিরে মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে আনন্দ উদযাপনের সুযোগ হয় তাদের।
৩০ বছর পরের জেলেপল্লীর সম্ভাব্য জনসংখ্যার চাহিদা অনুযায়ী গৃহায়নের মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছেন দীপ্তেনু সাহা। তিনি বলেন, ‘এই মানুষগুলোর জীবন এতো বছরেও পরিবর্তন না হওয়ার কারণ তাদের অন্যদের সাথে মেশার সুযোগ নেই। বর্ণ বৈষম্যের কারণে আর দশজন মানুষের মতো তারা মর্যাদা পাননা। আমার কাছে মনে হয়েছে, তারা আমাদের সমাজে বেশ অবহেলিত অথচ আমাদেরই সমাজের একটা অংশ। সমাজকে এগিয়ে নিতে সকলেরই জীবনমানের পরিবর্তন প্রয়োজন। তাই থিসিসের বিষয় হিসেবে ‘হাউজিং ফর ফিশারম্যান কমিউনিটি’ নিবার্চন করি। যেখানে আমি দেখিয়েছি, প্রকৃতিকে অক্ষত রেখে তুলনামূলক উন্নত গৃহায়ণ ব্যবস্থা।’
দীপ্তেনুর মহাপরিকল্পনাটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তিনি পুকুরগুলোকে অক্ষত রেখেছেন। বাগান ও গাছপালার জন্যও রেখেছেন পর্যাপ্ত জায়গা। হিন্দু জেলে গোষ্ঠীর মন্দিরগুলো অক্ষত রেখেছেন। সংযুক্ত করেছেন খেলার মাঠ, কমিউনিটি ক্লিনিক, প্রাথমিক স্কুল, মাল্টিপারপাস হল, মাছ বাজার ও মাছ সংরক্ষণের জায়গা , সবজি বাজার , জাল বোনা এবং শুকানোর জায়গা, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড ও গাড়ি চলাচলের রাস্তা। তবে জেলেপাড়ার মাছ গাড়িতে আনা নেওয়ার জন্য তিনি পরিকল্পনাতে চলাচলের রাস্তার গতিপথে কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন। পরিকল্পনা করেছেন ইট,টিন এবং বাঁশের সমন্বয়ে ঘর। যেগুলো হবে দোচালা। পর্যাপ্ত আলো বাতাস সঞ্চালনের ব্যবস্থা থাকবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঘরগুলোতে জায়গা অপচয় না করে কক্ষ বাড়ানোর ব্যবস্থাও থাকবে।
এ ব্যাপারে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সনজিত কুমার নাথ বলেন,‘বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে সুবিধাবঞ্চিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য অনেকগুলো প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করেছে। তাই আমাদের মনে হলো এই জেলেদের জীবনযাপনও খুব নাজুক। তাদের জীবনমানের পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। এমনিতে জেলেরা ভাসমান একটা জীবন যাপন করে তবে দেলেপাড়ার এই জেলেরা বহুবছর ধরে এখানে বসবাস করছে। জেলেদের আবাসনের জন্য সরকার ইতোমধ্যে এই জায়গাটি চিহ্নিত করেছে। এই পরিকল্পনাটিতে দীপ্তেনু জেলেদের হাঁটা ও মাছবাহী গাড়ি চলাচলের রাস্তা হতে শুরু করে মাছ বাজারসহ সবকিছুর পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছে; যাতে মাছ সংরক্ষণ থেকে বিক্রয় সবকিছু বর্ণিত আছে। ঘরগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে সামনে, পাশে ও উপরে বাড়ানো যায়। জেলে গোষ্ঠীর একত্রিত হওয়ার জন্য বর্তমানে সেখানে কোনো খোলা স্পেস নেই। এজন্য মাল্টিপারপাস হল সংযুক্ত করা হয়েছে পরিকল্পনাটিতে। তাছাড়া কাছাকাছি এরিয়ার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় সেটিও এখানে ইনক্লুড হয়েছে। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হলে জেলেরা বেশ উপকৃত হবে। কেননা মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হলে তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন। এখন সেখানে যেভাবে তারা থাকছেন এবং কাজ করছেন তা খুব কষ্টসাপেক্ষ। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হলে তাদের জীবন সহজ হবে এবং উৎপাদনশীলতাও বাড়বে।’