জনগণের রাস্তাঘাট ও ফুটপাত জনগণকে ফিরিয়ে দিতে চাই

নগরবাসীকে পবিত্র মাহে রমজানের শুভেচ্ছা

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী »

পাহাড়, সমতল, উপত্যকা, সাগর ও নদী সমন্বিত প্রিয় চট্টগ্রামের প্রিয় জনগণ আপনাদের জানাই রমজান মোবারক। মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের অপার সুযোগ নিয়ে প্রতি বছরের মত আবারো ফিরে এল পবিত্র রমজান। এ মাসে সিয়াম সাধনা ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ও দৈহিক শৃঙ্খলা বিধান, পারস্পরিক সম্প্রীতি-সহানুভূতি এবং সামাজিক সাম্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও রমজানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাহে রমজানকে যথার্থভাবে কল্যাণের কাজে লাগাতে ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনে করণীয় নির্ধারণে রমজানকে স্বাগত জানাতে হয়। পরিবারের উন্নয়নে ও কল্যাণে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য করণীয় নির্দেশ করা একজন গৃহকর্তার পবিত্র কর্তব্য। ঠিক তেমনি নগরের ও মহানগরবাসীর কল্যাণে কাজ করা এবং নাগরিকদের জন্য সঠিক পরামর্শ নির্দেশ করা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে একটি পবিত্র কর্তব্য মনে করি।
সংযমের শিক্ষা নিয়ে রমজান আসে। সংযমী জীবন যাপন নিজ ও অপরের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কতিপয় অসাধু লোক ঠকিয়ে অতিরিক্ত অর্থ বিত্ত লাভের জন্য এ রমজান মাসকেই বেছে নেয়। তারা সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে সাধারণ জনজীবনে নাভিশ্বাস তৈরি করে। আবার একটা শ্রেণি রয়েছে যারা রমজানের দিনের রোজা শেষের পবিত্র ইফতার ও সেহেরিতে ভোজনের সময় আতিশয্য প্রকাশ করতে গিয়ে সীমাহীন অপচয়ে লিপ্ত হয়।
অপরদিকে আরেকটা শ্রেণিকে ইফতার ও সেহেরির প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী যোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, মুনাফালোভীদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং শাস্তির মুখোমুখি করা হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেটগণ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বিশেষ টিম নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠে থাকবে। আর যাদের অঢেল অর্থ সম্পদ আছে বলে, রমজানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয়োজনে রসনা বিলাস ও অপচয়ে মেতে ওঠেন তাদের কাছে আমার পরামর্শ রইল অপচয় না করে অতিরিক্ত খরচ বাঁচিয়ে অসচ্ছল প্রতিবেশি রোজাদারদের মাঝে যথাসম্ভব খাদ্য সামগ্রী বিলিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে ছাওয়াব অর্জনের পাশাপাশি সাম্যতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা যায়। দেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের কাণ্ডারি, বিশ্ব মানবতার জননী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতিগত কল্যাণের কথা বিবেচনা করে জৌলুসপূর্ণ ইফতার মাহফিল আয়োজন পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যৌক্তিক পরামর্শের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও আনুগত্য নিয়ে চট্টগ্রামের সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ব্যয়বহুল ও জৌলুসপূর্ণ আয়োজন না করে তুলনামূলক অসচ্ছল মানুষের পাশে ইফতার ও সেহেরি সামগ্রী নিয়ে দাঁড়ানোর উদাত্ত আহ্বান জানাই।
প্রিয় নগরবাসী আপনারা জানেন, নানাবিধ কারণে চট্টগ্রাম দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর। চট্টগ্রাম স্থবির হলে তার প্রভাব সমগ্র বাংলাদেশেই পড়ে। তাই চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা ঠিক রাখা শুধু মাত্র চট্টগ্রাম নয় সারা দেশের মানুষের কল্যাণের স্বার্থেই জরুরি। আমরা দেখতে পাই, প্রায় সারা শহরের রাস্তার পাশের জনসাধারণের হাঁটার জন্য রাখা ফুটপাতগুলো দিনকে দিন বেদখল হয়ে গেছে। এমনকি ফুটপাতের ওপর স্থায়ী দোকানপাট বসিয়ে ফেলেছে অনেকেই। নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে দফারফা করে হাজার দোকান বসিয়ে ফুটপাত দখল শেষে অনেক ক্ষেত্রে যান চলাচলের রাস্তার অর্ধেকটা পর্যন্ত দখল করে ব্যবসা করে আসছে একটা শ্রেণি। ফলে স্বল্প দূরত্বে হেঁটে স্কুল-কলেজে যাতায়াতকারী শিক্ষার্থীসহ জনসাধারণকে যেমন চরম বিব্রতকর পরিস্থিতি ও দুর্ভোগের শিকার হতে হয়, তেমনি যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় কর্মস্থলে ছুটে চলা দূরের যাত্রী সাধারণকেও অনেক বিড়ম্বনা ও কষ্ট পেতে হয়। দশ বিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা আবার কখনো কখনো তারও বেশি সময় লেগে যায়। তাতে যেমন অপরিমেয় শ্রম ঘণ্টার অপচয় হয়, তেমনি ঝঞ্ঝাময় পথ পাড়ি দিয়ে কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলে কর্মীরা। এতে সামগ্রিক অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাত্রা নিশ্চিত করতে ও যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে ফুটপাতকে অবৈধ দখলদার ও তথাকথিত হকারমুক্ত করতে জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে আমরা কাজ করছি। সাধারণ জনগোষ্ঠী, তরুণ ও ছাত্রসমাজ এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠী অবৈধ দখলদার ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে মায়াকান্না করতে দেখে বিস্মিত হয়েছি। হকার বলতে আমরা ছোটবেলা থেকে বুঝি ফেরিওয়ালা, যারা পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। যারা জনস্বার্থে নির্মিত রাস্তাঘাট ও ফুটপাতে ঝেঁকে বসে তুলনামূলক কম শ্রমে সুবিধাজনক উপায়ে অর্থ উপার্জনে লিপ্তদের কারা হকার তকমা লাগিয়েছে আমার জানা নেই। তারা কেবলমাত্র কিছু চাঁদাবাজদের মাসোয়ারা দিয়ে সকল প্রকার সরকারি ট্যাক্স ও ভ্যাটের আওতার বাইরে থেকে জনগণের চলাচলের রাস্তা দখল করে ব্যবসার নামে অর্থ উপার্জনকে আমি হকার না বলে সুবিধাবাদিই বলব। মানবিক বিবেচনায় তথাকথিত হকারদের শৃঙ্খলায় আনতে এবং নিয়মতান্ত্রিক ব্যবসা করার সুযোগ দিতে সাবেক মেয়র প্রয়াত জননেতা চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী কোর্ট হিলের পাশের টিলায় জহুর হকার্স মার্কেট প্রতিষ্ঠা করে শতাধিক দোকান ঘর তাদেরকে বরাদ্দ দেয়। এখানেও খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সেই হকারদের অনেকেই স্বল্পমূল্য বা নামমাত্র মূল্যে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত দোকান ঘর অন্য ব্যবসায়ীদের নিকট বেশি দামে বিক্রি করে দিয়ে পুনরায় রাস্তা দখলের ব্যবসায় ফিরে এসেছে। শুধু তাই নয়, আরো অনেকেই ক্রমান্বয়ে রাস্তায় ব্যক্তিগত ব্যবসা খুলে বসে। দফায় দফায় সাথে কথা বলে এদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী করেছিলেন। ফলে, তাদের দখলদারিত্ব অসহনীয় পর্যায়ে তখন পৌঁছায়নি। সারা শহরময় যত্রতত্র রাস্তা ও ফুটপাত জুড়ে বাজার তখনো বসেনি বা বসতে দেয়া হয়নি। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে এসব দেখার যেন কেউ ছিলনা। তাই গলি থেকে রাজপথ সর্বত্র দখলদারদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জনগণ স্বাচ্ছন্দ্যে পথচলার অধিকার হারিয়েছে। রাস্তা চলতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে, হেনস্থার শিকার হচ্ছে।
গণমানুষের সমর্থন পেলে আমি সারা শহরের রাস্তাঘাট ও ফুটপাতকে তথাকথিত দখলদার হকারদের হাত থেকে মুক্ত করতে চাই। এ ব্যাপারে কোন শক্তির অনৈতিক চাপের কাছে আমি মাথা নত করব না। হ্যাঁ, আমিও প্রয়াত জননেতা চট্টলবীরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাদেরকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দিতে উদ্যোগ অবশ্যই নিতে চাই। তবে সবার আগে জনগণের ফুটপাথ, জনগণের রাস্তাঘাট জনগণের জন্য অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। আমি আমার মহানগরবাসী এবং সংবাদ মাধ্যম এর সমর্থন চাই, দোয়া চাই, সচেতন ভূমিকা চাই। ইতিমধ্যে জনবহুল স্টেশন রোড, নিউ মার্কেট, রেয়াজ উদ্দিন বাজার, ঐতিহাসিক মিউনিসিপাল মডেল হাই স্কুল ও কলেজের সামনের এলাকাকে অবৈধ দখলদার মুক্ত করে ফুটপাত এবং রাস্তাকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে স্মরণাতীতকালের ব্যাপকতর অভিযানে সহায়তাকারী আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কর্পোরেশনের টাস্ক ফোর্স, ম্যাজিস্ট্রেট, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের জানাই ধন্যবাদ। সর্বস্তরের জনতা, সচেতন ছাত্র ও যুবসমাজের যারা সিটি কর্পোরেশনের এ অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছে, সমর্থন দিয়েছে সকলকে জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আগামীতেও জনস্বার্থে আমাদের অভিযান ও মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। শহরকে সুন্দর, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও স্মার্ট সিটিতে রূপান্তর করতে আমাদের কর্পোরেশনের সকল কার্যক্রমে নগরবাসীসহ সকল মহলের সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করে আবারো সকলকে পবিত্র রমজানের শুভেচ্ছা জানাই। সকলে সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন, সুন্দরের সাথে থাকুন, নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকুন।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক : মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন