করোনার উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি ও আইন

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ »

দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হঠাৎ উদ্বেগজনক পর্যায়ে। চীনে সর্বপ্রথম ধরা পড়লেও বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের শহরে, আমাদের গ্রামে। কিছুদিন আগে আক্রান্তের হার কমে এসেছিল যেমনটা রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এর মাধ্যমে জানতে পারি। কিন্তু বিগত কয়েকদিনের মধ্যে এই সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। আর শুরুতেই উপসর্গ দেখে অনেক সময় বুঝা কঠিন যে এটি ভাইরাস নাকি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ। এ ভাইরাস প্রতিরোধে আত্মসচেতনতা খুবই জরুরি। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই। হাঁচি বা কাশির পরে হাত ধুয়ে ভাল ভাবে ধুয়ে নিতে হবে, কাশি বা হাঁচির আগে মুখ ঢেকে নিতে হবে, মাংস ও ডিম ভাল করে সিদ্ধ করতে হবে, সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলতে হবে, নাক-মুখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ এবং পশু-পাখি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সাবান বা সেনিটাইজার দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুয়ে নিতে হবে, ব্যবহৃত টিস্যু বা রুমাল যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না। বাহিরে যেতে হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। হ্যান্ডশেক ও কোলাকুলি থেকে বিরত থাকা দরকার। প্রচার-প্রচারণা করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আতংকিত না হয়ে সচেতন হয়ে নাক-মুখের সাবধানতার জন্য সচেতন করাতে হবে। রোগবিস্তার যেন বন্ধ হয় তার জন্য সতর্ক করাতে হবে। হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে চলতে হবে। কোয়ারেন্টাইন মানে রোগের সংক্রমণ এড়াতে নিজেকে সবার থেকে একটি ঘরে আলাদা করে রাখা এবং অন্যদের থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা।
পাশাপাশি করোনা প্রতিরোধে আইন মেনে চলতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ও সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশনা অবশ্যই মেনে চলার জন্য বলা হয়। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হয়ে নাক-মুখের সাবধানতার জন্য সব সময় সচেতন থাকতে হবে। বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাহিরে যেতে নিষেধ রয়েছে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন এলকায় জনসচেতনতার ব্যাপক ঘাটতি লক্ষ্য করা হয়। এর বাস্তবতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা।
এ অবস্থায় এই ভাইরাসের সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮’-এর কঠোর প্রয়োগ জরুরি। মূলত যেকোন সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে মানুষ যেন নিজে বাঁচার পাশাপাশি অন্যকে সংক্রমিত না করতে পারে সে লক্ষ্যে আইনটি করা হয়। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮এর ১১ (১) ধারার ক্ষমতাবলে যেখানে সারা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিধিনিষেধ ভঙ্গকারীদের এই আইনের অধীনেই বিচারের আওতায় আনা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ‘‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন ২০১৮” প্রণয়ন করা হয়েছে। উক্ত আইনে কারাদ- ও জরিমানার বিধান রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করেন, বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অপর কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত ব্যক্তি বা স্থাপনার সংস্পর্শে আসার সময় সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি তার নিকট গোপন করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তির উক্ত কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৬ (ছয়) মাস কারাদ- বা অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে।
আবার যদি কোনো ব্যক্তি-মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তাহার উপর অর্পিত কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন এবং সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন সেক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদ- বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে। আবার যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদান করেন সেক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ২ (দুই) মাস কারাদ-, বা অনূর্ধ্ব ২৫ (পঁচিশ) হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে।
আইন অনুযায়ী, কোন অস্থায়ী বাসস্থানের বা আবাসিক হোটেল ও বোর্ডিং এর মালিক যদি জানতে পারেন যে তার ওই স্থানে থাকা কেউ এই সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তবে অবশ্যই সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসককে জানাতে হবে। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে একই নিয়ম মানতে হবে, অর্থাৎ তার অধীনে কোন সংক্রামক রোগী চিকিৎসা হলে, সিভিল সার্জনকে রোগী সর্ম্পকে সব ধরনের তথ্য দিতে হবে। এই আইনের অধীন সংঘটিত কোন অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও আপিল নিস্পত্তির ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির বিধানগুলো প্রযোজ্য হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ২৬৯, ২৭০ ও ২৭১ ধারায় সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে।
এদিকে কয়েক দফা লকডাউন ঘোষণার পর জনজীবন সচল রাখতে বাংলাদেশে লকডাউন তুলে দেওয়া হয়। অনেক স্থানেই হাট-বাজার, ব্যবসা কেন্দ্র, দোকানপাট খোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, সবখানেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। খুলেছে শত শত পোশাক কারখানা, ফুটপাতে বেচাকেনা। ফলে সবখানে জনসমাগম বাড়ছে। শর্তসাপেক্ষে বাস্তবতার নিরখে যদিও দোকানপাট খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তবুও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। সড়কগুলো মানুষের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। এছাড়া রিকশা, ইজিবাইকসহ ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যাও বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিধিগুলো ঠিকভাবে মেনে চলছে না। আইন অমান্য করে যাচ্ছেন বেশির ভাগ মানুষ। ভিড় লেগে আছে হাট-বাজার, চায়ের দোকানসহ প্রায় জায়গায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বাধার মুখেও নানা অজুহাতে মানুষ কখনো একলা, কখনো কয়েকজন একসাথে বিনা প্রয়োজনে ঘুরতে বের হচ্ছেন। শুরু থেকেই এখানে চরম উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। এভাবে চলতে থাকলে সংক্রমণ আরো বেশি বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সচেতনতা বাড়াতে এবং ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সম্প্রতি জানানো হয়েছে যে, বাংলাদেশের ২৯টি জেলা করোনা ভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ১.সব ধরনের জনসমাগম (সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয়/অন্যান্য) সীমিত করতে হবে। উচ্চ সংক্রমণের এলাকায় সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ থাকবে। ২. মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। ৩. পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্র, সিনেমা হল, থিয়েটার হলে জনসমাগম সীমিত করতে হবে এবং সব ধরনের মেলা আয়োজন নিরুৎসাহিত করতে হবে। ৪. গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ধারণ ক্ষমতার অর্ধেকের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। ৫. সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আন্তজেলা যান চলাচল সীমিত করতে হবে; প্রয়োজনে বন্ধ করতে হবে। ৬. বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। ৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খোলা ও উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনা-বেচার ব্যবস্থা করতে হবে, ওষুধের দোকানেও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ৮. স্বাস্থ্যসেবার প্রতিষ্ঠানগুলোয় মাস্ক পরাসহ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। ৯. শপিং মলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ১০. সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। ১১. অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরা/আড্ডা বন্ধ করতে হবে। অপ্রয়োজনে ১০টার পর বাইরে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ১২. প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক পরাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক না পরলে কিংবা স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। ১৩. করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা লক্ষণযুক্ত ব্যক্তির আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা অন্যদেরও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। ১৪. জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানায় পরিচালনা করতে হবে অর্ধেক জনবল দিয়ে। গর্ভবতী, অসুস্থ, ৫৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের বাসায় থেকে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। ১৫. সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ কর্মশালা যথাসম্ভব অনলাইনে আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে। ১৬. সশরীরে উপস্থিত হতে হয়- এমন যে কোনো ধরনের গণপরীক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। ১৭. হোটেল-রেঁস্তোরায় ৫০ শতাংশ আসনের বেশি মানুষ বসানো যাবে না। ১৮. কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এবং অবস্থানকালে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা সহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
আসুন, আমরা সবাই নির্দেশাবলী মেনে চলি, সংক্রমণ থেকে নিজেকে এবং অন্যকে রক্ষা করি। এখন প্রয়োজন দল-মত-সংগঠন নির্বিশেষে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে জনগণকে সচেতন করা। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সকলে মিলে প্রচার-প্রচারণা চালাই, জনগণকে বিপদ হতে রক্ষা করি। করোনা প্রতিরোধ জাতীয় দায়িত্ব, সুতরাং সকলে এই দেশপ্রেমিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে যাই।

লেখক : আইনজীবী