কক্সবাজারে রেল গেল ও সাম্প্রতিক রাজনীতি

মোহীত উল আলম »

কক্সবাজারে রেল গেল। অনেকের মনে থাকতে পারে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পর তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছিলেন যে সহসাই কক্সবাজার, কাপ্তাই এবং রাঙামাটির সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সে সময় এ খবরটি অবিশ্বাস্য মনে হলেও আজকে একান্ন বছর পরে অন্তত কক্সবাজারে রেল যাবার ব্যাপারটি সত্যে পরিণত হলো। এ প্রসঙ্গে সাহিত্য থেকে একটি উদ্ধৃতি দিতে হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস পথের পাঁচালী যে সময়ে রচিত হয়, সম্ভবত সে সময়ে গ্রামবাংলায় রেলপথ প্রথমবারের মতো বসানো হয়েছিল। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলের ভিতর দিয়ে হুইশেল বাজিয়ে ঝিকঝিক শব্দে রেলগাড়ি ঝমাঝম ছুটছে এ দৃশ্যটি পরিচিত হয়ে উঠছিল। উপন্যাসে তাই দুর্গা তার ছোট ভাই দুরন্ত কিশোর অপুকে বলছে, “অপু, তুই আমাকে একদিন রেলগাড়ি দেখাবি?” উপন্যাসটিতে, যদি আমার স্মৃতি ঠিক বলে, দুর্গার রেলগাড়ি দেখা হয় নি, কেননা তার আগেই তার মৃত্যু হয়। কিন্তু সত্যজিৎ রায় উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রায়নের সময় ঠিকই অপু এবং দুর্গা গ্রামের তেপান্তর পার হয়ে অন্য অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে ছুটন্ত রেলগাড়ি দেখতে এসেছিল বলে মনে পড়ে।

কক্সবাজারে রেলগাড়ি পৌঁছে যাবার সঙ্গে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকা-ের সম্পর্ক আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের অভিযানের দুর্দান্ত মাইলফলক কক্সবাজার পর্যন্ত রেল নিয়ে যাওয়া। এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বঙ্গবন্ধুর তনয়ার হাতে বাংলাদেশের যতো ভৌত উন্নতি সাধিত হয়েছে, এরকম উন্নতি জাতি এক সময় স্বপ্নেও আনতে পারতো না। বয়স্কভাতা প্রদান থেকে শুরু করে, গ্রামের কৃষির উন্নয়ন, গ্রামের চিকিৎসার উন্নয়ন, খামারের উন্নয়ন, আশ্রয়নসহ সড়ক, সেতু, রেল, বিমান, বিশ্ববিদ্যালয়, বিনাবেতনে বই বিতরণ, রকেট উৎক্ষেপণ, নারীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, উড়াল সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রো রেইল, পারমানবিক চুল্লী স্থাপন, পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেললাইন, এবং কর্ণফুলীর নীচে টানেল এইসব উন্নয়ন একসময় রূপকথার মতো শোনাতো।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে আসার সাথে সাথে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলগুলো সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি তুলে গত মাসখানিক ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে, যার ফলে সম্পদ নষ্ট যেমন হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে লোকক্ষয়। এই নিয়ে সরকারও বেশ একটা অস্বস্তির মধ্যে আছে। কারণ এবারের নির্বাচনটি নিয়ে বিশ্ব পরাশক্তিগুলোও সতর্কভাবে কিছু কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে (যেমন ভিসানীতি) যার উদ্দেশ্য হলো সরকারের ওপর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। আমেরিকার বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ২ নভেম্বর ’২৩ সংখ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে “হার্ড পাওয়ার : প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা অ্যান্ড দ্য ফেইট অব ডিমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রচ্ছদকাহিনী করলেও, তাতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচন সম্পর্কে যথেষ্ট সমালোচনা আছে, এবং বলা হয়েছে যে আমেরিকা খর হয়ে আছে যাতে বাংলাদেশ কোনভাবে চীন দ্বারা সম্পূর্ণ প্রভাবিত না হয়। প্রতিবেদনকারী সাংবাদিক ব্রিকসে কেন বাংলাদেশকে সদস্যপদ দেওয়া হলো না সে ব্যাখ্যায় বলেছে যে ভারত সেটি চায়নি, কেননা বাংলাদেশ ব্রিকসে ঢুকলে চীন আর বাংলাদেশের মধ্যে আঁতাত অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে সেটি ভারতের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদনটি প্রকাশের একই সময়ে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা ইন্ডিয়া টুডে-তে বলা হয়েছে যে ভারত গভীরভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনপ্রাক্কালের সময়টুকু পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছে যে আমেরিকা-চীন এবং ভারতের ত্রয়ী স্বার্থ বাংলাদেশের নির্বাচনের অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। সাথে সাথে ভারত নিজেকে একটু লো প্রোফাইলে রাখতে চায়, কেন না সে চায় না যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে তার নাম আসুক।

উপরে উল্লেখিত বৈশ্বিক কারণে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বেশ খানিকটা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচি আপাতদৃষ্টিতে প্রায় নিস্ফল ও ধ্বংসাত্মক মনে হলেও, এই কর্মসূচিগুলি যে একটি সংকট তৈরি করছে সেটি বাস্তব। এবং বাজারের দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি সাধারণভাবে জনজীবনে একটি অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে, এবং এর সঙ্গে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতার সংযোগ ঘটে (যা স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটতে বাধ্য) তা হলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পথে জনজীবনের নিরাপত্তা ও জীবননির্বাহের মতো গুরুতর প্রশ্নগুলি এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।

রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সাহসের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু তার চেয়েও প্রয়োজনীয় হলো বিচক্ষণতার প্রয়োগ। অর্থাৎ যে সাহসের সঙ্গে বিচক্ষণতার মেলবন্ধন হয় সেটিই হবে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সর্বোত্তম কর্মসূচি।

আমার ছোট অরাজনৈতিক বুদ্ধিতে, শুধুমাত্র দেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমাধানের কথা বলছি। প্রথমত, যে কোন দেশের জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো হচ্ছে পৃথিবীতে রাষ্ট্র হিসেবে অবস্থানের সুনিশ্চিত অঙ্গিকার। তাই যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত এবং ভারতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নীতি, সবার সঙ্গে মিত্রতা, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়, এই নীতিটি বিচক্ষণতার সঙ্গে অনুসরণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংবিধান থেকে সরে আসা যাবে না। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজেই একটি অনির্বাচিত সরকার, এবং ২০০৭ সালে তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর শাসনে ছিল; আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলে সেটা কতো বছর কাটায় তার কোন নিশ্চয়তা থাকবে না। তৃতীয়ত: সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের নেতৃত্বে থাকুক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই, তবে তিনি মন্ত্রীসভার কিছু মন্ত্রীত্ব বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে বণ্টন করতে পারেন, এক্ষেত্রে নির্বাচিত সংসদ সদস্য  হতে হবে এমন কোন কথা নেই। এমনকি এই নির্বাচনকালীন মন্ত্রীসভা বিচক্ষণতার সঙ্গে গঠিত করে এমন একটি সরকার গঠন করতে হবে যেখানে শুধু যে রাজনৈতিক নেতৃবর্গ থাকবেন তা নয়, রাজনীতির বাইরের যোগ্য লোকও থাকতে পারেন। অর্থাৎ এমন এমন লোককে দিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করতে হবে যারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ব্যাপারে যৌক্তিক ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারবে। এবং চতুর্থত নির্বাচন কমিশনকে বিচারিক ক্ষমতা ও একজিকিইটভ ক্ষমতা দেবার পরও বিশৃক্সক্ষলা হলে যে কোন নির্বাচন কেন্দ্রকে আংশিক বা পূর্ণাঙ্গভাবে রদ করার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। পঞ্চমত আইন-শৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে কোনরকমের প্রভাব ছাড়া কাজ করতে পারে সে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এবং ষষ্ঠত এখন থেকে দমননীতি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে একটি সহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত হয়।

উপরোক্তভাবে কিছু পদক্ষেপ নিলে কক্সবাজার রেলযাত্রা সুখদ ভ্রমণে পরিণত হবে।

লেখক : সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ