কক্সবাজারে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ করবেন না

আধুনিক পর্যটননগরী গড়তে মাস্টারপ্ল্যান হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কক্সবাজারকে আধুনিক পর্যটননগরী হিসেবে গড়ে তুলতে জেলার সার্বিক উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান করা হচ্ছে। তাই যেখানে- সেখানে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। একই সঙ্গে দেশের সবচেয়ে আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন সম্মেলন কেন্দ্রটিও কক্সবাজারে নির্মাণ করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
গতকাল কক্সবাজার নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নবনির্মিত বহুতল অফিস ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফান্সে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
কক্সবাজারের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাঠে অনুষ্ঠিত ভিডিও কনফারেন্সে বাংলাদেশকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতু উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের বিমানবন্দরটি হবে আন্তর্জাতিক আকাশপথের রিফুয়েলিং সেন্টার।’
কক্সবাজারকে পর্যটননগরী হিসেবে গড়ে তোলা ‘একান্তভাবে অপরিহার্য’ উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেজন্য কক্সবাজারবাসীর কাছে আমার একটা অনুরোধ থাকবে যেখানে-সেখানে, যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে কোনো স্থাপনা আপনারা করবেন না। ইতোমধ্যে আমরা কক্সবাজারে কিন্তু অনেক প্রকল্প নিয়েছি। একটা মাস্টারপ্ল্যান করার নির্দেশ দিয়েছি, পুরো কক্সবাজারটাকে ঘিরে। এ উন্নয়নটা যেন অপরিকল্পিতভাবে না হয়ে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী হয়।
‘এই যে আমাদের বিশাল সমুদ্রসীমা রয়েছে, এতে পর্যটন ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করা, আমাদের দেশীয় পর্যটকদের যেমন সুযোগ সৃষ্টি করা, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করা- সেই উদ্যোগটা আমরা নিতে যাচ্ছি।’
কক্সবাজার হবে আন্তর্জাতিক রিফুয়েলিং সেন্টার
বিমান চলাচলের আন্তর্জাতিক আকাশপথটি কক্সবাজারের ওপর দিয়ে গেছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার কাজ চলমান রয়েছে। কক্সবাজারে হবে আন্তর্জাতিক আকাশপথে রিফুয়েলিংয়ের একটা জায়গা। যার ফলে এখানে অনেক কাজ হবে।’
সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি বিমান চালু হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি, আমাদের অন্যান্য অঞ্চল যেমন- বরিশাল, রাজশাহী, সৈয়দপুর- এ রকম যতগুলো বিমানবন্দর আছে, সব বিমানবন্দর থেকে কক্সবাজারে সরাসরি বিমান চলাচল করে, তার ব্যবস্থাটাও আমরা করে দেব ভবিষ্যতে। যাতে পর্যটকও বাড়বে, সব বাড়বে।’
দৃষ্টিনন্দন সম্মেলন কেন্দ্র
ঢাকায় নয়, দেশের সবচেয়ে আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন সম্মেলন কেন্দ্র বা কনভেনশন সেন্টারটি কক্সবাজারে তৈরি করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘সব থেকে ভালো কনভেনশন সেন্টার, উন্নতমানের কনভেনশন সেন্টার এই কক্সবাজারে করা হবে। অন্য কোথাও না, রাজধানীতে না।
‘আমি চাই কক্সবাজারে হবে এটা, যাতে পর্যটকদেরও আকর্ষণ করবে আর আমাদের যেকোনো সেমিনার, যা কিছু আমরা করি, সেখানে আমরা করব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান এই অবস্থানটা হচ্ছে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনা করবার মতো জায়গা। এ জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলতেন, বাংলাদেশটাকে তিনি প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন।
‘সুইজারল্যান্ড শান্তির দেশ, সেই সঙ্গে ইউরোপের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যেতে হলে সুইজারল্যান্ড হয়েই যেতে হয়। তার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে এভাবেই গড়ে তুলবেন।’
সুনীল অর্থনীতি
সমুদ্রসীমায় নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন এই সমুদ্রসম্পদ আমাদের ব্যবহার করে আমাদের অর্থনীতিতে যাতে অবদান রাখতে পারে, সেই ব্যবস্থাটা আমরা করতে চাই। তাই আমরা ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি গ্রহণ করেছি। এর ভিত্তিতে উন্নয়নকে আমরা আরও ত্বরান্বিত করতে চাই।’
মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটিকে ডিজিটাল আইল্যান্ড হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে মহেশখালীর উন্নয়নটা যখন দেখবেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে, সবাই বিস্মিত হবেন যে এ রকম উন্নয়ন করা যায়।’
টেকনাফের জন্যও বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং টেকনাফের সমুদ্রসৈকত যাতে আন্তর্জাতিক মানের হয় তারও ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি।’
সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেখানে সি অ্যাকোরিয়াম যাতে হয়, তার ব্যবস্থা আমরা নেব। যদিও এটা খুব ব্যয়বহুল এবং অ্যাকোরিয়াম চালানোর মতো দক্ষ লোকের অভাব আছে আমাদের দেশে। কাজেই সেটা আমাদের দেখতে হবে, তৈরি করতে হবে।’
অবকাঠামো উন্নয়ন
কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন দোহাজারি থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। চমৎকার একটা রেল স্টেশন, খুব আকর্ষণীয় একটা রেল স্টেশন নির্মাণ হয়েছে। এর কাজ খুব দ্রুত শেষ হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম যেমন মহাসড়ক তৈরি করে দিয়েছি, আবার কক্সবাজার পর্যন্ত রাস্তার কাজও চলছে।’
উন্নয়নের সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করার অনুমোদন আমরা দিয়েছি। এখানে একটি মেডিক্যাল কলেজ করা হয়েছে, একটি হাসপাতালও করা হবে। স্টেডিয়ামগুলোকে আরও উন্নতমানের করব, যাতে আন্তর্জাতিক মানের খেলা হয়।’

খুরুশকুলে একটি আধুনিক শুঁটকির হাট করার পরিকল্পনার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ যেটি দৃষ্টিনন্দন হবে। আর সেখানে যারা মৎস্যজীবী যারা মাছ ধরবেন, শুঁটকি করবেন তারা বাজারজাত করতে পারবেন।’
লবণ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের চাহিদা মিটিয়ে শীতপ্রধান দেশগুলোতে রপ্তানির সুযোগ তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কক্সবাজারের লবণচাষিদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ারও নির্দেশনা দেন তিনি। কোরাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন রক্ষা ও নিরাপত্তায় বিশেষ দৃষ্টি দেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ঝাউবন
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূল ও সমুদ্রসৈকত রক্ষায় ঝাউবন তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এই সমুদ্রসৈকতে আমার অনুরোধ থাকবে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ছাড়াও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আছেন, আমাদের যুবসমাজ আছে, সামনে আষাঢ় মাস, আষাঢ় মাসে আমরা বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নিই।
‘এই সমুদ্রসৈকত পুরোটা যদি আমরা ঝাউগাছ দিয়ে ঘিরে দিতে পারি তাহলে যেকোনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।’
৮০ মাইল বা ১২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকাজুড়ে ঝাউবন করা খুব কঠিন কাজ হবে না বলেও মনে করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবেশটা রক্ষা করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিবেশ যেন রক্ষা পায় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
করোনাকালে উপকার
করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে ধস নামলেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় উপকার হয়েছে বলে মনে করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে এটা ঠিক। একটা উপকার আমরা পেয়েছি। যেহেতু কোনো পর্যটক সেখানে যেতে পারেনি, কক্সবাজারে হারিয়ে যাওয়া লাল কাঁকড়া সেগুলো যেমন ফিরে এসেছে, কিছুদিন ডলফিনও দেখা গেছে।
‘আমাদের কাছিমগুলোর প্রজননক্ষেত্রের জন্য যে পাড়গুলো ছিল, সেগুলোও হারিয়ে যাচ্ছিল। যখন সেখানে কেউ যাচ্ছিল না, খবর পেলাম, কিছু ছবিও দেখলাম লাল কাঁকড়াগুলো আবার ফিরে এসেছে।’
করোনাকালীন অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।