এলএনজি টার্মিনাল : গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সময়োপযোগী পদক্ষেপ

ড. মো. মোরশেদুল আলম »

গ্যাস সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে সরকার ২০১০ সালে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ মহেশখালীতে প্রথম ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে বহুজাতিক কোম্পানি এস্ট্রা ওয়েল অ্যান্ড এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে ‘টার্মিনাল ইউজ এগ্রিমেন্ট’ এবং ২০১৪ সালের ২৬ জুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করেছিল প্রেট্রোবাংলা। সমুদ্রে ভাসমান জাহাজ থেকে স্থলভাগে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আনা হবে। চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্যিকভাবে এ টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরুর পর ১৫ বছর তা অব্যাহত থাকবে। টার্মিনাল নির্মাণ, গ্যাসের হুইলিং ও অন্যান্য খরচ হিসেবে এক্সিলারেট এনার্জিকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের জন্য ৫৯ সেন্ট পরিশোধ করতে হবে। ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল মহেশখালীর অদূরে বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়া দ্বীপের জিরো পয়েন্টে এলএনজি বোঝাই ভাসমান টার্মিনাল ‘এক্সিলারেট’ ও ৫টি পোর্ট সার্ভিস ভেসেল নোঙর করেছিল। সার্ভিস ভেসেলগুলোর মধ্যে একটি ব্যবহৃত হবে টার্মিনালের জ¦ালানি পরিবহনে এবং অপরটি টার্মিনালে নিয়োজিতদের আনা-নেওয়াসহ তাদের রসদ সরবরাহে নিয়োজিত থাকবে। অপর তিনটি টাগবোট থাকবে ভাসমান টার্মিনালের সঙ্গে। ভাসমান টার্মিনালটি আসার সময় কাতার থেকে এলএনজির প্রথম চালানটি নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ও কাতার সরকারের মধ্যে বছরে ২.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি সরবরাহের চুক্তি রয়েছে। এর উদ্বোধনী চালানটি নিয়ে মহেশখালীর নিকটে বঙ্গোপসাগরে এক্সিলারেট নোঙর করেছিল। সেখান থেকে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে পরীক্ষামূলকভাবে আনোয়ারা পর্যন্ত এবং ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট পাইপ লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রতি মাসে এলএনজি নিয়ে জাহাজ এসে টার্মিনালে খালাস করে ফিরে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে এ ব্যাপারে ১৫ বছরের চুক্তি রয়েছে। দৈনিক ৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের ক্ষমতাসম্পন্ন এই টার্মিনাল তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ১৫৬ কোটি মার্কিন ডলার।
কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়িতে হচ্ছে দেশের প্রথম স্থলভিত্তিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ল্যান্ডবেজড এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনাল। এ টার্মিনালটির গ্যাস রূপান্তরের সক্ষমতা হবে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। জ¦ালানি ঘাটতি মেটাতে সরকার আমদানি করা গ্যাসের ওপরই নির্ভর করে। দেশীয় ও আমদানি মিলে সরবরাহ গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় মজুত থেকে দৈনিক ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সালে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে মোট ৫৬০ কোটি ঘনফুট হতে পারে। নতুন মজুত আবিষ্কৃত না হলে দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ কমে ১০০ কোটি ঘনফুটের নিচে নামতে পারে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে তখন এলএনজির আমদানি বৃদ্ধি করতে হবে। এমন প্রয়োজন থেকেই সরকার এলএনজি টার্মিনাল করার পরিকল্পনা করেছে। ২০১৫-২০১৬ সালে স্থলভাগে টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পেট্রোবাংলার তত্ত্বাবধানে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
আমদানি করা এলএনজি আনা হয় জাহাজে করে। এরপর তা গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে হয়। এর জন্য মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল আছে। এর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি একটি এবং দেশীয় সামিট গ্রুপ আরেকটি পরিচালনা করছে। এ দুই টার্মিনাল দিয়ে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১০০ কোটি ঘনফুট। তবে গড়ে দৈনিক সরবরাহ করা হয় ৮০ কোটি ঘনফুট। এখন মহেশখালীতেই দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার তৃতীয় ভাসমান টার্মিনাল স্থাপনের কাজ পেয়েছে সামিট গ্রুপ। পটুয়াখালীর পায়রায় হবে চতুর্থ ভাসমান টার্মিনাল। আমদানি করা গ্যাস পুনরায় গ্যাসীকরণের জন্য বর্তমানে চালু দুটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনালের পাশাপাশি আরও তিনটি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, প্রস্তাবিত তিনটি নতুন এলএনজি টার্মিনাল পায়রা, মহেশখালী ও মাতারবাড়িতে স্থাপন করা হবে; যার মোট রিগ্যাসিফিকেশন ক্ষমতা হবে ২ থেকে ৩ হাজার এমএমসিএফ/ডি। তিনি আরও জানান, নতুন তিনটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে দুটি হবে ভাসমান; যা ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) নামে পরিচিত। আর অপরটি হবে ভূমিভিত্তিক টার্মিনাল। দুটি ভাসমান স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট ২০১৮ সাল থেকে চালু হয়েছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করে ইউএসএ এর এক্সিলারেট এনার্জি ও সামিট গ্রুপ। পায়রা ও মহেশখালীর প্রতিটি এফএসআরইউ’র ৫০০ থেকে ১ হাজার এমএমসিএফ/ডি গ্যাস পুনরায় গ্যাসীকরণ করার ক্ষমতা থাকবে। দেশে গ্যাসের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ হাজার ৫০০ এমএমসিএফ/ডি-তে পৌঁছাবে।
চট্টগ্রামে নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন ও বিদ্যমান কারখানা সম্প্রসারণ বন্ধ ছিল শুধু গ্যাস সংকটের কারণে। এ অবস্থায় এলএনজি আমদানি করে সরবরাহের সরকারি সিদ্ধান্তে শিল্প-কারখানা মালিক ও উদ্যোক্তারা আশান্বিত হয়েছেন। প্রাকৃতিক গ্যাস সাধারণ চাপ ও তাপমাত্রায় গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। শীতলকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে তাপমাত্রা কমিয়ে আনলে তা তরলে পরিণত হয়। এ তরল প্রাকৃতিক গ্যাসই হলো (লিকুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) এলএনজি। যখন তরল করা হয় তখন প্রায় ৬০০ গুণ আয়তন কমে যায়। অর্থাৎ ৬০০ লিটার গ্যাস এলএনজিতে রূপান্তরিত করার পর তা এক লিটারের বোতলে ভরা যায়। আপাতত চট্টগ্রামে এ গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। পাইপ লাইনের কাজসহ সব ধরনের নিরাপত্তা প্রস্তুতি শেষ হলে জাতীয় গ্রিডেও সরবরাহ শুরু হবে এলএনজি। এ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে আনোয়ারা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলছে। আপাতত প্রতিদিন ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট করে এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। একটি জাহাজে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার মিলিয়ন বা ২০০ থেকে ২৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আনা সম্ভব। এ তরল গ্যাস আবার স্বাভাবিক গ্যাসে পরিণত করতে এলএনজি টার্মিনালের সঙ্গে রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট স্থাপন করেছে এক্সিলারেট। এর মাধ্যমে তরল গ্যাসকে স্বাভাবিক গ্যাসে রূপান্তরিত করে তা পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। সংকট কাটাতে আনোয়ারা থেকে শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সিইউএফএল ও কাফকো সার কারখানার জন্য সরাসরি পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস আনতে মহেশখালী-আনোয়ারা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশে দৈনিক ৩৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে ২৭৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। অর্থাৎ দৈনিক ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এ সংকট ক্রমেই বাড়ছে। আর এ ঘাটতি দূর করতে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। কাতারের রাসগ্যাস বছরে ২৫ লাখ টন এলএনজি সরবরাহ করার বিষয়ে পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। পাশাপাশি ওমান থেকে এলএনজি আমদানির জন্য ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়েছে। এলএনজি আমদানির জন্য কাতার এবং সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে জিটুজি চুক্তি হয়েছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গেও জিটুজি ভিত্তিতে এলএনজি আনতে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি দেশের ২৬টি কোম্পানির কাছ থেকে স্পট মার্কেটিং ভিত্তিতে খোলাবাজার থেকে এলএনজি ক্রয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য পেট্রোনেট ইন্ডিয়া, এইচওসি চায়না, সেম্বগ্রুপ সিঙ্গাপুর, পায়রা ও মহেশখালীতে মোট ৫টি স্থানে টার্মিনাল করছে। জাতীয় গ্রিডে এলএনজি যুক্ত হওয়ার পর ২ হাজার ৩৯০টি শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সংযোগ দেওয়া সম্ভব হবে। জাইকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রথম এ এলএনজি টার্মিনাল চালু হওয়ায় চাহিদার ১৭ শতাংশ পূরণ হবে। ২০২৩ সাল নাগাদ জাতীয় গ্রিডে মোট গ্যাসের ৪০ শতাংশ, ২০২৮ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ ও ২০৪১ সাল নাগাদ ৭০ শতাংশ এলএনজি থেকে সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে। চাহিদা মোতাবেক গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হলে নতুন করে প্রায় ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে; যা দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখবে।
মাতারবাড়ীসহ সমগ্র মহেশখালীকে ঘিরে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। এখানে গড়ে তোলা হচ্ছে জ¦ালানি তেল টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক সর্বাধুনিক প্রযুক্তির তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং গভীর সমুদ্রবন্দর। মাতারবাড়ীর মেগাপ্রকল্পের মূল অবকাঠামো নির্মাণে সহযোগিতা করছে জাপান। সবগুলো প্রকল্প ও মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজারসহ সমগ্র দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়