একুশের প্রথম কবিতা

ড. ইলু ইলিয়াস »

বাঙালির জাতীয় জীবন-ইতিহাসের এক অনন্য তাৎপর্যমণ্ডিতঅধ্যায় অমর একুশে। অমর একুশের রক্ত-উজ্জ্বল দ্রোহী চেতনার অভিঘাতেই উৎসারিত ও বিকশিত হয় বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা, সংঘটিত হয় স্বাধিকার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র-বাংলাদেশ। এবং একুশের অনির্বাণ চেতনার সতত সঞ্চরণেই স্বাধীনতা-উত্তর নানামাত্রিক বিসর্পিল সময় ও  স্রোতকে অতিক্রম করে বাঙালি সমুন্নত শিরে এগিয়ে যেতে থাকে বর্ণিল ভবিষ্যৎ অভিমুখে। এভাবে একুশ হয়ে ওঠে বাঙালির জাতীয় জীবনের সমুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের এক অফুরন্ত উৎস। ফলে একুশের অনিবার্য প্রতিফলন ঘটে সাহিত্যে- আজ সত্তর বছরের প্রান্তসীমায় দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল বহু কবিতা ও গল্প, কয়েকটি উপন্যাস ও নাটকের সমন্বিত অনন্য তাৎপর্যমণ্ডিত এক সাহিত্যধারা-একুশের সাহিত্য। আর এই মহান একুশের সাহিত্যের প্রথম সৃষ্টি, প্রথম প্রসূন একটি কবিতা- ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’
একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ এক ঐতিহাসিক মহামুহূর্তের রচনা, রচিত হয় একুশের রাতে চট্টগ্রামে, রচয়িতা মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন নিবেদিনপ্রাণ সক্রিয় সংগঠকÑ চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক। চট্টগ্রামে একুশের কর্মসূচিকে শতভাগ সাফল্যম-িত করে তোলার সুদৃঢ় অভিপ্রায় থেকে দিনরাতের অবিরাম শ্রমের ফলে একুশের আগেই তিনি মারাত্মক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় একুশের কর্মসূচি পালনকালে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হত্যাকা-ের খবর পেয়ে তিনি এতটাই ক্রোধান্বিত ও আবেগ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন যে, নিজের শারীরিক অসামর্থের কথা ভুলে গিয়ে কাগজ-কলমের খোঁজ করছিলেন কিছু লেখার জন্য। কিন্তু জ্বরের তীব্রতায় হাতের প্রবল কম্পনে যখন নিজহাতে লেখা সম্ভব হচ্ছিল না তখন অনর্গল উচ্চারণ করে যান রাশি-রাশি শব্দবুলেট। আর তা সাথে সাথেই লিপিবদ্ধ করে নেন তাঁদের একজন কর্মচারী মার্কসবাদী রাজনীতির নিবেদিতকর্মী ননী ধর। এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারি রাতেই চট্টগ্রামে রচিত হয় সহস্র বুলেটের চেয়েও অধিক শক্তিময় অমিতস্পর্ধিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’।
কবিতাটি প্রকাশের আলোয় আসার আগেই জব্দ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে পাক সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ। ২২ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে আন্দরকিল্লাস্থ কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে কবিতাটির যখন মুদ্রণ কাজ চলছিল তখন সেখানে হানা দেয় গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু প্রেসের কর্মচারীদের সংগ্রামদীপ্ত প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে যায় পুলিশি অভিযান। কবিতাটি মুদ্রিত ও বাঁধাই হয়ে প্রকাশিত হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি চৌধুরী হারুনর রশীদ কর্তৃক পঠিত হয় লালদিঘির বিশাল প্রতিবাদ সভায়। সাথে সাথেই আমূল কেঁপে ওঠে স্বৈরাচারী পাক সরকারের মসনদ। ভীতসন্ত্রস্ত পাক সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, প্রতিবাদ সভায় কবিতাটির পাঠক চৌধুরী হারুনর রশীদ, প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ বি.এ ও মুদ্রাকর দবির আহমদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে জারি করে গ্রেফতারি পরওয়ানা। এবং দ্রুত গ্রেফতার করা হয় চৌধুরী হারুনর রশীদ ও মুদ্রাকর দবির আহমদ চৌধুরীকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয় কবিতাটির, পরাজয় ঘটে পাক সরকারের।
সুদীর্ঘ কালের নিষেধাজ্ঞার ফলে এক সময় কবিতাটি সম্পূর্ণরূপে লোকলোচনের আড়ালে চলে যায়। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তাঁর ভাষা-আন্দোলন ও শহীদ মিনার গ্রন্থটি পরিকল্পনাকালে কবিকে অনুরোধকরেন স্মৃতি থেকে কবিতাটির কিছু শব্দ ও পঙক্তি উচ্চারণের জন্য। এতে কবি সম্মত হন। এভাবে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত উক্ত গ্রন্থে মুদ্রিত হয় কবির স্মৃতি থেকে উদ্ধারকৃত কবিতাটির কথিত‘কিছু অংশ’। আরও ছয় বছর পর কবিতাটি সম্পর্কে কিছু বলার জন্য কবিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। কবি বললেন কবিতাটিসম্পর্কে তাঁর অন্তর্গত আবেগস্পন্দিত আনন্দ-বেদনার বর্ণিল কথকতা এবং বললেন, কবিতাটি এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না, হারিয়ে গেছে। ধানম-ির বাসায় টেলিভিশন সেটের সামনে বসে কবির একথা শোনামাত্র স্কুলশিক্ষক মনজুরা বেগম স্বগতস্বরে বলে ওঠে, ‘না, কবিতাটি হারিয়ে যায়নি, আমার কাছে আছে। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমি সযতেœ সংরক্ষণ করে যাচ্ছি কবিতাটি।’
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাক সরকারের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল তল্লাশির সময় অন্যান্য্য কাগজপত্রের সাথে দু’দিন আগে নিষিদ্ধ হওয়া ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শিরোনামের একুশের প্রথমকবিতা-পুস্তিকাটিরও একটি কপি পেয়ে যান পুলিশ কর্মকর্তা মীর আশরাফুল হক। কবিতাটি তিনি দ্রুত বিনষ্টি থেকে রক্ষা করে সযতেœ লুকিয়ে রাখেন নিজের কাছে। অতঃপর বাসায় ফিরে তাঁর স্ত্রী জোবেদা হকের কছে গচ্ছিত রাখেন বাঙালি জাতির এই অনন্য সম্পদ। কিছুদিন পর জোবেদা হক তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তা ও কবিতাটির সুরক্ষার কথা ভেবে লক্ষ্মীপুরে গিয়ে তাঁর ননদ মনজুরা বেগমের কাছে রেখে আসেন। সেই থেকে পরম মমতায় অসীম আবেগে কবিতাটি তিনি সংরক্ষণ করেআসছেন। মনজুরা বেগমের জবানীতে আমরা এও জানতে পারি যে, প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বোনেরা সম্মিলিতভাবে পাঠ করতেন কবিতাটি। ফলে, এক পর্যায়ে মুদ্রিত পুস্তিকায় কবিতার লেখা ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া শুরু হলে সমগ্র কবিতাটি স্বহস্তে ডায়রিতে লিখে রেখেছিলেন। কবি যখন টেলিভিশনে বললেন কবিতাটি হারিয়ে গেছে, তখন পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সংরক্ষণ করা বাঙালি জাতির এই অমূল্য সম্পদের- তাঁর ডায়রিতে লিখিতরূপের একটি ফটোকপি কবির কাছে পৌঁছে দেন তখনকার তরুণ সংস্কৃতিকর্মী, লেখক মফিদুল হক। উল্লেখ্য যে, পুলিশ অফিসার মীর আশরাফুল হক ও জোবেদা হক হলেন মফিদুল হকের পিতা-মাতা এবং মনজুরা বেগম হলেন তাঁর ফুফু।
অতঃপর ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে অভিন্ন শিরোনামে প্রকাশিত কবির কাব্যগ্রন্থে একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ পুনর্মুদ্রিত হয়ে লোকলোচনের সামনে আসে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, প্রশ্ন জেগেছিল গবেষক অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হকেরও মনে, এটি কি মূলকবিতা? কারণ ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে কবিতাটি পুনঃপ্রকাশকালে গ্রন্থে মুদ্রিত কবি ও প্রকাশকের বিপরীত ভাষ্য। কবি বলেছেন, ‘কিছুদিন আগে প্রীতিভাজন মফিদুল হকের সৌজন্যে আমি কবিতাটির মূল অংশটি পেয়ে যাই।’ অন্যদিকে গ্রন্থটির প্রকাশক বলেছেন ‘১৯৫২ সালে দশম শ্রেণির ছাত্রী মনজুরা বেগম ভাগ্যক্রমে এ কবিতার অংশবিশেষ পেয়ে যান।’
তবে এটিই মূলকবিতা কিনা সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় চার বছর পর ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে গবেষক অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হকেরই কল্যাণে। চৌধুরী জহুরুল হক তাঁর নিবিড় সন্ধান তৎপরতায় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মূলকবিতা-পুস্তিকাটির একটি কপি পেয়ে যান ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের স্বত্বাধিকারী ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের ছোটভাই আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমের কাছে। এবং তা ‘চল্লিশ বছর পরে আরেক ফাল্গুনে একুশের কবিতার পুনর্পাঠ’ শিরোনামে প্রকাশ করেন ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক আজাদীর একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। তাতে দেখা যায় যে, মনজুরা বেগমের কল্যাণে প্রাপ্ত ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত কবির গ্রন্থভুক্ত কবিতাটি প্রকাশক কথিত ‘অংশবিশেষ’ নয়, মূল কবিতাই। তবে তাতে ছয়টি পঙক্তি মুদ্রিত হয়নি এবং পঙক্তি ও স্তবকবিন্যাসে রয়েছে নানা বিচ্যুতিÑ বিচ্যুতি ঘটেছে কিছু শব্দ ও যতিচিহ্ন প্রয়োগেও।
কবিতাটির আরও ভয়ঙ্কর ভুলের পসরা সাজিয়ে রেখেছে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অভিভাবক প্রতিষ্ঠান স্বয়ং বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করে একুশের দ্বিভাষিক সংকলন ‘একুশের কবিতা POEMS ON 21st’-এ মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ মুদ্রিত হয়নি। কারণ তখনও কবিতাটি পাওয়া যায়নি। কিন্তু ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে সংকলনটির প্রথম পুনর্মুদ্রণ কালেও কবিতাটি মুদ্রিত হয় ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয় ঘটিয়ে।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম কর্তৃক কবির স্মৃতি থেকে উদ্ধারকৃত ঊনত্রিশ পঙক্তির মধ্যে এক থেকে আটাশতম পঙক্তি পর্যন্ত মুদ্রিত হয়েছে ১৮ নম্বর পৃষ্ঠায় এবং ঊনত্রিশতম পঙক্তিটি মুদ্রিত হয় ২২ নং পৃষ্ঠায়। অতঃপর মূল কবিতাটি এর সঙ্গে একীভূত হয়ে ২২ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে ধারাবাহিকভাবে ২৪ নং পৃষ্ঠায় পৌঁছে আবার যেন নাটকের পশ্চাক্ষেপণী রীতিতে বা ফ্ল্যাশব্যাকে ছুটে যেতে হয় ২০ নম্বর পৃষ্ঠায় এবং অবশেষে সেখান থেকে উড়াল দিয়ে ২৬ নং পৃষ্ঠায় পৌঁছে সম্পন্ন করতে হয় কবিতাটির পূর্ণপাঠ! অন্যথায় কবিতাটির পাঠযোগ্যতা সম্পূর্ণ রূপেই বিনষ্ট হয়ে যায়। উপরন্তু কবিতাটিরি শরোনাম লেখা হয়েছে ‘একুশের প্রথম কবিতা’ এবং ইংরেজি অনুবাদে ‘THE FIRST POEM ON EKUSHEY এছাড়াও ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে রচিত ভূমিকার ভুলও সংশোধিত হয়নি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের মুদ্রিত ভূমিকায়। সেখানে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের মতো ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দেও লেখা আছেÑ ‘একুশের উপর লেখা প্রথম কবিতা সম্ভবত ‘আমরা এখানে কাঁদতে আসিনি’।১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ কলরবে প্রকাশিত বাংলা একাডেমির একুশের কবিতা সংকলনেও কবিতাটির মূলরূপটি স্বতন্ত্রভাবে এর ঐতিহাসিক ও শৈল্পিক প্রতিন্যাসে মুদ্রিত হয়নি।
উল্লেখ্য যে, ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে কবিতাটির মুদ্রিত মূলপাঠ উদ্ধারের পর ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ থেকে জমতে থাকা কবিতাটি সম্পর্কিত এরূপ আরও বহুবিধ ভুলভ্রান্তি অপনোদনপূর্বক কবিতাটির আদি ও অবিকল পাঠ এবং কবির অনুমোদনক্রমে সম্পাদিত পূর্ণপাঠনসহ ‘প্রসঙ্গ : একুশের প্রথম কবিতা’ শীর্ষক একটি অসাধারণ গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেন গবেষক অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হকÑ যা প্রকাশিত হয় ২০০২ খ্রিস্টাব্দে কোহিনূর প্রকাশন, চট্টগ্রাম থেকে।
অতঃপর জানা যায় পুস্তিকাটি ছিল ডিমাই ১/৮ সাইজের ৮ পৃষ্ঠার। প্রচ্ছদে মূদ্রিত হয় কবিতার শিরোনাম, কবির নাম ও দাম : দু’আনা; দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় কামাল উদ্দিন আহামদ খান- এর নামে মুদ্রিত হয়েছে মুখবন্ধ, তৃতীয় পৃষ্ঠা থেকে শুরু হয়ে কবিতাটি সমাপ্ত হয়েছে অষ্টম পৃষ্ঠায় এবং যেখানে কবিতাটি সমাপ্ত হয়েছে তার নিচে লেখা আছে ‘প্রকাশক- কামাল উদ্দিন আহমদ বি.এ, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস হইতে মুদ্রিত।’ ছয় পৃষ্ঠাব্যাপী এই দীর্ঘ কবিতাটির স্তবক সংখ্যা ছয় এবং পঙক্তি সংখ্যা একশত বিশ।
মাহবুবউলআলম চৌধুরীর এই কবিতাপাঠ করতে-করতে আমার মনে পড়ে যায় কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কথা। যেখানে আবহমান বাংলা গীতিকবিতার প্রবহমান ব্যক্তিক অনুভূতির অন্তর্মুখী অভিপ্রকাশকে অতিক্রম করে কবি যেন নির্দেশ করছেন উপনিবেশের নির্জিত জনসাধারণকে সর্বপ্রকার ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতা ও ক্লীবত্ব ঝেড়ে ফেলে দুর্জয় বীরত্বে দীপ্তিময় হয়ে ওঠার অমিত স্পর্ধিত মন্ত্র পাঠেরÑ ‘বলবীরÑ/ বল উন্নত মম শির।‘
মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে আমি অভিহিত করতে চাই, নজরুলের এই অসামান্য আত্মমর্যাদাবোধ স্পন্দিত দ্রোহীদীক্ষার প্রথম ও শ্রেষ্ঠতম বীর আর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ সেই বীরত্বেরই অভিপ্রকাশক প্রথম ও শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যস্মারক।
তবে কবিতাটির আঙ্গিক বিনির্মাণে তিনি চিলির কবি পাবলো নেরুদার দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে ধারণা করা যায়। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পাবলো নেরুদা যখন দিল্লি আসেন তখন তাঁর সঙ্গে বিশ্বশান্তি পরিষদের কার্যক্রমসূত্রে সাক্ষাৎ হয় মাহবুব উল আলম চৌধুরীর এবং নেরুদা তাঁর ‘রেসিডেন্স অন আর্থ’ অর্থাৎ ‘মর্তে বসবাস’ গ্রন্থটি তাঁকে উপহার দেন। অনতিকাল পরে সেই উপহারটিই যেন রূপান্তরিত হয়ে যায় কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর কণ্ঠহারে।
বায়ান্নের একুশের নির্মম হত্যাকা-ের পর থেকে আজ অবধি একুশের চেতনাস্নাত সংগ্রাম-উজ্জ্বল অনেক কবিতাই রচিত হয়েছে, এমনকি অধিকতর শিল্পিত কবিতাও। কিন্তু একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’তে বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যস্নাত মানবিক মমত্ববোধ, বিজ্ঞান ও শিল্পের সমন্বিত মাঙ্গলিক জীবন স্বপ্নের অন্তর্গত বিপুল বিচিত্র বর্ণময় আবেগ ও দুর্নিবার সংগ্রামশীলতার যে দূরস্পর্শী সামগ্রিক বোধের অভিপ্রকাশ ঘটেছে তা অন্যত্র বিরল। শুধু তাই নয়, এই কবিতার অন্তিম স্তবকে উচ্চারিত হয়েছে স্বাধীনতার স্বপ্নপ্রত্যয়ওÑ

খুনি জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত
কোনোদিনও চেপে দিতে পারবে না
তোমাদের সেই লক্ষ দিনের আশাকে,
যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব
ন্যায়-নীতির দিন
হে আমার মৃতভাইরা,
সেইদিন নিস্তবদ্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে আসবে
সেইদিন আমার দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।

বায়ান্নে উচ্চারিত কবির এই স্বপ্নপ্রত্যয় সত্য হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে।
অর্থাৎ, একুশের প্রথম কবিতায় আবহমান বাংলা গীতিকবিতার দুর্দমনীয় ‘আমি’র তথা ব্যক্তি সত্তার বিপরীতে দীপ্তিময় হয়ে ওঠে ‘আমরা’ তথা সামষ্টিক চেতনা Ñ যার উৎক্ষেপণে নির্মিত হয় বাঙালির স্বাদেশিক বোধ, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতার স্বপ্ন-প্রত্যয়, রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন স্বদেশ। একুশোত্তর বাংলাসাহিত্যে এসব অনুষঙ্গে সামষ্টিক স্বর, সামবায়িক চেতনার অভিপ্রকাশই হয়ে ওঠে এক অনিবার্য কিংবা আরাধ্য বিষয়। এইভাবে বাঙালির জাতীয় জীবন ইতিহাসে বীরের রক্ত আর মায়ের অশ্রুসিক্ত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি করে সামষ্টিক চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালির স্বদেশচেতনা ও জাতীয়তাবাদ স্পন্দিত দ্রোহী দীপান্বিত এক নতুনধারাÑএকুশের সাহিত্য।
অপরিমেয় বেদনার সাথে বলতে হয় এমন মহৎ ও ঐতিহাসিক এই কবিতাটির শুদ্ধরূপ আজও বাংলা একাডেমিতে গৃহীত হয়নি। বাংলা একাডেমির একুশের কবিতা (১৯৯৯) সংকলনে এখনও বহাল থেকে যায় কবিতাটির সেই ভুল ও বিন্যাস বিপর্যস্ত রূপটি; এখনও শহীদ স্মরণে একুশের প্রথম প্রহরে ও প্রভাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে শহীদ মিনারের পাদদেশ থেকে খ্যাতিমান আবৃত্তিকার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ ও অধ্যাপক মহোদয়ের কণ্ঠে একুশের প্রথম কবিতারূপে উচ্চারিত হয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম কর্তৃক কবির স্মৃতি থেকে উদ্ধারকৃত ঐ সামন্য অংশই যা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র কোনও পঙক্তি-স্তবকের অংশও নয়।
গবেষক অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক কর্তৃক একুশের প্রথম কবিতার মূলরূপ উদ্ধারের আজ তিন দশক এবং ঐ কবিতাটি সম্পর্কিত তাবৎ তথ্যসহ সমুদয় ভ্রান্তি অপনোদন পূর্বক কবিতাটির আদি ও অবিকল পাঠ এবং কবির অনুমোদনক্রমে সম্পাদিত (বানানজনিত) পূর্ণপাঠসমেত গবেষণাগ্রন্থ ‘প্রসঙ্গ: একুশের প্রথম প্রথম কবিতা’ প্রকাশের দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে এখনও ভাবান্তর ঘটেনি।
আমাদের এই দীনতা আর কত প্রবলম্বিত হবে? আমরা কি শুধুই নিজেদের গৌরবগাথা হারিয়ে ফেলার আক্ষেপ আর ইতিহাসবিনষ্টি ও বিকৃতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভই প্রকাশ করে যাব?