আলেহো কারপেনতিয়ের ও তাঁর সাহিত্যকর্ম

জ্যোতির্ময় ধর »

লাতিন আমেরিকায় সাহিত্যে ‘রিয়ালিসমো মাহিকো’ বা জাদুবাস্তবতার অন্যতম প্রবক্তার নাম আলেহো কারপেনতিয়ের। ১৯৩১ সালে স্প্যানিশ ভাষায় রচিত ‘একুয়ে-ইয়াম্বা-ও’ (হোক প্রভুর প্রশংসা) উপন্যাসটি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে আলেহো কারপেনতিয়ের-এর আবির্ভাব। ১৯০২ সালে কারপেনতিয়ের-এর ফরাসি বাবা ও রুশ বংশোদ্ভূত মা চলে আসেন কিউবাতে, আলেহোর জন্মের ঠিক দু বছর আগে। স্পেনীয় উপনিবেশের হাত ছাড়িয়ে কিউবা তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। কিউবার কালো মানুষদের জাদু আবহে ডুব দিয়ে অফ্রো-কিউবান সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করেন লেখনির মাধ্যমে।
তিনি শুধুএকজন ঔপন্যাসিকই নন, একজন সঙ্গীততত্ত্ববিদ। স্বয়ং সঙ্গীতরচনা করেছেন। লিখেছেন কিউবার সংগীতের ইতিহাস। তাঁর লেখা ‘লা মুজিকা এন কুবা’ (কিউবার সংগীত, ১৯৫৬) এখন সমগ্র লাতিন আমেরিকায় একটি মৌলিক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে।
কিউবাকে স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক করে তোলার স্বপ্ন ছিল বলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন কারপেনতিয়ের। কিউবার ১৯২৩-এর বিদ্রোহী প্রজন্মের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এই প্রজন্ম চেয়েছিল কিউবার জাতীয় সংস্কৃতিকে ব্যাবহার করে বিপ্লব ঘটানো। তাদের লক্ষ্য ছিল একনায়ক হেরারদো মাচাদোর অপসারণ। এই সময় তিনি একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘লা দিসকুসিয়ন’ পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতে থাকেন এবং এ কারণে ১৯২৮ সালে তাঁকে জেলে যেতে হয়। ১৯৩৩ সালে গণঅভ্যুথানে একনায়ক মাচাদো বাহামাসে পালিয়ে গেলে কিউবার ক্ষমতা চলে যায় মার্কিন মদদপুষ্ট আরেক স্বৈরশাসক বাতিস্তার হাতে। ১৯৫৯ সালে কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা’র নেতৃত্বে বাতিস্তা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত কিউবায় মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরতন্ত্রই বহাল ছিল ।
১৯২৮ সালে তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফ্রান্সে পালিয়ে যান এবং প্যারিসে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে গুয়েতেমালার ঔপন্যাসিক আস্তুরিয়াসের সাথে। পরে যিনি প্রথম লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যিক হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৬৭ সালে। পরিচয় হয় চিলির কবি, পরবর্তীকালের আর এক বিখ্যাত নোবেলজয়ী পাবলো নেরুদার সঙ্গে। প্যারিস থেকে কারপেনতিয়ের প্রায়ই আসতেন মাদ্রিদে, সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আরেক বিখ্যাত কবি গার্সিয়া লোরকার। ১৯৩৯-এ কিউবার অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। দেশে ফিরে কারপেনতিয়ের আবার কিছু কিছু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে শুরু করেন। কিন্তু বাতিস্তা সরকারের স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার তাঁর ওপর আক্রমণ নেমে আসে এবং তিনি এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশান্তরী হতে বাধ্য হন ভেনিজুয়েলায়। ১৯৪৫ থেকে কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবা বিপ্লবের সময় (১৯৫৯) পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। এই দেশান্তরেই লেখা হয় তাঁর প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘এল রেইনো দেল এস্তে মুনদো’ (এই পৃথিবীর রাজত্ব, ১৯৪৯)। ফরাসি উপনিবেশ হাইতির আফ্রিকান ক্রীতদাস বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে কারপেনতিয়ের ধারণা দিলেন লাতিন সাহিত্যের এক নতুনধারার, যার নাম ‘লোরিয়াল মারাবিয়োসো’ অর্থাৎ ‘আশ্চর্য সুন্দর বাস্তব’। ঐতিহাসিক পটভূমিতে বাস্তব এবং কল্পনার মিলনে যুদ্ধ-বিদ্রোহ এবং প্রেমের কাহিনি। অনেকের মতে, আলেহো কারপেনতিয়ের-এর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘লোস পাশোশ পেরদিদোস’ (হারিয়ে যাওয়া পদক্ষেপ’, ১৯৫৩)। হারিয়ে যাওয়া পদক্ষেপ পড়ার পর মনে হতে পারে তিনি স্পর্শ করতে চেয়েছেন লাতিন আমেরিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্টির মেলবন্ধন। মিথ ও ইতিহাসকে একসূত্রে বাঁধতে চেয়েছেন। এই গ্রন্থে প্রাচীন গ্রিক ও লাতিন সভ্যতা এবং খ্রিস্টধর্মের প্রসঙ্গ এসেছে।
‘গেররা দেল তেইমপো’ (সময়ের যুদ্ধ, ১৯৫৮) তিনটি গল্পের সংকলন। গল্পগুলোতে জাদুবাস্তবতার এক জটিল জগত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একই বছর প্রকাশিত আরেকটি উপন্যাস ‘এল আকোসো’ (পিছু ধাওয়া)। এই উপন্যাসে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন একনায়ক মাচাদোর রাজত্বে তৎকালীন কিউবা থেকে একজন নিরীহ ও সচ্ছল মানুষের শরণার্থী হওয়ার করুণ কাহিনি। ১৯৬২ সালে লেখা উপন্যাস ‘এল সিগলো দে লাস লুসেস’ (আলোর শতাব্দী) আন্তিঈয়াস অঞ্চলে (ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের বৃহৎ দ্বীপগুলোর একটি দল, যার মধ্যে কিউবা, পুয়ের্তোরিকো, জামাইকা, হাইতি, ডোমেনিকান রিপাবলিক) ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব নিয়ে লেখা। পরবর্তী উপন্যাসের শিরোনাম ‘এল দেরেচো দে আসিলো’ (আশ্রয়ের অধিকার, ১৯৭২)। সত্তরের দশকে স্প্যানিশ আমেরিকার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস। উল্লেখনীয় বিষয় হল, সেই সময়ের বিশিষ্ট লেখকগণ এই বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন, যার মধ্যে গাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেস ছিলেন অন্যতম। ‘কনসারতো বারোকো’ (ব্যারোক কনসাার্ট, ১৯৭৪) লিরিক আর সংগীতময়তায় প্রাণবন্ত এক সংক্ষিপ্ত উপন্যাস। ‘লা কনসাগ্রাসিওন দে লা প্রিমাভেরা’ (বসন্তের আরাধনা, ১৯৭৮) কিউবা বিপ্লব নিয়ে লেখা কাহিনি। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি রচনা করেন বিভিন্ন বিষয়ের প্রবন্ধ সংকলন। যেমন ‘লাতিন আমেরিকার সাহিত্য এবং রাজনৈতিক বিবেক’ (১৯৬৯) , ‘শহর ও স্তম্ভ’ (১৯৭০) , ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১৯৮৩)। যা কিউবা ও লাতিন আমেরিকার সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করে।
১৯৬০ এবং ১৯৭০ দুই দশকব্যাপী লাতিন আমেরিকার গদ্যসাহিত্যে অনন্য সম্রাট ছিলেন আলেহো কারপেনতিয়ের।