আমাদের ম্রিয়মাণ পুঁথিসাহিত্য

বারী সুমন :

‘হারিকেনের টিমটিমে আলোর সাথে আসমানে উঁকি দিত আধফালি চাঁদ। বাঁশঝাড়ের পাতার ফাঁক দিয়ে একচিলতে আলোর ঝলকানি পুঁথিপাঠের আসরকে আরও মোহনীয় করে তুলতো’।

সংস্কৃত শব্দ ‘পুস্তিকা’ থেকে পুঁথি শব্দটির উৎপত্তি। এর নাসিক্য উচ্চারণ পুঁথি। হাতে লেখা বইকে আগে পুস্তিকা বলা হতো। যেহেতু আগের দিনে ছাপাখানা ছিল না, তাই তখন হাতে পুঁথি লেখা হতো। প্রাচীন বা মধ্যযুগের প্রায় সকল সাহিত্য হাতে লিখিত হয়েছিল এবং এদের একাধিক সংস্করণও তৈরি হয়েছিল হাতে লিখেই। তাই প্রাচীন ও মধ্যযুগের সকল সাহিত্যকেই পুঁথিসাহিত্য বলা যায়।

পুথিসাহিত্য আরবি, উর্দু, ফারসি ও হিন্দিভাষার মিশ্রণে রচিত এক বিশেষ শ্রেণির বাংলা সাহিত্য। আঠারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত এর ব্যাপ্তিকাল। এ সাহিত্যের রচয়িতা এবং পাঠক উভয়ই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়।

পুঁথি এক সময় মুখে-মুখে রচিত হতো। লোককাহিনির মতোই পুঁথির জন্ম। পরবর্তী সময়ে লিখে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়। পুঁথি সাধারণত কোনো একটি কাহিনিকে কেন্দ্র করে রচিত হতো। বাংলাদেশে পুঁথিসাহিত্যের বেশ সুনাম রয়েছে। পুঁথিসাহিত্য গ্রামবাংলায় পাঠ করতো গ্রামের কিছু পাঠক। তারা সুর করে পাঠ করতো পুঁথি। একটি পুঁথি পাঠ করে শেষ করতে লেগে যেতো অনেক দিন। কখনও কখনও মাসও পার হয়ে যেতো। নানা অঙ্গভঙ্গি আর হাস্য-রসাত্মক কথার মধ্য দিয়ে পুঁথিপাঠ হতো। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তি যিনি পুঁথি পাঠ জানতেন এবং এর কাহিনি সম্পর্কে অবগত তিনিই পাঠ করতেন। পুঁথিপাঠে পাঠকের সুর একটি মুখ্যবিষয় ছিল। পুঁথির সুরটি অন্যান্য সুর থেকে একটু আলাদা। পুঁথির কিছু অংশ পাঠ করে এর সারসংক্ষেপ পাঠক-উপস্থিত দর্শকদের বুঝিয়ে দিতেন কথার মাধ্যমে।

পুঁথিপাঠ সাধারণত রাতের বেলা অনুষ্ঠিত হতো। সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অবসর সময়ে কোনো এক আঙিনায় জড়ো হতো। তারপর সেখানে উপস্থিত হতো পুঁথিপাঠক। অনেক পুঁথিসাহিত্য বাংলায় নামকরা ছিল। গুলে বকাওলি, বাহরাম বাদশা, লাইলি মজনু, ইউসুফ জোলেখাসহ বহু পুঁথিসাহিত্য ছিল। যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। আগে থেকেই তারা ঠিক করে নিত কোন্ পুঁথিটি পাঠ হবে।

আগেই বলেছি, একেকটি পুঁথি শেষ করতে মাসখানেক বা তার বেশি সময়ও লেগে যেত। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা থেকে শুরু করে মুরুব্বি এবং মহিলারাও পুঁথি শুনতে আসতো। যে বাড়িতে পুঁথিপাঠ হতো শুধু সে বাড়ির নয়, এর শ্রোতা থাকতো আশেপাশের অনেক বাড়ির মানুষজন। সবাই নির্ধারিত সময়ে পুঁথিপাঠের আসরে চলে আসতো। হারিকেনের টিমটিমে আলোয়, জলচৌকিতে পুঁথি রেখে পাঠক আসন করে বসতো। চারদিকে সবাই নীরব। তারপর সুর করে পাঠ চলতো। কয়েকলাইন পড়ে পাঠক থামতেন এবং এর মর্মার্থ উপস্থিত পাঠকবৃন্দকে বুঝিয়ে দিতেন। পুঁথিপাঠের কথা শুনে কখনও হেসে কুটি-কুটি হয়েছেন দর্শক। কখনওবা চোখের কোণে জমেছে অশ্রু। পুঁথিপাঠের মাঝখানে থাকতো বিরতি। পাঠককে চা করে এনে দিতো। সাথে উপস্থিত দর্শকরাও চা পান করতো। সাথে একটু পান বা তামাকের ব্যবস্থা করা হতো। বিরতির পর আবারও শুরু হতো পুঁথিপাঠ। রস-রসাত্মক, হাসি-ব্যঞ্জনায় ভরে থাকতো পুঁথিপাঠের পুরোটা সময়। রাত যত গভীর হতে থাকতো পুঁথিপাঠ ততোই জমে উঠতো। ছোট বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়তো মায়ের কোলে। বসার তেমন ব্যবস্থা না থাকলেও চাটাই বিছানো থাকতো। কখনও আরেকটু আরাম বাড়াবার জন্য খড় বিছিয়ে নেওয়া হতো। পাঠক নানান কথা দিয়ে বর্ণনা করে পুঁথিপাঠের পুরো সময়টিকে মাতিয়ে রাখতেন। গ্রামবাংলার প্রতিদিনের অঘোষিত একটি সময় থাকতো এই পুঁথিপাঠের জন্য। সে সময়ে সবাই পুঁথিপাঠের আসরে চলে আসতো। এটিকে প্রতিবেশীদের সাথে একটি সম্পর্কের সেতুবন্ধনও বলা যেতে পারে। এ বাড়ির-ও বাড়ির মানুষের খোঁজখবর নেওয়ারও একটা মাধ্যম ছিল পুঁথিপাঠের আসর। কে আসলো কে আসলো না, কেন আসেনি, কেউ অসুস্থ কিনা এমন খোঁজখবরের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতিও সুদৃঢ় হতো। এখানে কত অজানা কাহিনি উন্মোচিত হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরাও তখন এ পুঁথিপাঠ শুনতে আসতো। পুরোপুরি মর্মার্থ না বুঝতে পারলেও আনন্দ পেতো এবং এ সময়টা তারা অন্য কোনো কাজে অপব্যয় না করে বিনোদনের মধ্য দিয়ে কাটাতো। পুঁথিপাঠ তখনকার দিনের একটি বিনোদনেরও মাধ্যম ছিল। বাড়িতে কোনো মেহমান এলে বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান থাকলে সেদিনের আসরটা আরও বেশি জমজমাট হতো। বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পুঁথিপাঠের অনুষ্ঠানে মজাদার খাবারেরও আয়োজন থাকতো। হারিকেনের টিমটিমে আলোর সাথে আসমানে উঁকি দিতো আধফালি চাঁদ। বাঁশঝাড়ের পাতার ফাঁক দিয়ে একচিলতে আলোর ঝলকানি পুঁথিপাঠের আসরকে আরও মোহনীয় করে তুলতো। এমনি কত হাসিকান্নার ভেতর দিয়ে যে একটি পুঁথি শেষ হতো তা বলা কঠিন। এই পুঁথিপাঠের আসরে এসে একেকটি পরিবারের সাথে গড়ে উঠতো দৃঢ় সম্পর্ক।

সময়ের বিবর্তনে আজ অনেক গ্রামীণ ঐতিহ্যই আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানেই না পুঁথি কি জিনিস, তা কিভাবে পাঠ করা হতো। বর্তমান সময় প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির ভালো ও খারাপ দুটো দিকই আছে। তখনকার সময়ের ছেলেমেয়েরা পুঁথিপাঠ বা গ্রামীণ কিচ্ছ-গান দেখে ও শুনে বিনোদন পেতো। আর বর্তমানে অনলাইনভিত্তিক বহু বিনোদন মাধ্যম রয়েছে। তবে সেকালের পুঁথিপাঠ আর বর্তমানের প্রযুক্তির বিনোদনে রয়েছে বিস্তর তফাৎ। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে পুঁথিপাঠ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। তা না হলে এক সময় তারা জানবেই না বাংলা পুঁথিসাহিত্যেরও একটা স্বর্ণযুগ ছিল। যারা সাহিত্যপ্রেমী, লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন, গবেষণাধর্মী কাজ করেন, তারা ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি সকল সংগঠন ও ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে পুঁথিসাহিত্য বাঁচিয়ে রাখতে হবে নতুন প্রজন্মের জন্য।