আবুল হাসান কেন মুখস্থ থাকে

মইনুল আবেদীন »

যখন কাঁচাবাজারে যাই, ঝাঁকা থেকে সবচেয়ে বড় দেশি লাল মোরগটা দেখিয়ে আমার অনেক দিনের চেনা কাঁচাপাকা দাড়ি, এক চোখকানা মুরগির ব্যাপারি কেবলই, ‘এটা ধরো চাচা’, মুরগিওলা অসহায় মোরগটার কাতরোক্তি, কাকুতি-মিনতিকে উপেক্ষা করে সুন্দর ডানা দুটিকে হলুদ দুপায়ের সাথে পেঁচিয়ে নিয়ে গলাটা বাড়িয়ে ধরে আর আরেকজন ছোট্ট মাথাটা দু-আঙুলে চেপে ধরে ছুরি চালাতে থাকে, আমি চোখ ফিরিয়ে নিই আর আমার মনে আসে আবুল হাসানের কবিতার পংক্তি :
‘এইমাত্র বিদ্ধ হলো বেদনার চিকন চাকুর ক্রুরতায় …
ড্রামের ভেতর ছুড়ে ফেলা গলাকাটা মোরগটার মর্মান্তিক ডানা ঝাপ্টানি শুনে আমার মনে আসে :
‘উদয়শংকর যেন নাচিতেছে ভারতী মুদ্রায় …
কিছুক্ষণ পর ড্রামটা নীরব হয়ে গেলে ফের মনে বাজে :
‘এখন শান্তি শান্তি অনুভূতি আহত পাখায়
ভেংগে পড়ে আছে পাখি গৃহস্তের গরীব মোরগ!
একদিকে পুচ্ছ হায় অন্যদিকে আমার ছায়ায়
মুখ গুঁজে শান্ত সে সমাহিত, এখন নিহত। …
আবুল হাসানের কোন বইই এ মুহূর্তে আমার হাতের কাছে নেই। সবই আমার স্মৃতির ফসল। আমি স্বেচ্ছায় এবং জ্ঞানত এসব মুখস্থ করিনি, কিন্তু মুখস্থ হয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত আরও অনেকেই আমার মতো এ রকম আছেন। কিন্তু এ কি করে সম্ভব?
ছোটবেলায় আমাদো সবাইকে পরীক্ষা পাসের জন্যে কবিতা মুখস্থ করতে হয়েছে। অমুক কবির অমুক কবিতাটির প্রথম দশ লাইন মুখস্থ লেখ। আমরা পরীক্ষা পাসের জন্যে দায়ে পড়ে মুখস্থ করেছি। কিন্তু এখানে তো সে রকম কোনো দায় ছিল না। তাহলে কী ছিল আর কী আছে আবুল হাসানের কবিতায়? প্রতিদিন ভোরে কর্মস্থলে যাওয়ার আগে শ্মশ্রু কামিয়ে ফিটফাট হতে রেজর হাতেআয়নার সামনে দাঁড়াই। মনে আসে :
‘রেজর আমার ইস্পাতিনী, রেজর আমার সেবিকা …
আবুল হাসান যেমন লিখেছেন, আমি পূনর্বার স্মৃতি তাড়িত হই :
‘চেহারায় চেরীর ঝোপের আর মুখে তোর মোজেক ফ্লোরের মতো
না এলে, এই শহরে কি, বণিক, এমন শহরে কি
সম্ভব হে সুখস্বপ্ন, গোলচাঁদ, গোলাপ, গোলাপ? …
যখন রাস্তায় কোনো নিঃসঙ্গ কিশোরকে দেখি বিকেলের পড়ন্ত আলোয় হয়তো ফুটবল খেলে বা কোচিং শেষে ঘর্মাক্ত দেহে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরছে, আমার মনে উঁকি দেয় এ পংক্তিটি :
‘ক্লান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়। …
কিংবা যখন উজ্জ্বল-উচ্ছল একদল কিশোরীকে দেখি কি এক অজানা অনির্বচনীয় আনন্দে কলকল ছলছল করতে-করতে রাস্তা দিয়ে চলেছে আর কি যে ওদের চাওয়া-পাওয়া ওরা নিজেরাও জানে না, আমার মনে জাগে এই পংক্তিমালা :
‘অতটুকু চায়নি বালিকা, অত শোভা অত স্বাধীনতা,
চেয়েছিল আরো কিছু কম। …
আর যখন আবার ওদেরই কোন একজনকে দেখি কোন অলস অপরাহ্নে নির্জন লেকের পাড়ে বন্ধুর হাত ধরে ভয়-সংকোচে জড়সড় আলুথালু হাঁটছে, নিচের পংক্তিজোড়া আমার ওপর ভর করে :
‘একটি জলের খনি তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি,
চেয়েছিল, একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী! …
এখন কেউ গাছ ভালোবাসে না, নিসর্গ ভালোবাসে না, সবাই বড় বড় পিচঢালা রাস্তা চায়, আলিশান এপার্টমেন্ট চায়, তাই আকাশসমান উঁচু ছায়াভরাতুর গাছগুলো কারো-কারো চক্ষু। নিরীহ-নির্বিরোধী গাছগুলোকে কেটে কেটে লাশের সারি করে সাজিয়ে রেখেছে। পত্রিকায় ছবি দেখি আর আমার বুক ফেটে বেরিয়ে আসে কবেকার পড়া এই লাইনটি :
‘বড় মায়া হয় যখন ওদের দেখি কুঠারের ক্রুশবিদ্ধ মেরীর সন্তান …
‘হুলস্থুল সমিতিপ্রধান যুগে’ সবাই যখন নিজেকে জাহির করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মত্ত, যারা ‘কসাইখানায় সুন্দর নিষ্পাপ গাভী বিক্রি করার’ মতো নির্দয়-নিষ্ঠূর, এসব দেখেশুনে আমার রক্তাক্ত হৃদয় আবুল হাসানের মতো আর্তনাদ করে :
‘এইসব থেকে আমি ছুটি চাই, ছুটি চাই প্রভু …
যখন শুনি প্রেমে ব্যর্থ প্রেমিক প্রেমিকাকে খুন করেছে, এসিড মেওে ঝলসে দিয়েছে প্রেমিকার অবয়ব, আমার মনে হয় যদি সেই অর্বাচীন, পাশবিক প্রেমিকের পড়া থাকতো এইসব পংক্তি :
‘যদি সে সুগন্ধি শিশি তবে তাকে নিয়ে যাক অন্য প্রেমিক,
আতরের উষ্ণ ঘ্রাণে একটি মানুষ তবু পুষ্পবোধ ফিরে পেলে
পুনঃ আমি হবো নাকি খুব আনন্দিত? …
অথবা,
‘যদি সে কিছুই নয়, শুধু মারী শুধু মহামারী, ভালবাসা দিতে গিয়ে দেয় শুধু ভুরুর অনল,
তোমরা কেউই আঘাত করোনা তাকে, আহত করো না,
যদি সে কেবল ইবিষ, ক্ষতি নেই, আমি তাকে বানাবো অমৃত। …
যেদিন শুনলাম পাশের বাড়ির সদ্যবিবাহিতা অল্পবয়সী মেয়েটি কিভাবে যেন হঠাৎ মরে গেল, আমার স্মৃতিতে করুণ রোদনধারা বয়ে গেল এভাবে :
‘যখন একটি মৃত সুন্দরীকে গোর দেয়া হলে
ঘায় ভগবান, যখন সুন্দরী মৃত …
কিন্তু একটি অসহ্য দৃশ্য ঘটে গেল হঠাৎ তখনই, যখন জানলাম আমিÑ
‘গর্ভে তার অসমাপ্ত একটি ভ্রুণ শিশু হতে পারল না, একটি সুন্দর ভ্রুণ …
কিংবা যখন আমার কাছে-পিঠের অনূঢ়া, একা থাকা, দেখতে ভালো না স্কুলশিক্ষিকাটিকে দেখি কাঁধে অনেকগুলো খাতার ভার নিয়ে যেনবা জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত, নুয়ে-নুয়ে চলেছে, আমার কানে বাজে আবুল হাসানের আর্তি :
‘ওকে দয়া করো হে ভোর, বনের বীজন, শিশু ক্লাস, আর্ট খাতা,
বিষণ্ন ওই কুমারীকে দয়া করো, দয়া করো, দয়া করো …
যখন ইউক্রেন, সিরিয়া, বা প্যালেস্টাইনে অর্থহীন যুদ্ধের ডামাডোলে প্রাণহারানো অসহায় মানুষের ছবি দেখি পত্রিকায়, মনের গহিনে গুমরে কাঁদে এ পংক্তিটি :
‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না। …
পরিশেষে সমস্ত হতাশা-নিরাশা, তীব্র দুঃখবোধের হৃদয় নিংড়ানো পথ হাঁটা শেষে যখন প্রার্থনার মতো কানে বাজে :
‘আমার অনলে আজ জাগো তবে হে জীবন, জয়শ্রীজীবন …
তখন মনে হয় তবুও জীবন অনেক সুন্দর, মনে হয় আরো অনেক-অনেক দিন, যেনবা হাজার বছর বেঁচে থাকি।
যদি পরলোক বলে কিছু থাকে আর আবুল হাসানের সাথে আমার দেখা হয়, আমি তাকে বুকে জড়িয়ে রাখবো অনেকক্ষণ আর জানতে চাইবো, আবুল হাসান, এসব পংক্তির পর পংক্তি আপনি কী মন্ত্র বলে সৃজন করেছিলেন আর আপনার কবিতা কেন না চাইতেই আমাদের মুখস্থ হয়ে যেত?
পাদটীকা : আধুনিক বাংলা কবিতার শক্তিমান কবি আবুল হাসান ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর আটাশ বছর বয়সে লোকান্তরিত হন।