অতনু ও শতাব্দীর স্বপ্ন

দীপক বড়ুয়া »

ভোরের আগেই পাখি ডাকে।
সূর্য ওঠে। চারিদিকে পাহাড়। সূর্য দেখা যায় না। সকাল দশটায় ঘণ্টার কাঁটা পা রাখলে সূর্য সবাইকে দেখে। তার অনেক আগে দিনের কাজ শুরু হয়। কেউ অফিসে, ইশকুলে, কলেজে, ব্যাংক-আদালতে ছুটছে। দোকানপাট খুলছে। অতনুও বসে নেই। অফিসে যাচ্ছে। ফিরে সন্ধ্যায়। কিছুদিন আগে সিএনজিতে এক্সিডেন্টে ডান পা হারায়। স্থানীয় অর্থপেডিক ডাক্তারের স্নেহ-আদরে নকল পা সংযোজনে হাঁটতে পারে। অফিসে অনেক কাজ। অফিস থেকে ফিরতে রাত হয়। নিজে রান্না করে। এক তরকারি। মাছ, না হয় ডাল।আজ শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। কোন রকমে একটা বিস্কিট-জল পেটে দিয়ে বিছানায় শোয়। বিধ্বস্ত শরীর। গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চেপে ধরে।
আজ পহেলা বৈশাখ। নতুন বছর এলেই মনে পড়ে সেদিনের কথা। ডিসি হিলে প্রথম দেখা শতাব্দীর সাথে। কথা, দীর্ঘক্ষণ আলাপ। শুরুটা করেছিল শতাব্দী। আইসক্রিম খাচ্ছিল সে। দুপুর রোদ। টুক করে আইসক্রিম ভেঙে শাড়িতে পড়ে। শাড়ির জমিন শাদা, ধবধবে। পাড় টকটকে সবুজ। কপালে পাড়ের রঙে টিপ। নখপলিসের রঙও তাই। শাদা শাড়িতে কফিরঙের আইসক্রিমের টুকরো। যাচ্ছেতাই, বিচ্ছিরি! আমি কাছাকাছিতে বসে। গান-নাচ চলছে। নতুন বছরের। পুরো ডিসি হিলে মানুষের ভিড়। পহেলা বৈশাখের ফেস্টুনে ভরা। মাটির খেলনা, হাতপাখা। কাছের স্বজন কেউ দূরে থাকলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সবার গায়ে একই রঙের শাড়ি। দারুণ। সত্যি কথা শাড়িতে মেয়েদের বাঙালিপনা বাড়ে। নতুন বছর এলে মনে হয়, সবাই বাঙালি। কে কোন ধর্মের বোঝা যায় না। সবাই এক। ইস্ এভাবে সারাবছর চললে, কি যে ভালো লাগতো! তখনই কানে বাজে,
একটু জল দেবেন? মেয়েকণ্ঠ। ভারি মিষ্টি। দেখি একজন মেয়ে। হাতে আইসক্রিম। অর্ধেক। আবারও প্রশ্ন,
আপনার হাতে পানির বোতল। একটু দিন। শাড়িতে দাগ পড়বে।
আমি দেরি করলাম না। হাতের বোতলটা বাড়িয়ে দিলাম। একটু সহানুভূতিশীল হলাম। হাজার হোক একজন মেয়ে তো। পরপর নাম জিগ্যেস করি। সহজ-সরল শিশুর মতোই নাম বলে,
শাশ্বতী! মনে-মনে বলি, ভারি মিষ্টি নাম।
বাসা কোথায়? কে কে আছে সব। এভাবেই পরিচয়।
অতনু তোমাকে আজ দারুণ লাগছে। শতাব্দী অতনুর ডান হাত ধরে বলে। অতনুর শতাব্দীর চিকন-সরু লম্বা আঙুল ভীষণ ভালো লাগে। জলের রঙে নখপলিস নখে। ঐ আঙুল দেখে বলে,
এটা তোমার পুরনো কথা। নতুন কিছু বলো। অতনু উত্তর দেয়।
পৃথিবীতে সব তো পুরনো। নতুন কি আছে বলো! অতনু চুপ। অতনু ভালো করে জানে ওর চুপ থাকা শতাব্দীর পছন্দ নয়। রাগবে। হাওয়ার বেগে ছুটে যাবে। কিছুক্ষণ পর রাগ কমলে ফিরবে। এটা অতনুর ভালো লাগে। ঠিক তাই হলো।
শতাব্দী ফিরে আসে। পিছনে থেকে জড়িয়ে বলে,
তুমি কি? কি চাও, এখনও বুঝি না। অদ্ভুত এক মানুষ! অথচ এতোদিন কাছাকাছি আছি, বুঝে উঠিনি। শুধু প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন। এই হচ্ছে শতাব্দীর চরিত্র।
এভাবে স্বপ্নে দেখে অতনু। খাগড়াছড়ি শহরে থাকে। শতাব্দী চট্টগ্রামে। জামালখানে। দুজন পাশাপাশি বাসায় থাকতো চট্টগ্রামে। তা’তেই ওদের ঘনিষ্ঠতা। কলেজে পড়ার সময় ওদের কথা হয়। এখানে-ওখানে যাওয়া, খাওয়া। একদিন ছুটিতে রাঙামাটি বনবিহারে যায়। অতনু, অতনুর মা। শতাব্দী, তার মা এবং দাদা। কি আনন্দে কাটিয়েছিল সময়। মন্দিরে যাওয়া। বোটে বেড়ানো। এখন ওসব স্মৃতি শুধু।
কাছাকাছি থাকাতে পারিবারিক সম্পর্ক হয় দুই পরিবারে। অতনু-শতাব্দীর মেলামেশার কথা সবাই জানে। অতনুর মা, শতাব্দীর মা দুজনে ওদের বিয়ের কথা বলে। খবরটা অতনুর কানে আসে। অতনু বলে,
– মা, আমি আগে একটা কিছু করি। তারপর বিয়ে। বউকে কি খাওয়াবো।
অতনুর মা প্রাইমারি ইশকুলের শিক্ষক। যা বেতন পায়, তাতে ম -ছেলের সংসার চলে। বাসাভাড়া নেই। নিজের বাড়ি। অতনুর বাবা নেই। গত হয়েছে অনেকদিন আগে। স্বাধীনতা যুদ্ধে মারা যায়। অতনুর বাবা একজন সফল মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধে দুঃসাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মাননা দেন। অতনুর মা চাকরির বেতন ছাড়াও স্বামীর মাসিক মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পান। সংসারে তেমন অভাব নেই। অতনুর মা বলেন,
বিয়ের পরও চাকরি খুঁজতে পারবি। বউকে আমি খাওয়াবো।
-না, মা, সে হয় না। তুমি বউকে খাওয়াবে! ছি ছি। তা হয় নাকি! আগে চাকরি। তারপর বিয়ে। অতনুর এই চরিত্রে মা’র বুক গর্বে ভরে যায়। এক্কেবারে বাবার চরিত্র। নিজের ব্যক্তিত্বে কারো কাছে ছোট হবার নয়। হঠাৎ ব্যাংকের চাকরির ইন্টারভিউর চিঠি আসে। অতনু আনন্দে শতাব্দীকে ডাকে।
শতাব্দী আসে। বলে,
এতো খুশি! ব্যাপার কি?
আমার ইন্টারভিউর চিঠি আসছে।
ওমা তাই! কোথায়? কিসের চাকরি? শতাব্দী আনন্দে প্রশ্ন করে।
ব্যাংকের। খাগড়াছড়ি।
কোন ব্যাংকে?
জনতা ব্যাংকে।
সরকারি ব্যাংকে! সে তো অনেক ভালো চাকরি। তো যাচ্ছো কবে?
কাল।
বেশ, বেশ, তা যাও। যদি চাকরিটা পাও, চাইনিজ খাওয়াতে হবে।
খুব ভোরে অতনু বেরুয়। পরীক্ষা ভালো হয়। ভাইভাও। জয়েন করতে হবে খাগড়াছড়িতে। খবরটা শুনে শতাব্দীর মন খারাপ হয়ে যায়। কারো সাথে কথা বলে না। সারাদিন চুপচাপ। অতনু ডাকে। সাড়া দেয় না। অনেক ডাকাডাকির পরে শতাব্দী আসে।
তুমি রাগছো কেন শতাব্দী। প্রথম চাকরি। যেখানে দায়িত্ব সেখানে যেতে হবে না!
আমি এখানে একা-একা কি করবো? কার সাথে গল্প করবো, সময় কাটাবো।
তোমার মা আছে, দাদা আছে। আমার মাও আছে।
সব আছে। কিন্তু আমার ভালোবাসা? সে তো থাকবে না। কি হবে তখন?
ক্ষতি তো কিছু নেই। ফোনে কথা বলবো। ম্যাসেনজারে। তুমি আমাকে দেখবে। আমি তোমাকে দেখবো।
এই কথায় একটু মাথা ঠান্ডা হয় এবার।
কখন যাচ্ছো? শতাব্দীর প্রশ্ন।
কাল সকালে।
জয়নিং তারিখ কবে?
পরশু।
আর প্রশ্ন নেই। চুপচাপ দুজন।
আধা আলোতে শতাব্দী কাঁদে। চোখের জলে মুখ ভাসে। শ্বাস দ্রুত হয়। অতনু অবাক চোখে শতাব্দীকে দেখে। শতাব্দীর কান্নায় অতনুও কাঁদে। এক সময় শতাব্দী অতনুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শব্দ করে কাঁদে।
আজ অতনুর চাকরির প্রথম দিন। খুব ভালো লাগছে। সিনিয়র সবাই কাছে টেনে নেয়। কাজ শিখিয়ে দেয়। অফিস শেষে বাসায় ফিরে অতনু শতাব্দীর সাথে ফোনে কথা বলে। ম্যাসেনজারে দুজন মুখোমুখি কথা বলে।
কিছুদিন পর। অফিস থেকে ফিরতে সিএনজি উল্টে যায়। পাহাড়ি পথ। একটু অসাবধানতায় ছোটবড়ো দুর্ঘটনা হবেই। অতনুর ডান পা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসা হয়। চিকিৎসক বলে,
অতনু, আপনার ডান পা আর ভালো হবে না। কেটে ফেলতে হবে। অতনু চুপ। ভাবে এখন কি হবে? মা, শতাব্দীকে এই দুঃসংবাদ কিভাবে জানাবে! অতনুর পাশের বাসায় একজন ডাক্তার থাকেন। অর্থপেডিক। প্রচণ্ড ভালোবাসেন অতনুকে। অনেকটা ছেলের মতই। অতনুর এই অবস্থা দেখে বলেন, অতনু তুমি চিন্তা করো না। আজকাল নকল পা লাগানো যায়। তাতে হাঁটতে অসুবিধে হবে না। যা করার আমি করবো। শহরে না হয় ঢাকায় গিয়ে সব ব্যবস্থা করবো। তখন অফিসে যেতে পারবে। ঘুরতে পারবে। তবে একটু সাবধানে।
আংকেল ,আমার তো অত টাকা নেই। কীভাবে সম্ভব আমার পক্ষে।
তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। ঐসব ভাবনা আমার। আমিই করবো।
সেই ডাক্তারের আন্তরিকতায় অতনু হাঁটতে পারে। অফিসে যায়। ফোনে মা’র সাথে কথা হয়। মা অতনুকে বলে, কখন আসবি? সেই যে গেলি, আসার নাম নেই।
আসবো মা। নতুন কাজ। শিখছি। ছুটিতেও কলিগের কাছে শিখি।
সব সময় শতাব্দী তোর কথা বলে। ওকে ফোন করিস, বাবা। ও তোকে ভীষণ ভালোবাসে। তোর প্রতীক্ষায় আছে।
শুক্রবার।
অফিস বন্ধ। শুক্রবার এলেই অতনু খুশি। লম্বা ঘুম দেয়। অতনু ঘুমপাগল। ঘুমের সাগরে অতনু ভাসছে। ঠিক তখনই অতনুর ফোন বাজে। অতনু বিরক্ত হয়। রাগে। গাল দেয় মনে-মনে। যে ফোন করেছে তাকে। অনেকক্ষণ ফোন বাজে। অতনুর মন চায় না ফোন ধরতে। দুহাতে কান চেপে ধরে। না, আর পারে না। ঘুমচোখে ফোন ধরে।
হ্যালো, আমি শতাব্দী।
অতনু লাফিয়ে ঘুম থেকে ওঠে। বিছানায় বসে। চারিদিকে চোখ রাখে। সব যেন ঝাপসা মনে হয়। আঙুলে চোখ কচলায়। না, সব ঠিক। ফোন বলে, অতনু, তুমি কেমন আছো? ফোন নেই, কথা নেই।
হ্যাঁ,আমি ভালো আছি।
সেই যে চাকরিতে গেলে, বছর পার হলো, একটিবারও আসলে না, ব্যাপারটা কি? অতনু শতাব্দীকে ভালোবাসে। তাই মিথ্যে বলতে পাওে না। এখন কি বলবে? ভাবে।
কি তুমি চুপ কেন? কিছু বলো!
কি বলবো!
কখন আসবে?
আসবো। সময় করে আসবো। কাজের বড্ডো চাপ।
তুমি কি কিছু লুকাচ্ছো? নিশ্চয়ই একটাকিছু ঘটেছে! যা তুমি বলছো না! অতনুর বুকটা ভারি হয়ে আসে। কথা বেরোয় না। ভাবে, সত্যি কথাটি কিভাবে শতাব্দীকে বলবে। শতাব্দী জানলে মা জানবে। মা কেঁদে বুক ভাসাবে। ছুটে আসবে খাগড়াছড়ি।
কি অতনু, তুমি কথা বলছো না কেন? অতনুর চোখে কোত্থেকে জল আসে।কথা ভারি হয়। কি ভেবে শতাব্দী উঁচুগলায় কেঁদে-কেঁদে বলে, জানো অতনু, কিভাবে আমার সময় যায়। আমি একা আর পারছি না। কতোদিন এভাবে কাটবে বলতে পারো। তুমি আমার স্বপ্নবিলাস, সুখস্বপ্ন! তুমি ছাড়া আমার মৃত্যু অনিবার্য। অতনু তুমি ফিরে এসো। ঐ দূরের চাকরি আমার প্রয়োজন নেই। তুমি শুধু আমার চোখের সামনে থাকবে।
অতনু শতাব্দীর কান্নায় নিজকে ধরে রাখতে পারে না। সেও শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করে।