অবসন্ন দিনের গল্প

আসিফ উদ্দিন রিজভী »

আপনাকে সুন্দর লাগছে প্রচুর।
রিয়া হেসে ওঠে, বলে, এমনভাবে বললেন, যেন অনেকদিন চেষ্টা করে কথাটা আজ বলতে পেরেছেন?
কথাটা বলে সে চোখ দুটো আমার দিকে তাক করে হাসিটাকে চাপানোর চেষ্টা করে। অদ্ভুত সেই হাসিতে যেন আমার পুরো পৃথিবীটা দুলছে। যে কথাগুলো আমি বলবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম সবগুলো কথা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আমার কাছে পড়ে রইলো শুধু শূন্য একটা বাকযন্ত্র, যেখান থেকে বের হওয়ার মতো কোন বাক্য পৃথিবীর বুকে আর বেঁচে নেই। আমি চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। কেমন যেন একটা বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। বুঝতে পারলাম, এটা স্বাভাবিক দৃষ্টি না। জিনিসটা আমারও অস্বস্তি লাগছে। আমি রিয়াকে বললাম, আপনি কিভাবে বুঝতে পারলেন যে আমি কথাটা অনেকদিন ধরে বলতে চাচ্ছি?
কই বুঝতে পারলাম? আন্দাজে বললাম, সত্যি হয়ে গেল।
আমি লজ্জা পেলাম। বললাম, আপনি জিতে গেলেন।
জিতে গেলাম মানে? কম্পিউটারে কি একটা ডকুমেন্ট মিনিমাইজ করলো। তারপর চেয়ার আলতো করে ঘুরিয়ে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।
আমি বললাম, ইউ আর উইন।
জেতার জন্য তো খেলতে হয়। না খেলে তো জেতা যায় না। খুবই সিরিয়াসভাবে বলল সে।
এই যে আপনি ফিফটি-ফিফটি সম্ভাবনা নিয়ে একটা কথা বলে ফেললেন এবং আপনার তির একদম হরিণের ঘাড়ে লেগেছে। মানে আপনি নিশানা উড়িয়ে দিয়েছেন। এটাকে জিতে যাওয়া বলে না?
রিয়া হেসে ওঠে। কথা বলে না। লাল স্লিপলেস ব্লাউজের ওপর রুপার সিম্পল একটা গয়না। আমি দেখছি মাখনের মতো নরম একটা মেয়ে আমার পাশে বসে হাসছে।
আমি বললাম, সময় তো শেষ। বাসেই যাবেন নাকি?
রিয়া মাথা নাড়ে। বলে, বাসেই যাবো। আমার একটু কেনাকাটা আছে।
তাহলে চলেন, আমরা কফি-টফি কিছু একটা খেয়ে বের হলে কেমন হয়?
আমি সুযোগ বুঝে একটা অফার দিয়ে দিলাম। সত্যিকথা বলতে কি, আমি মেয়ে পটানোর কোনো সিস্টেম জানি না। জিনিসটা কিভাবে করতে হয়, সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আমার নাই। একটা কথা বলতে লজ্জা লাগছে, তবুও বলছি, আমার জীবনে কোনো প্রেমের এক্সপেরিয়েন্স নাই।
বইটই পড়ে কিছু ধারণা আমার হয়েছিল। সবকিছুকে একত্র করে আমি রিয়ার কাছে একটা বোকাসোকা আবদার করে বসি এবং সে সেটা প্রতিবারই রিজেক্ট করে দেয়। আমি অফারটা দিয়ে চুপচাপ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকি। মাথা তুললেই লজ্জায় মিশে যাবো নিশ্চিত। আড়চোখে রিয়ার দিকে তাকাতেই দেখি সে কিছুক্ষণ কি জানি ভাবে। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাগ গুছায়। একবার ফোনের পাওয়ার অন করে সময়টা দেখে নিয়ে বলল, তাহলে আমার সামনে বসে সিগারেট ধরাতে পারবেন না। ওর কথা শুনে আমি একটা ধাক্কা খাই। পরপর কয়েকবার ঝাঁকুনি অনুভব করি। মনে মনে কতগুলো মিথ্যা কথা খুঁজে একটার পর একটা লাগিয়ে জিনিসটাকে যতটা সম্ভব সত্যের কাছাকাছি নিয়ে বললাম, কি আশ্চর্য! আমি সিগারেট খাই, এ কথা আপনাকে কে বলল?
আমি এমন একটা স্টাইলে কথা বললাম, যেন এই জীবনে সিগারেট কি জিনিস আমি ছুঁয়েও দেখিনি। কথাগুলো বলার সময় আমার পকেটের ভেতর গোল্ডলিফের নতুন প্যাকেটটা বাঁকা হাসি দিচ্ছে তা টের পাচ্ছিলাম।
রিয়া বলল, হ্যাঁ, আপনি তো সিগারেট খান না। ওকে ফাইন, তাহলে তো রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করাই যায়।
রিয়া কফি খেতে খেতে বলল, মুরাকামির ‘দ্য এলিফ্যান্ট ভ্যানিসেস’ পড়েছেন?
পড়েছি তো। একটা হাতি এভাবে কিভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে বলুন তো?
অনেক কিছুই তো হারিয়ে যায়। হাতিটা বড় বলে মানুষের চোখে পড়েছে, বলল রিয়া।
বুঝছেন রিয়া, বললাম আমি, এসব আসলে মাথায় নেওয়ার মতো কিছু না। শূন্যতা থেকেই আমাদের বেঁচে থাকা শুরু, আর সেই বেঁচে থাকা ক্রমাগত স্রোতের মতো নানারকমভাবে সত্য হয়, আবার মিথ্যাও হয়। হাতি উধাও হয়। হাতিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এত বড় জীবন আমাদের তো এগোতে থাকে। অতিবাহিত হয় আর সবকিছু মিলিয়ে কী যে ঘটে তার হদিশও পাওয়া যায় না শেষ পর্যন্ত।
রিয়া বলল, আপনি সোজা গল্পটাই মুখস্থ করে ফেলেছেন দেখি।
আমি মাথা নাড়ালাম। বললাম, যেভাবে আপনাকে করি।
আমাকে করেন মানে? রিয়া অবাক হলো না। কিন্তু খানিকটা সতর্ক হলো।
আপনি কি জানেন, আমি আপনাকে পছন্দ করি?
জানি, বলল রিয়া।
কবে থেকে জানেন?
রিয়া বলল, এখনই জানলাম। এবং এটাও জানি যে, আপনি আমাকে ভালোবাসেন।
আমি জানতে চাইলাম, কিভাবে জানেন ?
চেহেরায় একটা হাসি টানার ট্রাই করলাম। হচ্ছে না। কিন্তু চেষ্টা করলাম। এই হাসি দেওয়ার মানে হলো, আমি রিয়াকে ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, আমি প্রচুর ভয় পাচ্ছি। আমার বুক কাঁপছে।
রিয়া বলল, আপনি যাকে-তাকে কফি খেতে ডাকার মতো মানুষ নন। এবং গত তিন বছর ধরে একটা মানুষকে তিন হাজারবারের ওপর কফি অফার দিয়ে রিজেক্ট হবার পরেও যে সেইম কাজটা করে যায়, তার মানে কি? সে আমাকে নিশ্চয়ই পছন্দ করে। এটা বুঝতে হলে নিশ্চয়ই রকেট সায়েন্স জানা লাগে না। এ কথাটা শুধু আমি কেন? অফিসের সবাই জানে!
আমি লাফিয়ে উঠলাম, মানে কি? এখন আমি মুখ দেখাবো কিভাবে?
রিয়া কফি শেষ করে ওঠে দাঁড়ায়। বলল, মুখ দেখাতে হবে না। চলেন।
কোথায় যাবো? জানতে চাইলাম।
নিশ্চয়ই পৃথিবীর শেষপ্রান্তে চলে যাব না। বলেই সে ওঠে হাঁটতে শুরু করে।
চশমা ফেলে যাচ্ছেন যে?
রিয়া দাঁড়ায়। একটু করে হেসে চশমাটা চোখে দিয়ে একটা কাল্পনিক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেটা ঠিক করে নিয়ে বলে, আর কিছু ফেলে যাচ্ছি?
হ্যাঁ যাচ্ছেন। কিন্তু সেটা চোখে দেখা যাবে না, বললাম আমি।
মুহূর্তের জন্য রিয়া থেমে যায়। চারপাশের সবকিছু যেন মরে গিয়ে শুধু দেয়াল ঘড়িটাই বেঁচে থাকে। সেটাই শুধু টিকটিক করে শব্দ করে যাচ্ছিল। সেই নৈঃশব্দ্যের ভেতর থেকে আমরা আমাদের নিশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিলাম।
স্পেসবাটনে দ্বিতীয়বার চাপ পড়তেই দৃশ্যটা আবার চলতে শুরু করে। রিয়া হেঁটে বেরিয়ে যায়। আমিও নিরুত্তর রিয়ার পিছু-পিছু চুপচাপ অনুসরণ করে বেরিয়ে যাই।
রিয়া আর আমি আমাদের ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে গেলাম। আমাদের কারোরই আসলে চাকরির প্রয়োজন নেই। আমরা দুজনই চিটাগং থেকে ঢাকা এসে পড়াশোনা করছি এবং দুজনেরই একটা বড়সড় নেশা আছে। সেটা হলো, বইকেনা আর পৃথিবী চষে বেড়ানো।
এজন্যই আমরা আলাদা ইনকামের একটা রাস্তা বের করে নিয়েছি। রিয়া বলল, প্রপোজ করবা না?
করবা না মানে? আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসলেন যে? এভাবে এডভান্স এগোচ্ছেন? কাহিনি কি? রিয়া সহজে সবকিছুর উত্তর দেয় না। কলিগ এবং সহপাঠী হিসেবে আমি যতটুকু চিনি তার ওপর ভর করে আমি নিজে নিজে একটা উত্তর খুঁজে নিই।
সে মানুষ হিসেবে কঠিন। মানে সে যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি কিছু সহজে করবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন ছেলেটাও এসে যদি তাকে ‘আই লাভ ইউ’ বলে, সে সুন্দর মতো হেঁটে চলে যাবে, জবাব পর্যন্ত দেবে না। যদি সে এভাবে জবাব দিকে থাকে, তাহলে তার এই পুরো জীবনটা মানুষকে জবাব দিতে দিতেই শেষ হয়ে যাবে।
সেদিন আমরা প্রচুর ঘুরেছিলাম। বৃষ্টি এসেছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি রিয়ার চুলের ওপর শিশিরের মতো জমছে। আমি চুলগুলো ঝেড়ে দিতে দিতে বললাম, একদিনে আমি কি অনেক বেশি করে ফেলছি?
রিয়া বলল, অনেক বেশি কিছু তো করোনি।
আমি খুশি হলাম। রিয়ার পজিটিভ থিংকিংগুলো আমার ভালো লাগে। তিন বছর একটা মানুষকে ভালোবেসে যাচ্ছি। পাথর ঠুকতে-ঠুকতে ধুপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। আমি আনন্দ করবো না? রিয়া জিনিসটা বুঝেছে। এটাই বা কি কম আনন্দের?
আমার এখন আর অফিসে গেলে রিয়ার সাথে মেপে-মেপে কথা বলতে হয় না। চাইলেই আমরা কফি খেতে যেতে পারি। একদিন আমি রিয়াকে বানিয়ে-বানিয়ে একটা গল্প বললাম যে, আমার একটা গার্লফ্রেন্ড ছিল যে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।
সে কথা শুনে রিয়া প্রচুর হাসলো। আমি ভেবেছিলাম রিয়া মনখারাপ করবে। মনখারাপ করলে রিয়াকে কেমন দেখায়, সেটা একটু দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে হাসতে-হাসতে বলল, ছেড়ে চলে গেল কেন?
আমি ধরা খেয়ে যাবো মনে হচ্ছে। মিথ্যা বলার টেকনিকগুলো আমার জানা নেই। শুধু এতটুকু জানি যে, একটা মিথ্যাকে সত্য বানানোর জন্য আরো অনেকগুলো মিথ্যা জুড়ে দিতে হবে। কাজটা আমি নিখুঁতভাবে করে যাচ্ছি। বললাম, সে আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল কারণ আমি তাকে সময় দিতাম না। সে শুধু একটু সময় চাইতো আর আমি সেটাও তাকে দিতাম না। আমি সব সময় ভাবতাম, সে আমাকে প্রচুর ভালোবাসে, তার পক্ষে আমাকে ছেড়ে যাওয়া কখনোই পসিবল না। রিয়া বলল, তো তোমার এসব আশা ভেঙে দিয়ে সে চলে গেল কেন?
আমি বললাম, আমি একটু বেশি ভেবে ফেলছিলাম। কিন্তু রিপভ্যান উইংক্যাল-এর মতো আমার ঘুমের ভেতর বদলে গেল আমার প্রেমিকা। একদিন বিকেলে জানতে পারি সে নতুন রিলেশনশিপে ঢুকে গেছে। সে আর আমার নাই।
এটা কত বছর আগের ঘটনা? রিয়া জানতে চাইলো।
চার বছর আগের। তখন আমার কলেজ সবেমাত্র শেষ হওয়ার পথে।
সে চলে যাওয়ার পর তোমার কষ্ট হয়নি? রিয়ার মনখারাপ হতে লাগলো ধীরে ধীরে। সেটা তার চোখ বলে দিচ্ছে।
আমি বললাম, সে চলে না গেলে তোমাকে পেতাম? চলে গিয়ে ভালোই করেছে।
আমি দেখতে পাচ্ছি রিয়ার চোখগুলো কেমন জানি নরম হয়ে আসছে। নিজেকে খুব ছোট মনে হলো। এই মিথ্যে গল্পটার জন্ম দিয়ে বুঝতে পারলাম, একটা ভুল গল্পের জন্ম দিয়ে ঠিক করিনি। আসলে আমি দেখতে চেয়েছিলাম যে, সে কেমন রিয়েক্ট করে। আপন মানুষগুলোকে এত সহজে কাঁদানো যায়, সেটা জানতাম না। কত কিছুই আমি জানি না! কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। একটা খুব চেনা সুর দুজনের বুকে বেজে ওঠে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। একটু পাশে গিয়ে তাকে কাছে টানলাম। জড়িয়ে ধরে বললাম, এটা একটা মিথ্যা গল্প রিয়া। তুমি একজন স্টোরিটেলারের প্রেমিকা, এটা নিশ্চয়ই জানো?
রিয়া কথা বলে না। মাথাটা ওপর করে। তারপর কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশে এলোমেলোভাবে কিছু কাক উড়ছে। মনে হচ্ছিল সে জেদ ধরে বসে আছে। যেন আকাশের সবগুলো কাক গুনে শেষ করে ফেলবে। খুব সম্ভবত রাষ্ট্রীয়ভাবে ঢাকা শহরে কয়টা কাক আছে সেটা গুনে দেখার দায়িত্ব তার ওপর পড়েছে। আমিও খুব কষ্টে তার সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটার একটা মানে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।