অপচয় ও প্রাসঙ্গিক

ড. আনোয়ারা আলম »

মানুষের জীবন বড়ো বৈচিত্র্যময় আর এটি আবার একপ্রকার সৌন্দর্যও। আর এ জীবনে সাফল্য অর্জন আর অপচয় শব্দ দুটো আপেক্ষিক। অপচয় মানে আয় কঠিন হলেও ব্যয় করা সহজ। অর্থাৎ আয়ের অধিক ব্যয় হচ্ছে অপচয়। যা একজন মানুষকে আজকের রাজা কালকের ফকির বানাতে পারে।
সমাজে অনেক অনেক বিত্তশালীর এতো এতো খরচ বিলাসিতা যদিও আয়ের উৎস বৈধ না অবৈধ আমরা জানিনা। আমোদ প্রমোদ, বিয়ের আয়োজনে বা নানা উৎসবে খরচের যে বাহুল্য তা দেখে মনে হয় আমরা যেন এক অতি উন্নত দেশে। যদিও দেশের অধিকাংশ নি¤œ বা মধ্যবিত্তদের দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে জীবন দিশেহারা। এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিশাল কেকের বহরে মনে হয়না আমরা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় আছি। অনেক উন্নত বিশ্বে খাদ্যে রেশনিং চলছে।
কেউ বলতে পারেন জীবনটাই তো সমন্বয়। অথচ শেষ প্রান্তে এসে অনেকে ভাবি হায় বেলা যে বয়ে গেল। জীবনের সব কাজ সাঙ্গ করে দেখি আশেপাশে কেউ নেই। এটি কি জীবনের সময়ের অপচয়? দার্শনিক ব্যাখ্যা থাক। বাস্তবতায় দেখি প্রতিনিয়ত কতো অপচয়। খাদ্যের অপচয়, সম্পদের অপচয়, সময়ের অপচয় এবং বিশেষত জাতীয় সম্পদের অপচয়।
সম্ভবত বাঙালির মতো খাদ্যের এতো অপচয় আর কোন জাতি করে কিনা সন্দেহ। ২০২২ সালের বিবিসির এক জরিপে বলা হচ্ছে, প্রথমত খাবার উৎপাদন থেকে খাবার টেবিলে পর্যন্ত যতো খাদ্য উৎপাদন হয় তা খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত পৌঁছাতে যে অপচয় হয় তা অভাবনীয়।
২০২১ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক ইউনেস্কো কতৃক ফুড ইনডেক্স নামে রিপোর্ট বলছে- ‘বাংলাদেশে বছরে এক কোটি ডলার টন খাদ্য অপচয় হয়।
সম্ভবত বাঙালির মতো খাদ্যের এতো অপচয় আর কোন জাতি করে কিনা সন্দেহ। ২০২২ সালের বিবিসির এক জরিপে বলা হচ্ছে, প্রথমত খাবার উৎপাদন থেকে খাবার টেবিলে পর্যন্ত যতো খাদ্য উৎপাদন হয় তা খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত পৌঁছাতে যে অপচয় হয় তা অভাবনীয়।
২০২১ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক ইউনেস্কো কতৃক ফুড ইনডেক্স নামে রিপোর্ট বলছে-‘ বাংলাদেশে বছরে এক কোটি ডলার টন খাদ্য অপচয় হয়।
খাদ্যের ক্ষেত্রে দু’ভাগে অপচয় হয়। উৎপাদকের কাছ থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে যে অপচয় তা ফুড প্রসেস লষ্ট আর ভোক্তারা যে অপচয় করে তা ফুড লস্ট। দুটোই অপচয়। কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ কিন্তু রাষ্ট্র ও জনগণের হাতে। যা নিয়ে আমরা ভাবি না বা সিন্ডিকেট ভাঙতে পারি না। যেমন সরকার খাদ্যের দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিল। সাথে সাথে বাজার থেকে জিনিস উধাও। অতঃপর আবারও যেই লাউ সেই কদু। এক্ষেত্রে ভোক্তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া একটা সমাধান হতে পারে। কিন্তু ঐ যে অনেকের আছে অনেক অনেক। আর অনেকের পেয়ালা শূন্য। তাই ফুড লস্ট নামক অপচয় বন্ধ করা কঠিন হয়ে যায়।
শুধু খাদ্যের অপচয়ের কথাই শেষ কথা নয়। আরও নানাভাবে আমরা অপচয় করছি।
কারা এরসাথে জড়িত। আমি বলি তাঁরাই যাদের আয়ের উৎস অবৈধ। বা যাদের ভেতরে মানুষের প্রতি ভালোবাসা নেই। এখানে উল্লেখ করতে হয় একজন কিউবান কবি হোসি মার্তির কবিতার একটা লাইন- ‘জগতের সকল মানুষের কীর্তি গৌরব একটি শস্যদানার মধ্যেই লুকিয়ে রাখা যায়, তাহলে কেন ভিত্তি প্রস্তরে লেখা’ এটিও কি অপচয় নয়! প্রশ্নটা এখানেই। অর্থাৎ মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন। যে কারণে আমরা মানসিক ও সামাজিক কারণে নানাভাবে অপচয় করেও বুঝিনা আমরা অহেতুক ব্যয় করি।
এবারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অপচয় কেমন। দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হলো,‘সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল’। ব্রিটিশ শাসকেরা ও দক্ষিণ এশিয়াতে গণপূর্ত বিভাগ থেেেক অপচয় দূর করতে পারেনি। এখানে অপচয়ের উৎস হচ্ছে দুর্নীতি। উন্নয়নশীল দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অপচয় অভিন্ন।
সুকুমার সেন জানাচ্ছেন, অপচয় শব্দের অর্থ মূল্যবান দ্রব্য রক্ষা না করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে ব্যর্থতাই হচ্ছে অপচয়। যেমন সরকারি ক্ষেত্রে পতিত জমি ফেলে রাখাও অপচয়।
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়ের দুটি দিক আছে। প্রথমত সরকারি ব্যয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আছে কিনা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি অর্থ ব্যয় করতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগে। অনুমোদনহীন ব্যয় হচ্ছে অপচয়। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেখানে ব্যয়ের পরিমাণ উপকারের আর্থিক পরিমাপের চেয়ে বেশি, সেখানে অর্থের অপচয় ঘটে। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবস্থাপকেরা নিজের সম্পদের যত যতœ নেন, সরকারের সম্পত্তির ততো খোঁজখবর নেন না। এখানে অপচয় হচ্ছে নৈতিক দৃষ্টিকোণ তথা দেশপ্রেমের অভাব।
অপচয়ের বহুমাত্রিক ধারণা। তাই স্ট্যানবেরি ও টমসন (১৯৯৫) নামে দুই অর্থনীতিবিদ বলছেন অপচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণই হচ্ছে অপচয় হ্রাসের প্রথম পদক্ষেপ।
সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতির কারণে অপচয় হতে পারে,দ্বিতীয়ত অদক্ষতা ও অযোগ্যতা অপচয়ের জন্ম দিতে পারে, তৃতীয়ত, সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব অপচয় সৃষ্টি করতে পারে, চতুর্থত অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের একই সঙ্গে ভালো ও খারাপ প্রভাব থাকতে পারে। আমাদের দেশের মতো দেশগুলোতে অদক্ষতা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের লোভ লালসা থেকে অনেক সময় অপচয় হয়। বাস্তবতা হলো বোকামি নয় বরং অতি চালাকির জন্য অপচয় হয়।
সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি বিষয়ে অনেক আগে কৌটিল্য তাঁর অর্থ শাস্ত্রে বলেছেন – ‘জিভের ডগায় মধু অথবা বিষ এলে যেমন না চেটে থাকা যায় না, তেমনি সরকারি অর্থ যারা নাড়াচাড়া করেন তারা রাজার সম্পদের ছিটেফোঁটা হলেও না খেয়ে থাকতে পারেন না।’ তিনি মৃত্যুদ- প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন। হায়! কৌটিল্য!
চোখের সামনে কতো প্রকারের অপচয়!!! আর শাস্তি!!! মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
পারিবারিকভাবে অপচয় বন্ধে অভিভাবকদের নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন হতে হবে। নিজেরা যেমন সততার সাথে আয় করবেন তেমনি ব্যয়ের ব্যাপারে ও বিবেকের অনুশাসনে নিজেদের পরিচালিত করবেন। আমাদের শৈশব কৈশোরে খাওয়াদাওয়া যেমন তেমনি উৎসব পার্বণে প্রথমত গরীব আত্মীয় স্বজনের ব্যাপারে ভাবতে বলা হতো। আর এখন পোশাকআশাক একটি হলে হবে না কমপক্ষে দুই বা তিন। এখানে নীরব প্রতিযোগিতাও চলে।
আর নানা উৎসবে অনেকের অপচয় একটা প্রদর্শনের বিষয় হয়ে মধ্যবিত্তদের জীবনেও নানা বিপর্যয় ডেকে আনছে। এই আত্মসংযমের বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে যেমন তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। পরিবার থেকে সমাজেও তখন অপচয় রোধের একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত ও সাহসী কর্মকর্তা ছাড়া অপচয় রোধ কঠিন। অথচ একটি সুবিন্যস্ত অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য নিরীক্ষার কোন বিকল্প নেই।
তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে অপচয় রোধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় জনসচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে।
পরিশেষে বলতে হয়, সবচেয়ে বড়ো বেশি প্রয়োজন দেশপ্রেম। যা শুরু করতে হবে প্রথমত পরিবার থেকে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।
অপচয় রোধের মাধ্যমে আমাদের যতোটা সম্ভব আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই হোক আমাদের প্রত্যাশা।