অনগ্রসর উপকূলে শিল্পসংস্কৃতি : বিকাশ ও পারিপার্শ্বিকতা

সুব্রত আপন :

ভূমিকা : বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে সাগরবেষ্টিত পাহাড়সমৃদ্ধ দ্বীপ মহেশখালী। সৌর্ন্দযের অনুপম আধার, মোহনীয় এ লীলাভূমি। একদিকে সমুন্নত পর্বতশৃঙ্গ দেখে-দেখে দ্বীপ এলাকার মানুষের মন যেমন হয়েছে উন্নত, তেমনি অসীম নীলসমুদ্রের উত্তাল আহ্বান শুনে-শুনে হৃদয় হয়েছে প্রশস্ত। মহাসমুদ্রের সুরের আনন্দে দ্বীপবাসী ঝিমিয়ে পড়ে, আবার ভোরের পাখির ডাক ও সমুদ্রের গর্জনে ঘুম ভাঙে। অরণ্যছায়া ও পুষ্পমঞ্জরি উপসাগরের এমন মাধুর্য ও মানবপ্রকৃতির সাথে এমন অকৃত্রিম সৌন্দর্য অতুলনীয়। মহেশখালীর মিষ্টিপান, লবণ ও চিংড়ি দেশে-বিদেশে যেভাবে খ্যাতিলাভ করেছে তেমনি  মৈনাক পর্বতের চূড়ায় আদিনাথ মন্দির দেশের গ-ি পেরিয়ে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকাসহ অনেক দেশের মানুষের তীর্থস্থান হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। পূর্বেকার ইতিহাস পড়ে জানতে পেরেছি, মহেশখালী চ্যানেল দেশের মূলভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল এক সময়। পরে বদরখালী জনতা বাজার ব্রিজ দ্বারা সংযুক্ত হওয়ায় চকরিয়া উপজেলার সাথে সংযোগ পথ সৃষ্টি হয়েছে। ছোট-বড় তিনটি দ্বীপ নিয়ে মহেশখালী উপজেলা গঠিত। মহেশখালীর উত্তর-পূর্বে চকরিয়া উপজেলা, দক্ষিণ-পূর্বে কক্সবাজার সদর, দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, উত্তর-পশ্চিমে কুতুবদিয়া উপজেলা। মহেশখালী ১৯২৬-১৯২৭ সালের দিকে আলাদা থানার স্বীকৃতি পায়। উপজেলার সৃষ্টি হয় ১৫ ডিসেম্বর ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে। দ্বীপ এ উপজেলায় একটি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন। জনসংখ্যা প্রায় চার লক্ষের কাছাকাছি। মহেশখালীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম, অল্পসংখ্যক হিন্দু-বৌদ্ধ ও অন্যান্য সম্প্রদায়। মহেশখালী দ্বীপাঞ্চল হলেও এখানে জনঘনত্ব বেশি। মহেশখালীতে রয়েছে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান। তার মধ্যে আদিনাথ মন্দির, বুদ্ধ মন্দির, গোরকঘাটা জেটি, লবণ মাঠ, শুঁটকিমহাল, উপজেলা পরিষদ দিঘি, সৌন্দর্যের লীলাভূমি সোনাদিয়া, মৈনাক পাহাড়, সারি-সারি প্যারাবন ও চিংড়িঘের।

শিল্পসাহিত্যচর্চার প্রয়োজনীয়তা : দ্বীপাঞ্চল মহেশখালীতে প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষের বসবাস থাকলেও বেশির ভাগই শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর। মৌজায় বিভক্ত মহেশখালী দ্বীপের আয়তন ৩৮৮.৫০ কিলোমিটার। দ্বীপাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ চাষাবাদ ও মৎস্য আহরণে সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে শিক্ষার পাশাপাশি শিল্পসাহিত্যের পথ থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছে। সাহিত্য বিষয়টি অনেকটা দীর্ঘমেয়াদি ও ‘অলাভজনক’ হওয়ায় এ পথে আসতে অনেকেরই আপত্তি। সাধারণ মানুষের ধারণা, বর্তমান সময়ে সাহিত্যচর্চা সময়ক্ষেপণ ছাড়া কিছুই নয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে পূর্বকার অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকদের মতো নিজের অবস্থান জানান দেওয়া অনেকটা দিনের বেলায় চাঁদের আলো দেখার শামিল। কেউ-কেউ সাহিত্যচর্চার নিবিড় মন নিয়ে কিছুদিন বিচরণ করলেও নানা মানুষের উদ্ভট কথাবার্তায় হতাশ হয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মহেশখালীর অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করলেও তারা নির্দিষ্ট সিলেবাসের গ-ি পেরোতে চায় না। নিজেদের নৈমিত্তিক সিলেবাস শেষ করাটাই মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়ায়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানুষ নিজেদের জীবনকে করে ফেলেছে রোবটের মতো। যান্ত্রিক শহরে বসবাস করা মানুষের মনও হয়েছে অনেকটা পাথরের মতোই। যে-অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী আছেন এখানে তাদের লক্ষ হলো, লেখাপাড়া শেষ করেই জীবনধারণের জন্য একটি উপযুক্ত চাকরি চাই। চাকরি-পরবর্তী বিয়ে-শাদি। এভাবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়াই হচ্ছে যেন শেষকথা। বলতে গেলে কারো তেমন কোনো  মাথাব্যথা নেই শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতির অনুধাবনা বা অগ্রগতি বিষয়ে। খুব অল্প-অল্পসংখ্যক অনুরাগী আছেন ‘অলাভজনক’ এ পথে। তবে বর্তমানে শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়া অধ্যায়গুলো পুনরায় উজ্জীবিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন মহেশখালীর একঝাঁক তরুণশিল্পী, কবি ও সাহিত্যকর্মী।

শিল্প-সাহিত্যের প্রসার : বহুকাল থেকে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে দ্বীপাঞ্চল মহেশখালী। এখানে ৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, ১১টি বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়, ১৪টি দাখিল মাদ্রাসা, ৪টি সিনিয়র মাদ্রাসা, ৪টি কলেজ থাকলেও সাহিত্যচর্চার জন্য নেই কোনো  শক্তপোক্ত প্ল্যাটফর্ম। একুশে পদকপ্রাপ্ত উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর মতো একটি সংগঠন এখানে থাকলেও তাদের সাংগঠনিক কর্মবিরতি, দীর্ঘদিন অনুষ্ঠানবিহীন সময়ক্ষেপণ সৃজনশীলতার স্রোতধারাকে স্থবির করে রেখেছে। উক্ত সংগঠনটি ছাড়া শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতি প্রসারে সরকারি-বেসরকারিভাবেও কোনো প্রতিষ্ঠান না-থাকায়  কালের বিবর্তনে শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতি কি, মানুষ যেন তাও ভুলতে বসেছে। বহু আবেদন-নিবেদন ও প্রতিবাদের নিরিখে মহেশখালী শিল্পকলা একাডেমি পরিচালনা কমিটি নির্বাচিত হওয়ার প্রায় বছর দুয়েক অতিক্রম হতে চললো। উক্ত কমিটিও শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। উপজেলার কিছু উঠতি কলমসৈনিকের আবেদনের প্রেক্ষিতে মহেশখালীতে সরকারিভাবে উপজেলা পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হলেও নানাবিধ জটিলতা ও অতিমারি করোনার প্রভাবে একমাত্র পাবলিক লাইব্রেরিটিও বন্ধ হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এখানকার শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতির পিছিয়ে পড়া অধ্যায়গুলো পুনরায় নতুন উদ্দীপনায় জাগিয়ে তুলতে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছে মহেশখালীর একঝাঁক তরুণ লেখক, শিল্পী, শিল্পবোদ্ধা, কবি ও সাহিত্যকর্মী।

‘মৈনাক’ সম্মাননা প্রদান : শুরুতেই বলেছি, সাহিত্যচর্চাকে মনমচর্চার বিষয় হিসেবে না-দেখে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয় হিশেবে দেখা খুবই বেদনাদায়ক। এভাবেই এসেছে  ‘অলাভজনক’ শব্দটি। সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় মানুষ শিল্পসাহিত্যের কাছে সমর্পিত হয়। র্শিপসাহিত্যের চর্চা মানুষের ভেতরে জাগিয়ে মানুষ্যত্ব। সুন্দরের প্রতি, সুদূরের প্রতি আগ্রহ। সর্বোপরি, নিজের দেশ, মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে তাদের সুখে-দুঃখে নিজেকে জড়িয়ে আনন্দ পাওয়ার সাধনাই শিল্পসাহিত্য চর্চার আসল লক্ষ। কবিসত্তা এমন একটি সত্তা যেখানে কোনো মোহ ও পাওয়ার আকাক্সক্ষা থাকে না। কবির কোমলমনের পবিত্র আত্মায় পরকালের ভীতি নেই, শেষ জীবনের কঠিন পরিণতি নিয়েও হা-হুতাশ নেই। কে কি বলেছে তার ধার ধরার সময় নেই কবিসত্তার। তাঁর মনের জগতে যে-নিষ্পাপ সৌন্দর্য বিরাজমান, তাই-ই তাঁকে নির্লোভ ও সুন্দর মনের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলে। জীবন চলার পথে কবি-শিল্পীরা নানা বাধাকে উপেক্ষা করে সাহিত্য-শিল্পের পথে হাঁটেন জীবনে বহুদূর যাবেন বলে। যে বা যাঁরা কবিতাকে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁরা হয়তো সাহিত্যের ভুবনে কিছুদিন বিরাজ করবেন ঠিকই, কিন্তু বৃহত্তর সাহিত্যচেতনার দিকে যাঁরা ধাবিত হয়েছেন, যাদের রক্তে মিশে গেছে সাহিত্য তাঁরা কখনোই সাহিত্যকে পেছনে ফেলে জীবনযাপন করতে পারেন না। যাঁরা  বৈষয়িকভাবে পাওয়ার আকাক্সক্ষা না রেখে শুধুমাত্র সাহিত্য ভালবেসে জীবনের পথ সমৃদ্ধ করার চেষ্টায় আছেন অর্থাৎ যাঁরা বাংলা সাহিত্যের পথে অবদান রেখে চলেছেন তাদেরকে সম্মানিত করার জন্য মহেশখালীতে গঠিত হয়েছে ‘দ্বীপাঞ্চল সংস্কৃতি অঙ্গন’। এই সংগঠনের ব্যানারে ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকার সহকারী অধ্যাপক কবি কামরুল হাসানকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ‘আদিবাসী কাব্যের স্রষ্টা’ কবি হাফিজ রশিদ খানকে ‘মৈনাক সম্মাননা’ দেয়া হয় গত ২৩ জুন তাঁর জন্মদিনে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কবি কামরুল হাসান, কবি জাহেদ সরওয়ার, কবি সাইয়্যিদ মঞ্জু, কবি সুব্রত আপন, কবি রুদ্র সাহাদৎ, শিল্পী জাহান এবি, শিল্পী শাফায়েত জামিল দিদার, শিল্পী রশিদ খান, চিত্রশিল্পী আর. করিম প্রমুখ।

গুণীজনেদের সম্মান জানানো ও তাঁদের কীর্তিকে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরার এ প্রচেষ্টা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে ‘দ্বীপাঞ্চল সংস্কৃতি অঙ্গন’। এর উদ্যোক্তাদের এই হলো দৃপ্ত অঙ্গীকার।