২১ বছর পর বঙ্গোপসাগরে সুপার সাইক্লোন ‘আম্ফান’

মোংলা ও পায়রায় ৭, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত

রায়মঙ্গল নদীর মোহনা দিয়ে প্রবেশ করতে পারে ঘূর্ণিঝড়টি

ভূঁইয়া নজরুল :

বছরের এই সময়ে বঙ্গোপসাগরে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। গত বছর যেমন ‘ফনি’ আমাদের ভুগিয়েছে। এবার ভোগাতে আসছে ‘আম্ফান’। তবে বঙ্গোপসাগরে গত ২১ বছরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে সুপার সাইক্লোন তকমা নিয়ে আসছে। ১৯৯৯ সালে উড়িশ্যা সাইক্লোন নামে একটি ঘূর্ণিঝড় ২৫ অক্টোবরে সৃষ্টি হয়ে ৩ নভেম্বরে উড়িশ্যার উপর দিয়ে আঘাত করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে ক্ষয়ক্ষতি করেছিল। সেটি ছিল সুপার সাইক্লোন। আর সেই ঘূর্ণিঝড়ের পর এবার সৃষ্টি হলো সুপার সাইক্লোন ‘আম্ফান’। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর এটিকে সুপার সাইক্লোন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের ওয়েবসাইটে তাদের ১৩ নম্বর বুলেটিনে বলেছে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সাগরে থাকতেই সুপার সাইক্লোন হিসেবে রেকর্ড হবে। তবে উপকূলে আঘাতের সময় এর গতিবেগ কমে শক্তিশালী সাইক্লোনে পরিণত হবে। অপরদিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এটিকে তাদের ২০ নম্বর বুলেটিনে আম্ফান কে সুপার সাইক্লোন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

সুপার সাইক্লোন কেন?

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের ওশেনোগ্রাফি বিষয়ক একটি প্রকল্পের ডেপুটি টিম লিডার সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, যদি কোনো ঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় ২২০ কিলোমিটারের বেশি ( টানা তিন মিনিট) থাকে তখন তাকে সুপার সাইক্লোন বলা হয়। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের গতিবেগ ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর দেখিয়েছে ২৪০ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ২০ নম্বর বুলেটিনে ২৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত রেকর্ড হতে পারে বলে উলেস্নখ করেছে। সেই হিসেবে তা সুপার সাইক্লোন।’

এর আগে কবে সুপার সাইক্লোন হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে ১৯৯৯ সালে উড়িশ্যা সাইক্লোন নামে একটি সাইক্লোন হয়েছিল সেটিকে সুপার সাইক্লোন বলা হয়ে থাকে। সেটার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার।

এদিকে ২০০৭ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত করা ঘূর্ণিঝড় সিডরের গতিবেগ ছিল ২১৫ কিলোমিটার।

স্যাটেলাইট চিত্রে সুপার সাইক্লোন আম্পানের গতিপথ

কোন দিকে আঘাত করবে এই ঘূর্ণিঝড়?

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মলিস্নক বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি খুবই শক্তিশালী একটি ঝড়। এর পরিধিও অনেক বড়। এটি দেশের খুলনা ও চট্টগ্রাম উপকূলের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করবে।

এতো বিশাল এলাকার উপর দিয়ে কিভাবে অতিক্রম করবে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, পুরো উপকূলীয় এলাকা ক্ষতিগ্রসত্ম হবে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে খুলনা ও বরিশাল উপকূলীয় এলাকা। এজন্য সেসব এলাকায় বিপদ সংকেত সাত দেখানো হয়েছে এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজারকে ছয় নম্বর দেখানো হয়েছে।

আবহাওয়া বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইট বিশেস্নষণ করে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের বালেম্বর হলদিয়া ও কলকাতার খড়গপুর আঘাতের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী রায়মঙ্গল নদীর মোহনা দিয়ে প্রবেশ করবে। প্রবেশের সময় তা স্থল নিম্নচাপ আকারে সাতড়্গীরা, কুষ্টিয়া ও যশোর হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হবে। ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট, আকুওয়েদার ও ওয়েদার আন্ডারগ্রাইন্ড দেখে তাই মনে হচ্ছে। একই মন্তব্য করেন বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ সমরেন্দ্র কর্মকারও।

এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের ডান দিকে বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশাল ডান দিকে থাকবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই এলাকায় বেশি ক্ষতি হবে।

এবারো রক্ষা করবে সুন্দরবন

২০০৭ সালে ডিসেম্বরে আঘাত করা সিডরে দেয়াল হিসেবে কাজ করেছিল সুন্দরবন। সেবার এই সুন্দরবনের কারণে শক্তিশালী সেই ঘূর্ণিঝড়ে তেমন ব্যাপক ক্ষতি হয়নি দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে। এবারো কি একই অবস্থা হবে? এমন প্রশ্ন করা হলে আবহাওয়া অধিদপ্তর পতেঙ্গা কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন,‘ সুন্দরবনের কারণে দেশের ওই এলাকাটি শক্তিশালী ঝড়গুলো থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পায়। সুন্দরবনে আঘাতের পর এর গতিবেগ কমে যায়।

৭০০ কিলোমিটার ব্যাস আম্ফানের

এবারের ঘূর্ণিঝড়ের পরিধি কতো কিলোমিটার জানতে চাইলে বিশ্বজিত চৌধুরী বলেন, ৭০০ কিলোমিটার ব্যাস আম্ফানের। পুরো বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় প্রভাব পড়তে পারে এই ঝড়ে।

বাংলাদেশ উপকূলের দৈর্ঘ্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আবুল কালাম মলিস্নক বলেন, খুলনা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যদি সোজা সরলরেখা টানি তাহলে ৩০০ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্য হবে না। তাই এবারের ঘূর্ণিঝড়টি পুরো এলাকায় প্রভাব বিসত্মার করবে। তবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে খুলনা, বরিশাল উপকূলীয় এলাকায়।

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ২০ নম্বর বুলেটিনে বলা হয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান গতকাল সোমবার রাত ৯ টায় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ১০২০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে ৯৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা থেকে ৯২০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা খেকে ৯১০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে উত্তর উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘন্টায় ২২৫ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রভাবে সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়টি আজ মঙ্গলবার দিবাগত মধ্য রাত থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত খুলনা ও চট্টগ্রামের উপকূলের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে পারে। এজন্য মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ছয় নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রমের সময় উপকূলীয় এলাকায় প্রচন্ড গতিতে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ঘটাতে পারে। এজন্য সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং এসব এলাকার পাশ্ববর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে স্বাভাবিকের চাইতে চার ও পাঁচ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। এসব এলাকায় ঘন্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে।

চলতি মাসের আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বঙ্গোপসাগরে এক বা একাধিক নিম্নচাপ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। এসব নিম্নচাপ থেকে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনাও বলা হয়েছে।  বছরের এসময়ে সাগরে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়ে থাকে। এপ্রিল-মে ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম।