স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী সামনে রেখে

সাধন সরকার »

কবি সুকান্তের ভাষায়- ‘শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে বয়; জ¦লে পুড়ে মরে ছারখার, তবুও মাথা নোয়াবার নয়।’ বাঙালিকে কখনো দমিয়ে রাখা যায়নি। পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার প্রায় ১৯০ বছর পর সৃষ্টি হয় উপমহাদেশের দুটি দেশ পাকিস্তান ও ভারত। আর পাকিস্তানের শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্যে ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে বাঙালি তথা পূর্ব বাংলার জনগণ দিনের পর দিন নিষ্পেষিত হতে থাকে।
এ সময় মুক্তির মহানায়ক হিসেবে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করে তোলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি স্বাধিকার আন্দোলনে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে এদেশে গড়ে ওঠেছিল জাতীয় ঐক্য। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে ছিল সমগ্র জাতি। আর সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করা ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সহজতর হয়েছিল।
লাখো শহিদের রক্তে রাঙানো আমাদের স্বাধীনতার সূর্য। স্বাধীনতা মানে চিন্তার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন! স্বাধীনতা তখনই গণমানুষের কাছে অর্থবহ ও সার্থক হয়ে ওঠে যখন প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে এবং মানুষ যখন তাদের নাগরিক অধিকারগুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ পায়। স্বাধীনতা মানে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার চিরন্তন প্রয়াস। স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হয়। সর্বদা সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ না হলে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যায় না।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা রেখেছে বাংলাদেশ। সুবর্ণজয়ন্তীর কাছাকাছি সময়ে উপনীত হয়েছি আমরা। বাংলাদেশ বিশে^ আজ উন্নয়নের রোল মডেল! সমৃদ্ধির অদম্য অগ্রযাত্রার পথে রয়েছে বাংলাদেশ।
গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাক শিল্পের প্রবৃদ্ধিও ভালো। গত কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে।
২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার পাশর্^বর্তী অন্যান্য দেশের থেকে এগিয়ে রয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রেও সাফল্য আসছে। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রবেশও বাড়ছে।
শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভালো অবস্থানে আছে। গড় আয়ু বেড়েছে। বেড়েছে সাক্ষরতার হার। পদ্মা সেতু এখন শুধু স্বপ্ন নয় বাস্তব। করোনা-কালের মধ্যেও বাংলাদেশের অদম্য অগ্রযাত্রা থামেনি! স্বাধীনতার এ স্বপ্নযাত্রায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে সামনের দিনগুলোতে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে আরও বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
আমাদের অর্জনের পাশাপাশি বিসর্জনের দিকগুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতার স্বাদ পরিপূর্ণভাবে মানুষের কাছে পৌঁছেছে কি ? এখনো সম্প্রীতির দেশে মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে! আবার রয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের বিশ^ায়ন। সাম্প্র্রদায়িকতা, মৌলবাদ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এখনো বাঙালির মর্মমূলে ঝাঁকুনি দেয়। শিক্ষা খাতের অনিয়ম নিয়ে এখনো কলম ধরতে হয়। নারীর নিরাপত্তা, চিকিৎসা খাতে নৈরাজ্য, খাদ্যে ভেজাল, দুর্নীতি, পরিবেশ সমস্যাসহ নানা অনিয়ম যেন প্রতিদিনকার সমস্যা! এসব সমস্যা নিয়ে আজ ভাবনার সময় এসেছে।
মুক্তিযুদ্ধে শহিদের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ হবে সব ধরনের অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্যহীন। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদেরকে হতাশ হতে হচ্ছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি বাড়ছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করা হচ্ছে।
একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, আইন বাস্তবায়ন ও মানার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশে^ পেছনের সারির দেশগুলোর একটি! নিপীড়িত-নিরীহ মানুষের অধিকার আদায় এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে! মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কতদূর এগোতে পেরেছি আমরা ? ক্ষমতা ও রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে অনেকে ফায়দা লুটছেন, অনিয়ম করছেন।
রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কারণে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন, অনেকে আবার রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে হাবুডুবুু খাচ্ছেন। সংবিধানের চার মূলনীতির নিরঙ্কুশ অধিষ্ঠান এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি! অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এখনো বঞ্চিত, উল্টো অনেক অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধার খেতাব নিয়ে সুবিধা নিচ্ছেন! এসব অনিয়ম রুখতে তরুণ জনগোষ্ঠীকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সমসাময়িক কালে স্বাধীন হওয়া কোনো কোনো দেশ আমাদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। তাই এগিয়ে যাওয়ার স্বার্থে আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দিতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগে সবার জন্য সমান হতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সবার জন্য সমান ও যথাযথ আইনের প্রয়োগে সব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর হবে। সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অর্থপাচার রোধ করতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। ধনী-গরিবের বৈষম্য কমাতে অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে হবে। বৈষম্য কমাতে অর্থনৈতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করাও অপরিহার্য। মত প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা চাই। শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মূল্যবোধ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবার আগে তরুণদেরই যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। পরিকল্পিত উন্নয়নের ধারা আরও বেগবান হোক, সবাই এর সুফল পাক, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে যাক- মানুষ এটাই চাই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও পরিবেশকর্মী
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫@মসধরষ.পড়স