বই হোক সঙ্গী, বই পড়ে আলো ছড়াই

ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন :

চেতনা, গৌরব, আত্মত্যাগ ও ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এই মাস এলেই আমাদের ভাষাপ্রেম জেগে ওঠে, শুরু হয় নানা অনুষ্ঠান। শুধু আমাদের জন্য ফেব্রুয়ারি মাস হয়ে ওঠে ভাষার মাস যা নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতায় পালিত হতে থাকে। যেমন বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণে আলোচনা অনুষ্ঠান, বইমেলা ইত্যাদি। দেশে এ উপলক্ষে চলে একুশে উদযাপনের কর্মসূচি, যেমন আলোচনা সভা, আবৃত্তি, গান ইত্যাদি। আর তা এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। দিন দিন কমতে থাকে বই এর প্রতি আগ্রহ, কেটে যায় মোহ কিন্তু তা হবে কেন? আসুন এ ধারনা থেকে বেরিয়ে পড়ি।

মোটামুটিভাবে পৃথিবীর সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন নতুন পৃথিবীর সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। আর এই জ্ঞান আহরিত হয় বই পড়ার মাধ্যমে। যত বেশি পড়বে ততবেশি জ্ঞান আহরিত হবে। একটা সময়ে বই ছিল আমাদের প্রধান বিনোদন, আমরা শৈশবে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলেছি, বাসায় এসে ঘাড়গুঁজে গল্পের বই পড়েছি। এখন বিনোদনের কোনো অভাব নেই। প্রযুক্তির বদৌলতে একেবারে দুধের শিশুটিও ইউটিউবে কার্টুন দেখতে দেখতে তার দুধের বোতল মুখে দেয়। স্মার্টফোন, নোট প্যাড, ল্যাপটপ আর টেলিভিশনের স্ক্রিনের বিনোদন যত তীব্রই হোক না কেন, বই পড়ার সঙ্গে তার কোনো তুলনা নেই।

বই পড়া হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কের একটি অসাধারণ প্রক্রিয়া, যেটি আমাদের একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়। বই পড়ার মাধ্যমে আমরা পরিচিত হই নতুন নতুন বিষয়ের সাথে। আর এই বই বিষয়ে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বলেছেন, ‘বই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক।’ জ্ঞান আর আনন্দ ছাড়া মানুষের জীবন নিশ্চল হয়ে পড়ে। জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত করতে হলে, সুবাসিত করতে হলে জ্ঞানার্জন করতে হবে। আর জ্ঞানার্জনের জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।

পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞানের কথা লুকিয়ে আছে বইয়ের মধ্যে। সুতরাং নিজেকে জানতে হলে, পৃথিবীকে জানতে হলে বই পড়তে হবে। তাই হয়তো আমেরিকান বিখ্যাত অভিনেতা উইল রজারস বলেছেন, ‘মানুষ আসলে দুটি উপায়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। একটি হচ্ছে পড়ার মাধ্যমে আর আরেকটি হচ্ছে নিজের চেয়ে আধুনিক কোনো মানুষের সঙ্গে মেশার মাধ্যমে।’ ইংরেজিতে একটি কথা আছে, যার বাংলা হচ্ছে, ‘বই মানব জীবনের উৎকৃষ্ট সঙ্গী।’ আমরা বাস্তব জীবনে অনেক সময় বিপদাপন্ন হই। বিপদ আসে বাইরে থেকে, বিপদ আসে মনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকেও। আর সেই বিপদ মুহূর্তে অন্য মানুষের কাছে পরামর্শ নিতে গেলে অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়ে থাকি। কিন্তু প্রকৃত বই বিপদের সময় যথার্থ বন্ধুর মতো আমাদের সঠিক পরামর্শ দান করে। কোনো কোনো বই পাঠককে হাসাতে পারে, আনন্দ দিতে পারে এবং কোনো কোনো বই জ্ঞান ও নতুন তথ্য দিতে পারে। তাই প্রত্যেককেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।

বইয়ের সান্নিধ্যে আসা মানেই মহামনীষীদের সান্নিধ্য লাভ। দার্শনিক ও নাট্যকার বার্ট্রান্ড রাসেল আমাদের জীবনের রূঢ় বাস্তবতা ও জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে বইয়ের মাঝে ডুব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বইয়ের নির্দেশনায় মানুষ খুঁজে পায় সংগতি, সামঞ্জস্য ও এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা। সাধারণত ‘বন্ধু’ শব্দটি কতই মধুর! বন্ধুত্ব নৈকট্যের পরিচয়বাহী, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও হৃদ্যতা এবং পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও মানসিক বন্ধনের প্রতীক। বন্ধুত্বের ফাটল বেদনাদায়ক হলেও অস্বাভাবিক নয়; যখন তখন লক্ষণীয়। অনেকে আজ বন্ধু কাল শত্রু“। বন্ধু হয়ে বেঈমানি আর বিশ্বাসঘাতকতা কারো কাম্য নয়। কিন্তু অপ্রত্যাশিত হলেও অহরহ ঘটছে। শুধু বন্ধু কেন পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে বাবা-মা, ভাইবোন, নিকট আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে দূরত্ব। ছড়িয়ে পড়ছে হিংসা হানাহানি। পিপীলিকা যেমন বিপদে পানিতে পতিত গাছের পাতাকে বাঁচার অবলম্বন করে নেয়, তেমনি মানুষও বিপদ হতে বাঁচতে চায়, একটু আশ্রয় খোঁজে। প্রয়োজন হয় ভালো বন্ধুর। রক্ত মাংসে গড়া মানুষকে যেখানে বন্ধু হিসেবে ভেবেও সন্দেহ হয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল কাজ করে, সেখানে মানুষের প্রকৃত বন্ধু হতে পারে বই। আর অসৎ বন্ধুর সংস্পর্শে জীবন হয়ে উঠতে পারে বিভীষিকাময়। তাই বই হতে পারে প্রকৃত বন্ধু।

বই পড়ার প্রতি আমাদের চাপ নেই বললেই চলে, যতটুকু আছে ততটুকু নির্ধারিত পাঠ্যবই। এর বাইরে যেতে নারাজ। একসময় বাবা-মা পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়তে নিষেধ করতেন। এখন ধারণা অনেকটা পাল্টেছে। বই পড়ার জন্য প্রয়োজন মানসিকতা, বই থেকে উপকার পাওয়ার তীব্র আকাক্ষা। দরিদ্র্য বই না কেনার কারণ হতে পারে, কিন্তু বই না পড়ার কোনো কারণ নয়। বই এখন সহজলভ্য। স্কুল-কলেজের লাইব্রেরিতে প্রচুর বই পাওয়া যায়, শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতেও বই পড়া যায়। এছাড়া অনেক গ্রামগঞ্জেও বিভিন্ন নামে গড়ে উঠেছে গ্রন্থাগার। নিকটস্থ বন্ধুর কাছ থেকেও বই ধার নিতে পারেন। আর টাকা খরচ করে বই কিনলে তো কথাই নেই। যত ইচ্ছা তত বই কিনতে পারেন। আমাদের দেশে এখন প্রকাশনীও অনেক। তবে বৈষয়িক লাভের কথা চিন্তা করলে বই পড়া সম্ভব নয়। বই হয়ত আপনাকে তাৎক্ষণিক কোনো লাভ দিতে পারবে না। তাই বলে আপনি বই পড়া বন্ধ করে দিলেও লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি।

বই পড়তেন পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম। বই পড়া ছিল তার নেশা। কোনো বই হাতে পেলেই তা পড়ে শেষ করে ফেলতেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান, বীজগণিত ও জ্যামিতি ছিল তার প্রিয় বিষয়। এছাড়া দর্শন শাস্ত্রেও ছিল তার অসাধারণ ব্যুৎপত্তি। তিনি বলেছেন, ‘সূর্যের আলোতে যেরূপ পৃথিবীর সকল কিছুই ভাস্বর হয়ে ওঠে, তেমনি জ্ঞানের আলোতে জীবনের সব অন্ধকার আলোকোদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।’ এ ছাড়াও বিশ্ববিখ্যাত ‘মা’ গ্রন্থের রচয়িতা ম্যাক্সিম গোর্কি। তার মা অল্প বয়সে মারা গেলে কঠিন সমস্যায় পড়ে গেলেন। দাদামশাই দায়িত্ব নিতে চাইলেন না। জীবনে কখনো জুতোর দোকানে বয় হিসেবে, কখনো কয়েদি বহনকারী জাহাজে থালা বাসন ধোয়ার কাজ করেছেন। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে এক পেশা থেকে আরেক পেশায় বড় হয়েছেন। তবে সবকিছুর মধ্যেও বই পড়া ছিল তাঁর নেশা। বইয়ের কোনো বাছবিচার ছিল না, যখন যে বই পেতেন সর্বভূকের মতো তাই পড়তেন। দারিদ্র ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। সন্ধ্যা থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা রুটির দোকানে কাজ করেও ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সময় পেতেন ততটুকু সময়ই বই পড়তেন। বই পড়তে পড়তেই তিনি লব্ধ জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটান বিশ্ববিখ্যাত লেখক হয়ে। তাই মনে রাখতে হবে, মূলত ভালো বই মানবজীবনকে সুন্দর ও মহৎ করে তোলে। মানুষের মনে জাগিয়ে দেয় মানবতাবোধ। যুগ যুগ ধরে যে সত্য ও সুন্দরের সাধনা তা এনে দিয়েছে বই। বই দৃষ্টিকে করেছে উদার, মনকে করেছে উন্নত; হতাশা ও বিষাদ থেকেও দিয়েছে মুক্তি। শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘বই পড়াকে যে যথার্থ হিসেবে নিতে পারে, সংসারের দুঃখ কষ্টের বোঝা তার অনেকখানি কমে যায়।’

আলোকিত মানুষ হতে হলে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই শুধু পাঠ্যবই পড়ে আলোকিত হওয়া যায় না। আলোকিত হওয়া যায় বিখ্যাত লেখকদের বিখ্যাত বই পড়ে এবং আনন্দের, গল্পের ও কবিতার বই পড়ে। তাই বড় হওয়ার জন্য চাই বড়র সংস্পর্শ। শ্রেষ্ঠ বইগুলো পড়তে পারলে চেতনা জগৎকে বড় করে তোলা যায়। এ জন্যেই বইয়ের কাছে যেতে হবে। বই নিয়ে মনীষীদের বহু উক্তি আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইকে ‘অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো’ বলে বর্ণনা করেছেন। তার উক্তিটি হচ্ছে ‘মানুষ বই নিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে।’ চার্লস ল্যাম্বের উক্তি হচ্ছে- ‘বই পড়তে যে ভালোবাসে, তার শত্রু কম।’ বইকে সুন্দরের প্রতীকরূপে উল্লেখ করে সিডনি স্মিথের উক্তি, ‘গৃহের কোনো আবসাবপত্রই বইয়ের মতো সুন্দর নয়।’

আমাদের বই পড়ার অভ্যাস এমনিতেই কম। এখন আরো কমে গেছে। এ বিষয়টির প্রতি বাবা-মাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। বাবা-মা আপনাদের বলছি। সন্তানদের বেশি বেশি বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। কাগজের বইয়ের পাশাপাশি এখন ই-বুক জনপ্রিয়। ই-বুক বা ডিজিটাল ভার্সনে বই পড়াও উৎসাহিত করুন। সৃজনশীল লেখকদের বই খুঁজে খুঁজে শিশুদের পড়তে উৎসাহ দিন। বই পড়ার অভ্যাসটা মানুষের এক দুই দিনে হয় না। কেউ আছে ছোটবেলা থেকেই এই অভ্যাস লালন করে; কেউ আছে বড় হবার পর এক দুইটা ভালো বই পড়ার পর বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর ফলে একে অভ্যাস হিসেবে লালন করে। তবে অভ্যাসটা যখন থেকেই গড়ে উঠুক না কেন, সবসময় ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। অন্তত প্রতি মাসে একটা ভালো বই পড়ার চেষ্টা করতে হবে। একজন মানুষের সুন্দর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে ভালো বই পড়ার মাধ্যমে। তাই জীবনকে আলোকিত করতে হলে, মানবসভ্যতার সাথে পরিচয় ঘটাতে হলে সর্বোপরি অশালীন, অশ্লীলতা ও কুমানসিক মন্ত্রণা থেকে বাঁচতে হলে অবশ্য বই পড়তে হবে এবং এর বিকল্পও নাই। তাই এই প্রজন্মের সকলকে বইপ্রেমী হতে হবে। বইয়ের মাধ্যমে আলোকিত জীবন গড়তে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই গড়ে উঠবে সুন্দর-স্বার্থক দেশ ও পৃথিবী।

 

লেখক : কলামিষ্ট, প্রাবন্ধিক

কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)