প্রযুক্তির যুগে সামাজিকতা ও দায়বদ্ধতা

রায়হান আহমেদ তপাদার :

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই স্বেচ্ছায় সেবা প্রদান করে, প্রকারান্তরে সেবা প্রদানকারী এর মাধ্যমে সেবাগ্রহীতার প্রতি তার দায়বদ্ধতা হতে মুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। প্রশ্ন জাগতেই পারে, আমরা কিভাবে অন্যের কাছে দায়বদ্ধ। এর উত্তরে স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, পৃথিবীর এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে সারা জীবনে প্রাপ্ত প্রত্যেকটি সেবার সঠিক এবং সময়মতো মূল্য প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কী মানুষ পেতে পারে না, মূলত গানের এ দুটি লাইনের মাধ্যমেই স্বেচ্ছাসেবার মূল লক্ষ্য যে মানবিক মূল্যবোধের বহিপ্রকাশ তা ফুটে ওঠে। স্বেচ্ছাসেবার প্রকৃত উদ্দেশ্য হতে হবে তাই সুদূরপ্রসারী এবং তাতে মানবিক দায়বদ্ধতার বহি:পকাশ থাকতে হবে। সমাজে কোনো ব্যক্তির স্বেচ্ছাসেবা তখনি প্রকৃত অর্থে সমাজের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে যদি পরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট এবং সুদূরপ্রসারী হয় এবং নিরন্তরভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া যায়। অপরদিকে নীতির সাথে সম্পর্ককেই বোধহয় নৈতিকতা বলে অভিহিত করার রীতি সমাজে প্রচলিত। আর সামাজিক নৈতিকতা? সম্ভবত ব্যক্তির সামাজিক দায় এই সামাজিক নৈতিকতার সারবস্তু। কিন্তু নীতি আর দায়ের বোধ কি সবার জন্য এক কিংবা অভিন্ন? না। এখানেই ব্যক্তির স্বাতন্ত্র। সামাজিক নৈতিকতার প্রসঙ্গ তাই ভিন্ন ভিন্নভাবে উপস্থাপিতও। সামাজিক দায় দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

এছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমাজসেবা এবং প্রতিবেশের পরিচর্যার জন্যও বিশেষভাবে সামাজিক নৈতিকতার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। সামাজিক দায়িত্ববোধ প্রতিষ্ঠা যেকোনো রাষ্ট্র কিংবা ভূখ-ের রাজনৈতিক বিকাশকেও সহায়তা করে। সামাজিক নৈতিকতা একটি সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে তার পথরেখা তৈরি করে। চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাস্তবতা এবং আদর্শ নির্মাণের কলা ও কৌশল এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে বিবেচ্য। যদি কোনো চিন্তা, কর্ম বা সিদ্ধান্ত সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয় তাহলে তা হবে অনৈতিক কাজ বা দায়িত্বহীনতা। সত্য ও মিথ্যা অথবা সঠিক ও ভুলের মধ্যে যদি কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে কারো কোনো ভাবনা, তবে ধরে নিতে হবে ওই ব্যক্তি সামাজিক নৈতিকতা থেকে দূরে অবস্থান করছে। মনে রাখতে হবে, সামাজিক নৈতিকতা সব সময় ঠিক জিনিসটিকেই ইঙ্গিত করে। সামাজিক নৈতিকতা অবশ্যই মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।

খাদ্য নিরাপত্তা প্রয়োজনীয় ও ভেজালমুক্ত স্বাস্থ্যকর খাদ্যের সুব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, পোশাক-পরিচ্ছদের অপ্রতুলতা দূর করা, চিকিৎসা সুবিধা হাতের নাগালে নিয়ে আসা, সকল মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করা এবং বাস্তবমুখী কিংবা জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা সামাজিক নৈতিকতা নির্মাণের জন্য জরুরি প্রসঙ্গ। পাশাপাশি মানবাধিকার এখন আধুনিক বিশ্বের বিশেষ দাবি। মানুষের চিন্তা প্রকাশের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও শিক্ষা অনুযায়ী কর্মসংস্থান এবং মানুষের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে কিছুতেই সামাজিক নৈতিকতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

পৃথিবীর এই ক্রান্তিলগ্নে করোনার ধারালো থাবা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা দেশে বিরাজমান এবং হিংস্র বন্য হাতির মতো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে অনেক আগে থেকেই, ফলস্বরূপ লকডাউনের বেড়াজালে আমরা প্রায়ই প্রত্যেকে ঘরে বন্দি। বন্ধ করা হয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো উদ্যোগ। কেননা, জীবনের থেকে বড় কিছু পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নেই, বেঁচে থাকলে সব পাওয়া যাবে। এই পরিস্থিতিতে অন্য কে কোন পেশার মানুষ সেটা নিয়ে ভাবছি না, আমার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে শিক্ষার্থীরা যারা এই মুহূর্তে সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ও একাডেমিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরে আছে। যদিও অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হচ্ছে কিন্তু সেটা কজনই বা করার সক্ষমতা অর্জন করছে? কেননা, আমরা এখনো অন্যান্য দেশের ন্যায় প্রযুক্তিগতভাবে নিজেদের খুব বেশি উন্নত করতে পারিনি। ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন, ট্যাব কারোর আছে তো কারোর নেই। এমন প্রেক্ষাপটে তাহলে বলা যায় যে, আমরা লেখাপড়া থেকে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছি। এই পিছিয়ে যাওয়া কতটুকু সেটা যদি আমি বোঝাতে চাই তাহলে একটা পরিসংখ্যান দিলে বুঝতে সহজ হবে, ইউনেস্কোর তথ্যানুযায়ী বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে বিশ্বে একশ বাহাত্তর কোটি পঞ্চাশ লাখ শিক্ষার্থী তাদের লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষার সব ক্ষেত্রের মোট ৯৮.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এই ক্ষতির সম্মুখীন। শুধু বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী শিখন ক্ষতির সম্মুখীন যেখানে ঝরে পড়ার সম্ভাবনা সমান সমান।

বর্তমান যুগে বেশির ভাগ মানুষ ব্যবস্তবতা থেকে দূরে সরে গেছে, পতন হয়েছে ছন্দময় হাসিরঠাট্টার দিন, হারিয়েছে জীবনের স্বাভাবিক গতি। কেউ বাইরে বের হয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের কাজ করতে না পেরে সারাদিন বিরক্তবোধ আর অলসতায় দিন কাটাচ্ছে। এ কারণে ভাইরাস থেকে দূরে থাকলেও পারিবারিক কোলাহল থেকে অনেকেই দূরে থাকতে পারছে না। দেখা দিচ্ছে নানাবিধ ঝামেলা, এই পরিস্থিতিতে অনেক নিম্ন আয়ের বাবারা তাদের মেয়েকে অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে, পাশাপাশি ছেলেগুলোকে বিভিন্ন কাজে পাঠাচ্ছে। এভাবে ঝরে যাচ্ছে অপরিপক্ক চোখ দিয়ে দেখা লাল -নীল স্বপ্ন। আবার যারা মধ্যআয়ের পরিবারের সন্তান কিন্তু হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর নিজের আগ্রহের দাপটে লেখাপড়া শিখেছে অথচ সরকারি চাকরির বয়স এ বছর শেষ, তাদের অবস্থা কতটা করুণ সেটা আমরা ওই পরিস্থিতির সামনে না পড়লে কোনো দিন বুঝব না। তবে একটু গভীরভাবে অর্ন্তচক্ষু দিয়ে দেখলে সেটা উপলব্ধি করা যায়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আদিকাল থেকেই মা, বাবা, আত্মীয়স্বজন ও পরিবার-পরিজন নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে বিনি সুতায় বাঁধা নামক সমাজে বসবাস করে আসছে। সমাজে বসবাস করতে হলে কিছু বিষয় অবশ্যই প্রত্যেকের পালন করা দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্য পড়ে যায়। যেমন- বড়রা ছোটদের প্রতি স্নেহশীল ও সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করবে, তদ্রুপ বড়দের প্রতি সম্মান দেখানো ও তাদের অবাধ্য না হওয়াটাও ছোটদের সৌন্দর্যের এক দারুণ বহিপ্রকাশ।

অথচ সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী জীবন অতিবাহিত করার জন্য প্রয়োজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, নির্মল বাতাস ও সুষম খাদ্য এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার অবাধ স্বাধীনতা যেখানে ছেলেমেয়ে উভয়ই সমানভাবে একই ছাদের নিচে বসে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

সেখানে মা, বাবা ও শিক্ষক, শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীর ভেতর থাকবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এই তিনটা বিষয়ের সমন্বয় হলেই ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করার অনুকূল পরিবেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তা দেখানোর উত্তম সুযোগ পায়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমরা চাইলেই সবকিছু আমাদের মতো করলে চলবে না। প্রকৃতি তার নিজস্ব গতিতে নিজের স্বকীয়তা নিয়ে যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে, এই চলার পথে নিজের মতো করে রূপ বদলিয়ে ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে আধুনিক থেকে আধুনিকতার স্পর্শে নিজেকে সুশোভিত করেছে। এইতো দেখুন না এ বছর লাখ লাখ বেকার যুবক-যুবতীর সরকারি চাকরির বয়সসীমা শেষ হবে, তাহলে তাদের এই আর্তনাদ কে দেখবে? বয়সসীমা শেষ হওয়ার কারণে এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী কাক্সিক্ষত চাকরি না পাওয়ায় হতাশ হয়ে অনেক সময় আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যাকে পৃথিবীর সব ধর্মে মহাপাপ হিসেবে বলা হয়েছে। তবে মানুষ আত্মহত্যা করে তখনই যখন নিজেকে ব্যর্থ, হতাশ ভাবে। সচারাচর যারা হতাশাগ্রস্ত থাকে তাদের দেখলে খুব সহজে বোঝা যায়।

সুতরাং প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করুন তা না হলে মানসিক বিষণœতা আমাদের কালো মেঘের ন্যায় ঘিরে ধরতে পারে। যার ফলাফল আমাদের কারোর জন্যই সুখকর হবে না। সর্বোপরি মানুষকে ভালোবাসুন, খারাপ সময়ে প্রত্যেকে প্রত্যেকের পাশে থাকুন। সমাজের জন্য যা কিছু ভালো, সমাজের মানুষের জন্য যা কিছু অকল্যাণকর নয়, তাই সামাজিক নৈতিকতার আওতায়। আর এই কারণেই এই চিন্তায় বর্তমানে যুক্ত হয়েছে দেশীয় ও বৈশ্বিক সার্বিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ। সম্পৃক্ত হয়েছে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক নানান বিষয়-আশয়। বুদ্ধিমত্তা আর চতুরতা এক কথা নয়। সমাজে চতুরতা বেড়েছে। বুদ্ধিমানরা আড়ালে সরে পড়ছে। চতুর ব্যক্তি কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারে, সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে সে নিজেকে নিযুক্ত করতে পারে না। ফলে তৈরি হয় সামাজিক বিপন্নতা। যে জাতি যত বেশি চতুর জনতা দ্বারা পরিচালিত, সে জাতি তত বেশি দুর্ভাগা। এমনকি প্রতিদিন নিজেরই অজান্তে নির্মাণ করছি সামাজিক নৈতিকতার বিরুদ্ধে এক মহাপ্রাচীর। আসল কথা হচ্ছে প্রকৃতি কখনো মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে না বরং মানুষই প্রকৃতির সব ভালো, খারাপ দিকগুলো মেনে নিয়ে এটার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাল ঠিক রেখে চলার চেষ্টা করে। তাহলে এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও পরিবর্তনশীল তা না হলে আমাদের অস্তিত্ব অনেক আগেই পৃথিবী থেকে মুছে যেত।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

ইমেইল : [email protected]