জেলা শহরে ভাষা আন্দোলন ও একটি কবিতার জন্ম

আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী »

সাধারণের ধারণা বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন প্রধানত ঢাকাতেই হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস পাঠে জানা যায় ঢাকার বাইরে মফস্বল শহরে এমনকি গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছাত্র/ছাত্রীদের সভা, বিক্ষোভ মিছিল আন্দোলনকে গতিময় করে তুলেছিল। কোন কোন শহরে ছাত্রদের সাথে জনগণ যুক্ত হয়ে আন্দোলনে গতিসঞ্চার করে। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ শহরে পরিপূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। স্কুল, কলেজ, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অফিস আদালত বন্ধ থাকে। ছাত্রদের আন্দোলনে জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। চট্টগ্রামেও দিনভর হরতাল পালন করা হয়। হরতালে বন্দরনগরীর জীবন যাত্রা ছিল অচল। লালদীঘি ময়দানে বিশাল জনসভা হয়। যেখানে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল সেই সভা। জেলার বাইরেও আন্দোলন হয়। খুলনা ও রাজশাহীতেও পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। রাজশাহীতে ভুবন মোহন পার্কে বিশাল সমাবেশ হয়। সেখানে ছাত্রীরা পৃথক মিছিল ও সভা করে রাষ্ট্র্রভাষার দাবিতে শপথ নেয়। এছাড়াও পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, ফরিদপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল সহ দেশজুড়ে হরতাল ও ভাষার দাবিতে মিছিল সমাবেশ হয়। আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন সম্পাদিত “ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস” তাজুল মোহাম্মদ এর লেখা “ভাষা আন্দোলনে সিলেট” তসিকুল ইসলাম রচিত “বরেন্দ্র অঞ্চলের ভাষা আন্দোলন”, মামুন সিদ্দিকীর লেখা “ভাষাসংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরী” গ্রন্থগুলোতে ঢাকার বাইরের আন্দোলনের কথা জানা যায়।
একুশের পূর্বমুহূর্তে স্মৃতিচারণ করে ভাষাসৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছেন “চট্টগ্রামে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য আমি, চৌধুরী হারুনুর রশীদ, আজিজুর রহমান সহ অনেকে বিভিন্ন এলাকায় সভা সমাবেশ করি। ২০ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন এলাকায় সভা সমাবেশ করে যখন অফিসে আসলাম আমার ১০৪ ডিগ্রি জ¦র এবং গায়ে জলবসন্ত। সারাদিনই আমি গায়ে জ¦র এবং জলবসন্ত নিয়ে কাজ করেছি। কাজের উত্তেজনায় আমি এসব কিছু অনুভব করতে পারিনি। অসুস্থতার কারণে আমাকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি যেহেতু ছাত্র ফেডারেশন এর রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম সে কারণে ছাত্র ফেডারেশনের একজন কমীকে আমার সঙ্গে দেয়া হয় কমিটির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য।
একুশে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে আসেন সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তিনি একজন বড় সাংবাদিক। তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টার দিকে ঢাকায় যোগাযোগ করে জানতে পারেন ছাত্র- জনতার মিছিলের ওপর গুলি চলেছে এবং এতে অসংখ্য লোক মারা গেছে। কত লোক মারা গেছে তাও কেউ জানে না এবং তখনও বরকত, সালাম এর নাম চট্টগ্রামে আসেনি।
খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াছ এর কাছ থেকে খবর জানার পর সবাই ফুঁেস উঠলো। আমি বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় যখন ঢাকার গুলির খবর শুনলাম, তখন “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” কবিতাটি শ্রুতি লিখনের মাধ্যমে লিখে ফেললাম। সন্ধ্যায় খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াছ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং আমার এই দীর্ঘ কবিতাটি পড়েন। তিনি বলেন এটি অসাধারণ একটি কবিতা। এটি ছাপিয়ে ২৩ তারিখের জনসভায় বিলি করতে হবে। এবং আবৃত্তি করে শোনাতে হবে”।
একদিকে ঢাকা যখন আন্দোলন সংগ্রামে রক্তে রঞ্জিত অন্যদিকে জেলা শহরগুলো ছিল ভাষার দাবিতে উত্তাল। বন্দর নগরীতে রচিত হয় রক্তঝরার প্রতিবাদে একুশের প্রথম কবিতা “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি”। রচিত হয় ইতিহাস। কবিতাটি আন্দরকিল্লার কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসে ছাপা হয়। মূল্য ছিল ০২ আনা। প্রকাশক হিসেবে নাম ছিল পাথরঘাটা অঞ্চলের তৎকালীন পৌর কমিশনার নির্বাচনের প্রার্থী কামাল উদ্দিন আহমদ খানের। ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় লালদীঘিতে শুরু হওয়া সভার এক পর্যায়ে চৌধুরী হারুনুর রশিদ দৃপ্ত কণ্ঠে কবিতাটি পাঠ করেন। শ্লোগান ও করতালিতে কম্পিত হয় লালদীঘির ময়দান। সেদিনের বিশাল জনসমুদ্রের বিক্ষোভে প্রকম্পিত হয় বন্দর নগরী। ঐ দিনই সরকার কবিতাটি বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। কবিতা পড়ার অপরাধে ২৪ তারিখ চৌধুরী হারুনুর রশিদ গ্রেফতার হন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী আত্মগোপনে যান, পুলিশ কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে ইতিহাস। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কলম দিয়ে চট্টগ্রাম সৃষ্টি করে একুশের ওপর লেখা প্রথম অমর কবিতা।
লেখক : ছড়াকার, শিশু সাহিত্যিক