চট্টগ্রামে এবার কোরবানি ৩০ শতাংশ কমতে পারে

দুশ্চিন্তায় হাটের ইজারাদার, খামারি ও বেপারিরা #
চাহিদার তুলনায় স্থানীয় উৎপাদন বেশি হওয়ায় এবার বাইরের জেলা থেকে কোরবানির পশু আসবে কম: জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা#
সালাহ উদ্দিন সায়েম :
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এবার ঈদুল আজহায় মানুষের আর্থিক সংকটের কারণে কোরবানি পশুর চাহিদা ২৫-৩০ শতাংশ কম হবে বলে ধারণা করছেন পশুহাটের ইজারাদার ও জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তারা। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত যারা একাধিক পশু কোরবানি দিতেন, তারাও এবার পশুসংখ্যা কমাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর যারা একটা পশু কোরবানি দিতেন তারা এবার বাজেট কমাবেন। অনেকেই এবার করোনাভাইরাসের কারণে পশুহাটে যেতে আগ্রহী হবেন না। এ অবস্থায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন খামারি, পশুহাটের ইজারাদার ও বেপারিরা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও মোস্তফা-হাকিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনজুর আলম প্রতি বছর ৬টি গরু কোরবানি দেন। এবার এই শিল্প পরিবার কোরবানিতে একটি পশু কমিয়ে ফেলছেন বলে সুপ্রভাতকে জানিয়েছেন মোস্তফা-হাকিম গ্রুপের পরিচালক মো. সরওয়ার আলম। তিনি বলেন, এবার আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। তাই কোরবানিতে একটি পশুর সংখ্যা কমিয়ে ফেলছি। তবে আমাদের কারখানার কর্মচারীদের জন্য প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ১৪টি গরু কোরবানি দেওয়া হবে।
আগ্রাবাদ শান্তিবাগ এলাকার চিকিৎসক ডা. আবদুর রহমান গত বছর ৬০ হাজার টাকা দিয়ে পশু কোরবানি দিয়েছিলেন। আর্থিক সংকটের কারণে এবার কোরবানিতে পশু ক্রয়ের জন্য তিনি বাজেট করেছেন ৪০ হাজার টাকা। সুপ্রভতকে তিনি বলেন, করোনা প্রকোপের কারণে গত চার মাস ধরে আমার ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ রয়েছে। আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে এবার পশু কেনার বাজেট কমিয়ে ফেলেছি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান সুপ্রভাতকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে এবার যাদের সামর্থ থাকবে না তারা পশু কোরবানি দিতে পারবে না। ইসলামও সেটাই বলে। লোক দেখানো পশু কোরবানি তো ইসলাম অনুমোদন করে না।
তিনি বলেন, কেবল যাদের সামর্থ আছে তাদেরই পশু কোরবানি দেওয়া উচিত। সামাজিক বংশ মর্যাদার কথা ভেবে অর্থ ধার করে কোরবানি দেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের পরিহার করা উচিত।
জেলা প্রাণীসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত বছর ঈদুল আজহায় চট্টগ্রামে ৭ লাখ ৩১ হাজার পশু কোরবানি হয়। কিন্তু এবার করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মানুষের আর্থিক সংকটের কারণে ২৫-৩০ শতাংশ পশু কোরবানি কম হবে মনে করছেন জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেয়াজুল হক। অর্থাৎ এ বছর চট্টগ্রামে ১ লাখ ৮৩ হাজার পশু কোরবানি কম হবে।
রেয়াজুল হক বলেন, চট্টগ্রাম জেলায় গত ৪ মাসে মাত্র ৩০ হাজার পশু জবাই হয়েছে। যার বেশিরভাগ গরু জবাই হয়েছে বাজারে। অথচ করোনা প্রকোপের আগে প্রতিমাসে বিভিন্ন উপলক্ষে ৩০ হাজার পশু জবাই হতো। তাই আমরা ধারণা করছি, আর্থিক সংকটের কারণে এবার কোরবানে পশুর চাহিদা ২৫-৩০ শতাংশ কম হবে।
জেলা প্রাণীসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত এক বছরে চট্টগ্রামে ৭৯ হাজার পশু উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু মানুষের আর্থিক সংকটের কারণে এবার কোরবানিতে পশু বিক্রি কম হবে-এই আশঙ্কায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন খামারি ও বেপারীরা।
করোনা প্রকোপের কারণে এবার অনলাইনে পশু বেচাকেনা জমজমাট হবে বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু খামারিরা বলছেন, অনলাইনে আশানুরুপ পশু বিক্রি হচ্ছে না।
চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় খামার মিরসরাই এলাকার নাহার এগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী রকিবুর রহমান টুটুল বলেন, এবার কোরবানির জন্য ৩০০টি গরু বাছাই করেছি। এরমধ্যে অনলাইনে ৬০টি গরু বিক্রি হয়েছে। গত বছর হাট বসার আগে অনলাইনে এরচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। তাই এবারেরটা আশানুররূপ নয়। এবার পশুর চাহিদা অনেক কম।
বিবিরহাট বাজারের ইজারাদার আরিফুল ইসলাম বলেন, এবার করোনা পরিস্থিতিতে আর্থিক দুরাবস্থার কারণে অন্তত ৩০ শতাংশ পশু কোরবানি কম হবে। যারা ৪-৫টা পশু কোরবানি দিতেন, তারা দু-তিনটা দেবেন। যারা একটা গরু কোরবানি দিতেন তারা এবার বাজেট কমাবেন।
জেলা প্রাণীসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত বছর চট্টগ্রামে স্থানীয়ভাবে পশু উৎপাদন হয়েছিল ৬ লাখ ১০ হাজার। আর পশু কোরবানি হয়েছিল ৭ লাখ ৩১ হাজার পশু কোরবানি হয়েছিল। ১ লাখ ২১ হাজার পশুর ঘাটতি মেটানো হয় চট্টগ্রামের বাইরের পশু দিয়ে।
এ বছর চট্টগ্রামে উৎপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৮৯ হাজার পশু। যার মধ্যে গবাদি পশু হলো ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭২টি, মহিষ ৩ হাজার ৪৩৫ আর ছাগল ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি । অর্থাৎ গত এক বছরে চট্টগ্রামে ৭৯ হাজার পশু উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
চাহিদার তুলনায় স্থানীয় উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে এবার চট্টগ্রামের বাইরে থেকে কোরবানির পশু কম আসবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেয়াজুল হক।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের বাইরের পশু বেপারিরা প্রতি বছর কোরবানের আগে জেলা প্রাণীসম্পদ কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। তারা স্থানীয় পশু উৎপাদনের তথ্য জেনে সিদ্ধান্ত নেন। এ বছর যেহেতু চট্টগ্রামে স্থানীয় পশুর সংখ্যা বেশি তাই বাইরের পশু কম আসবে।
চাহিদার তুলনায় পশুর সংখ্যা বেশি হলে দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে বলে জানিয়েছেন হাটের ইজারাদাররা।
গত বছর নগরীতে ৭টি অস্থায়ী পশুর হাট বসলেও এবার বসছে ৪টি। এগুলো হলো-কর্ণফুলী নূর নগর হাউজিং এস্টেট পশুর বাজার, সল্টগোলা গরুর বাজার, পতেঙ্গা কমল মহাজনহাট ও বিমানবন্দর বাটারফ্লাই পার্ক সংলগ্ন টিকে গ্রুপ মাঠ। মানুষের চলাচলের অসুবিধার কারণে এবার স্টিল মিল বাজার, কাটগড় পতেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ ও বড়পোল এলাকায় পশুর হাট বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। চারটি অস্থায়ী হাটের পাশাপাশি তিনটি স্থায়ী বাজার রয়েছে। এগুলো হলো অলংকার সাগরিকা পশুর বাজার, ষোলশহর বিবিরহাট ও দেওয়ানহাট পোস্তারপাড় ছাগলের বাজার।
জানা গেছে, এবার তিনটি হাটের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে চড়া মূল্য দিয়ে অস্থায়ী পশুর বাজার ইজারা নিয়েছেন ইজারাদাররা। কিন্তু এবার ক্রেতার সংখ্যা কম হবে-এই আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন হাট ইজারাদাররা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পতেঙ্গা কমল মহাজনহাট গত বছর ইজারা দেওয়া হয়েছিল সাড়ে ৩ লাখ টাকায়। কিন্তু এ বছর এই পশুর হাট ইজারা দেওয়া হয়েছে ৯৬ লাখ টাকায়। বিমানবন্দর বাটারফ্লাই পার্ক সংলগ্ন টিকে গ্রুপ মাঠের হাট গত বছর ইজারা দেওয়া হয়েছিল ৩ লাখ টাকায়। আর এবার দেওয়া হয়েছে ৪৬ লাখ টাকায়।
কমল মহাজনহাটের ইজারাদার মমতাজ উদ্দিন সুপ্রভাতকে জানান, পতেঙ্গা এলাকায় এবার কাটগড় উচ্চ বিদ্যালয় ও স্টিলমিল বাজার হাট অনুমতি না পাওয়ায় আমাদেরকে এবার চড়া মূল্যে ইজারা নিতে হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার পশু বিক্রিও অনেক কম হবে। এবার অনেক লোকসান গুনতে হবে আমাদের।
টিকে গ্রুপ মাঠ হাটের ইজারাদার রাজু আহমেদ বলেন, চড়া মূল্যে আমরা হাট ইজারা নিয়ে এখন বেকায়দায় পড়ে গিয়েছি। এবার পশুর চাহিদা অন্তত ৩০ শতাংশ কম হবে। করোনার কারণে অনেকে হাটে আসবেন না। ইজারা মূল্যের অর্ধেক টাকাও হাসিল পাবো বলে মনে হচ্ছে না।