২১ আগস্ট ২০০৪ : বঙ্গবন্ধু পরিবারকে শেষ করার আর একটি চেষ্টা

আবদুল মান্নান »

ইতিহাসের নিরিখে খুব বেশী দিন আগের কথা নয়। সতের বছর। ঠিক সতের বছর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিশ্বের ইতিহাসে এক ভয়াবহ নজিরবিহীন ঘটনায় বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে গ্রেনেড হামলা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের প্রায় সকল কেন্দ্রিয় নেতাকে হত্যা করার এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের সৃষ্টি করা হয়েছিল। আরো একটু পিছনে ফেরা যাক । ১৯৮২ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের একজন কর্ণেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান এরশাদ কতৃক দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য । ফারুক রহমান দেশে ফিরে গঠন করেছিলেন ফ্রিডম পার্টি নামক একটি রাজনৈতিক দল । এই দলের হয়ে তিনি যথারীতি এরশাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন । এরপর ঢাকায় থেকে যান সৈয়দ ফারুক রহমান । জামায়াত বিএনপি সহ বেশ কিছু কর্মীকে তিনি এই পার্টির সাথে সম্পৃক্ত করেন । ১৯৮৫ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক সলিল ত্রিপাঠী ঢাকায় ফারুক রহমানের কাছে জানতে চান দশ বছর বয়সী রাসেলকে কি হত্যা করা জরুরী ছিল?

জবাবে ফারুক জানিয়েছিল, দরকার ছিল কারণ তারা শেখ মুজিবের কোন উত্তরাধিকার রাখতে চাননি । হয়তো তিনি আক্ষেপ করেছিলেন কেন সেদিন তারা বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও  শেখ রেহানাকে হত্যা করতে পারলেন না। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা তখন বিদেশে ছিলেন বলে বেঁচে গিয়েছিলেন ।

১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন অনেকটা নিজের জীবন বাজি রেখে । দেশে ফেরার পর আবার বঙ্গবন্ধুর অন্যতম উত্তরাধিকার শেখ হাসিনাকে নানা ভাবে পঁচাত্তরের ঘাতকরা হত্যা করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে । অপেক্ষা করতে থাকে সুযোগের । তিনি আওয়ামী লীগ পূনঃগঠনের পর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়ও তাঁকে হত্যা করার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হয়েছে। ভুললে চলবেনা জিয়া আর এরশাদের মধ্যে মতাগত ভাবে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না । শেখ হাসিনাকে প্রথম গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা করা হয় চট্টগ্রামে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি । সে দিন শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন এরশাদ বিরোধী একটি সমাবেশে বক্তব্য রাখতে । যাতে শেখ হাসিনা সমাবেশস্থল লাল দীঘি ময়দানের অনুষ্ঠিতব্য কোন জনসভায় অংশ নিতে না পারেন তার জন্য সকাল হতেই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের পুলিশ প্রধান মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে অনুষ্ঠান স্থল দখলে নিয়েছিলো পুলিশ । এই মির্জা রকিবুল হদা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোলান্দাজ বাহিনীতে একজন মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং যশোর সেক্টরে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন । যুদ্ধ শেষে হুদা যুদ্ধবন্দী হিসেবে পাকিস্তানে  ফেরত যান । পরে বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন । জিয়া এই রকম সতেরজন পাকিস্তান ফেরত সেনা অফিসারকে পুলিশে আত্তিকরণ করেন । ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড মেরে হত্যা করার সময় তখন পুলিশের আইজিপি ছিলেন মোঃ শহুদুল হুদা । তিনিও পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তা ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধের পুরো মাস তিনি পাকিস্তানের ট্যাংক রেজিমেন্টের একজন মেজর হিসেবে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন ।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল একটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা যা তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার গোচরে তাঁর জেষ্ঠ্য সন্তান ও বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়া হাওয়া ভবনে বসে তার অন্যান্য সাঙ্গ পাঙ্গদের নিয়ে তৈরী করছিলেন । মূল পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলেন বেগম জিয়ার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বেগম জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিস চৌধুরী, জামায়াতের নেতা ও বেগম জিয়ার মন্ত্রী সভার সদস্য আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বেগম জিয়ার সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম মিন্টু ও মাওলানা তাজুদ্দিন, তৎকালিন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজাকুল হায়দার, তৎকালিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান আবদুর রহমান । তারা ব্যবহার করেছিল মৌলবাদি সন্ত্রাসী দল আল-মারকাজুল ইসলাম আর হুজিকে । এছাড়াও এই হত্যা পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলেন বিএনপি ও জামায়াতের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা । সার্বিকভাবে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত থাকতেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু উর্দ্বতন কর্মকর্তা এবং ঘটনার দিন তারা ঘটনার বাস্তবায়ন করা ও তাদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক ভাবে সাহায্য করেন । মোটামুটি শেখ হাসিনাকে হত্যা করার পরিকল্পনার সাথে জড়িত দলটি বেশ বড় এবং তাদের লক্ষ্যের ব্যাপারে অভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ । ঠিক যেমনটি ঘটেছিল পনেরই আগস্টের পূর্বে । তফাৎটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ সভা গুলো হতো সেনা নিবাসে আর তাঁর কন্যাকে হত্যা করার পরিকল্পনা বিষয়ক সভাগুলো হতো বেগম জিয়ারই রাজনৈতিক দপ্তর হাওয়া ভবনে । আর একটি তফাৎ হচ্ছে ২১ আগস্টের বোমা হামলাটি ছিল রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাস কারণ রাষ্ট্রিয় প্রশাসন যন্ত্রের একটি বড় অংশ, প্রধানমন্ত্রী সহ এই হত্যা পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিল । বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সাথে রাষ্ট্রিয় প্রশাসন যন্ত্র  সম্পৃক্তকা ছিল না তবে প্রশাসনের কোন কোন বিভাগের ব্যর্থতা ছিল ।

প্রশ্ন হচ্ছে কেন বেগম জিয়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এই ধরণের একটি ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালালো ? আসল কারণ হচ্ছে বেগম জিয়ার বাংলাদেশে এক ধরণের রাজতন্ত্র কায়েম করা । তারা মনে করতো তাদের সামনে একমাত্র বাধা  আওয়ামী লীগ । মনে করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলে আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেয়া যাবে এবং বাংলাদেশকে তাদের প্রত্যাশিত একটি মিনি পাকিস্তান বানানো যাবে । কিন্তু তাদের ধারণা কি এই কারণেই ভুল ছিল কারণ আওয়ামী লীগ শুধু কোন রাজনৈতিক দল নয় এই দলটি জন্ম হতেই একটি আদর্শ ও অনুভূতির নাম । দলটির জন্মের পর একাধিকবার নিষিদ্ধ হয়েছে, বঙ্গবন্ধু সহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু আওয়ামী লীগকেতো হত্যা করা যায় নি । এটি ঠিক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগ দল হিসেবে একটুৃ ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা ফেরার পর অনেক কষ্টে দলটিকে আবার দাঁড় করিয়ে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এনেছেন । হত্যাকা-ের পরিকল্পনাকারিরা ভ্রান্তভাবে ধারণা করেছিল শেখ হাসিনা সহ অন্যান্য সিনিয়র নেতারা, যারা সেদিন সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন তাদেরকে যদি হত্যা করা যায় তা হলে আওয়ামী লীগের সমাপ্তি হবে এবং তাদের সামনে বাংলাদেশে একটি নূতন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়ে যাবে ।

২১ আগস্টের জনসভাটি ছিল ‘সন্ত্রাস বিরোধী’ জনসভা । এর আগে দেশে সন্ত্রাস বেড়ে গিয়েছিল ভয়াবহ ভাবে । বিঘিœত হচ্ছিল মানুষের স্বাভাবিক নিরাপত্তা । শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী, তিনি দলীয় ভাবে একটি ‘সন্ত্রাস বিরোধী’ জনসভার আয়োজন করলেন । স্থান নির্ধারণ করা হয় জিপিও সংলগ্ন মুক্তাঙ্গনে । সভা করার অনুমতি চেয়ে দল হতে পুলিশের কাছে আবেদন করা হলো । পুলিশের অনুমতি না পেয়ে সভার স্থান পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে অবস্থিত দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্থানান্তর করা হলো । এই বিষয়ে সে দিনের একাধিক পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করা হয় । এই স্থানটি ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কারণ যেখানে সভা করা হবে তার চারিদিকে বেশ উঁচু দালান।  শেখ হাসিনা জনস্বার্থে সে দিন ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন । পরে তদন্তে দেখা গেছে অনেকগুলো গ্রেনেড ভবনের উপর হতে ছোঁড়া হয়েছে । যেহেতু সেখানে কোন মঞ্চ বানানোর সময় ছিল না সেহেতু নেতৃবৃন্দ একটি খোলা ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করেছিল ।

ধারণা করা হয় ২১ আগস্টের গ্রেনেড গুলো এসেছিল পাকিস্তান হতে । সেদিন ঘাতকরা চৌদ্দটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিল । তারপরও শেখ হাসিনার বেঁচে যাওয়াটা ছিল অনেকটা অলৌকিক কারণ শেখ হাসিনার উপর কোটি মানুষের দোয়া আছে আর আছে সৃষ্টিকর্তার অপার রহমত । তাঁকে রক্ষা করার জন্য সেদিন দলীয় নেতা কর্মীরা তাঁর চার পাশে মানব বর্ম তৈরী করেছিলেন ঠিক যেমনটি করা হয়েছি ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারী চট্টগ্রামে । ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় তাৎক্ষণিক নিহত হয়েছিলেন দলের ২৪জন নেতা কর্মী আর আহত হয়েছিলো পাঁচশর বেশী । গুরুতর আহত হয়ে কয়েকদিন পর সিএমএইচে মৃত্যুবরণ করেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও জিল্লুর রহমানের (পরবর্তিকালে রাষ্ট্রপতি)স্ত্রী আইভি রহমান । এমন একটি ঘটনাকে নিয়ে বিএনপি‘র একাধিক নেতা ঠাট্টা তামাশা কম করেন নি । তাদের কয়েকজন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন শেখ হাসিনা নিজেই এই গ্রেনেডগুলো হাত ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলেন । এই নির্বোধরা জানেনা একটি গ্রেনেডের ওজন কতো । কয়েকটি গ্রেনেড অবিষ্ফোরিত অবস্থায় ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল যা আলামত হিসেবে তদন্তে ব্যবহার করা যেতো । কিন্তু তা পরদিন সেনা সদস্যরা অন্য স্থানে নিয়ে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে নষ্ট করে ফেলে। সব আলামতও ধুয়ে ফেলা হয় ।

সরকার একটি লোক দেখানো এক সদস্য বিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে বিচারপতি জয়নাল আবেদিনকে দিয়ে ।  এর আগে সিআইডি তাদের ‘তদন্তে‘ জানতে পারে এই ঘটনার মূল নায়ক একজন ভবঘুরে জজ মিয়া । আর অন্যদিকে বিজ্ঞ বিচারপতি তদন্ত তদন্ত খেলা শেষে উৎঘাটন করেন এই ঘটনার সাথে পার্শবর্তি একটি দেশ (পড়ুন ভারত) জড়িত আছে । হায়রে বিচার বিভাগীয় তদন্ত ।

শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠন করলে একটি বিশেষ আদালতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয় । বিচার শেষে বাবর সহ মোট ঊনিশ জনকে আদালত মৃত্যুদন্ড দেয় । তারেক জিয়া সহ মোট সতের জনকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড । তৎকালিন পুলিশ প্রধান আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হুদাকে দেয়া হয় চার বছরের কারাদণ্ড । দন্ডপ্রাপ্তরা অনেকে পলাতক আছে । অনেকে আছে কারাগারে । তারা প্রায় সকলে উচ্চ আদালতে আপিল করেছে । এখন সময় হয়েছে এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করে দণ্ডিতদের দণ্ড কার্যকর করা । বঙ্গবন্ধু কন্যার দীর্ঘায়ু কামনা করি । দেশের জন্য তাঁর বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে ।

লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়