মাথা নোয়াতে জানে না পানশির, তালেবান প্রতিরোধের ডাক

পাঞ্জশিরে তালিবানের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে প্রতিরোধ। -ছবি টুইটারের সৌজন্যে।

সুপ্রভাত ডেস্ক »

মাথা নোয়াতে জানে না হিন্দুকুশ পর্বতমালার কোলে পানশির উপত্যকা। ইতিহাস বলছে, পানশির বার বার দেখিয়ে দিয়েছে, গোটা আফগানিস্তান দখল করেও মাথা নোয়ানো যায় না পানশিরের।

সাবেক সোভিয়েত সেনা পারেনি। আমেরিকার সেনাবাহিনীও পারেনি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পারেনি তালিবানও। লড়তে জানে পানশির! হারতে জানে না।

পানশিরের প্রধান রক্ষাকবচ প্রকৃতি। অত্যন্ত দুর্গম, সুউচ্চ হিন্দুকুশ পর্বতমালার প্রায় হাড়জমানো ঠান্ডায় পানশির উপত্যকাকে দখল করার স্বপ্ন অধরা থেকে গিয়েছে আমেরিকা ও রাশিয়ার সেনাবাহিনীর। তালেবানদেরও।

হিন্দুকুশের কোলে আকারে ছোট হলেও খুব সাজানো এই উপত্যকার দ্বিতীয় রক্ষাকবচ সেখানকার তাজিক জনগোষ্ঠীর লক্ষাধিক মানুষ। আফগানিস্তানে তাজিক জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম বসতি পানশিরেই।

এই তাজিক জনগোষ্ঠীর মানুষ বংশানুক্রমেই যে কোনও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন বার বার। গত শতাব্দীর আটের দশক থেকে এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত।

আফগান সরকারের উপরাষ্ট্রপতি, পানশির উপত্যকার সন্তান আমরুল্লা সালেহের মাথা এখনও পর্যন্ত নোয়াতে পারেনি তালেোনরা। টুইট করে সালেহ্‌ জানিয়েছেন, তিনি এখনও আফগানিস্তানেই আছেন। আর শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াইও চালিয়ে যাবেন। তালেোনদের পরোয়া না করেই সালেহ্‌ জানিয়েছেন, আশরফ গনির অনুপস্থিতিতে তিনিই এখন আফগানিস্তানের তদারকি প্রেসিডেন্ট।

সালেহের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, পানশিরেই এখন রয়েছেন তিনি। যেখানে ঢোকার সাহসে কুলোয়নি প্রবল পরাক্রমী, নৃশংস তালেবান যোদ্ধাদেরও।

যাঁরা আফগানিস্তানকে হাতের তালুর মতো চেনেন, জানেন সেই বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বিদেশি হানাদারই হোক বা তালিবান—দেশের যে কোনও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে বংশানুক্রমে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে যে ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’-এর, তার ভরকেন্দ্র এই পানশিরই। যা ‘সেকেন্ড রেজিস্ট্যান্স’ বা ‘পানশির রেজিস্ট্যান্স’ নামেও সুপরিচিত। আফগানিস্তানে গত ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা এই প্রতিরোধ শক্তির অন্যতম নেতাদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি উজ্জ্বল নাম। আহমেদ শাহ মাসুদ, আমরুল্লা সালেহ্‌ এবং বিসমিল্লা খান মোহাম্মদি। গত শতাব্দীর আটের দশকে সাবেক সোভিয়েত সেনাদেরও রুখে দিয়েছিলেন পানশিরের তাজিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত যখন গোটা আফগানিস্তানে দাপিয়ে বেড়িয়েছে তালেবান, তখন তাদের বিরুদ্ধে মনে রাখার মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পানশিরই। সেই সময় তালেবানদের ঠেকাতে পানশিরের তাজিকরা দেশের উত্তর প্রান্তের অন্য জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ে তোলে ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’। সেই জোটের নেতৃত্বে ছিলেন আহমেদ শাহ মাসুদ, আমরুল্লা সালেহ্‌, বিসমিল্লা খান মোহাম্মদি, করিম খলিলি, আবদুল রশিদ রস্তুম, আবদুল্লা আবদুল্লা, আবদুল কাদির, আসিফ মোহ্‌সেনি এবং মোহাম্মদ মোহাকিকের মতো লড়াকুরা। সেটা এক দিনে হয়নি। বিদেশি হানাদার ও তালিবদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্য গত ৪ দশক ধরে অস্ত্র মজুত করে গিয়েছেন তাজিকরা।

পানশিরের নামকরণেই রয়েছে সেই লড়াইয়ের ইতিহাস। ‘পানশির’ কথাটির অর্থ পাঁচটি সিংহ। সেটা দশম শতাব্দীর কথা। সেই সময়ের আফগানিস্তান ছিল গজনির শাসক সুলতান মেহমুদের অধীনে। ভয়াল পাহাড়ি বন্যায় তখন ভেসে যেত গোটা পানশির উপত্যকা। তখন উপত্যকার পাঁচ ভাই মিলে গড়ে তুলেছিলেন সুবিশাল বাঁধ। যা পানশিরকে পরে ভয়াল বন্যার আগ্রাসন থেকে বাঁচিয়েছিল। পাঁচ ভাইয়ের সেই সিংহবিক্রমকে স্মরণে রাখতেই পরে উপত্যকার নাম হয় পানশির।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের ১৫০ কিলোমিটার উত্তরের সেই পানশির উপত্যকায় তালেবান গোষ্ঠীকে প্রতিরোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেই নামকরণের সার্থকতা আরও এক বার প্রমাণিত হল গদি খোয়ানো প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির উপরাষ্ট্রপতি আমরুল্লা সালেহ্‌ তালিবদের পরোয়া না করার বার্তায়। তাঁর টুইটে সালেহ্‌ লিখেছেন, ‘হিংসা নয়, আইনের শাসনই থাকবে আফগানিস্তানে। আফগানিস্তানের আকার, আয়তন এতটাই বড় যে পাকিস্তানের পক্ষে তা গিলে খাওয়া সম্ভব নয়। আর তালেোনরাও পারবে না এত বড় দেশকে শাসন করতে।’

তালেবানের কাবুল দখলের মধ্যে দেশত্যাগ করা ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ এবং প্রখ্যাত এক তালেবানবিরোধী যোদ্ধার ছেলে আহমাদ মাসউদের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে বলে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ জানিয়েছেন।

মস্কোয় এক সংবাদ সম্মেলনে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তালেবান এখনো পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। পানশিরে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা