হাড় নেই, চাপ দেবেন না

‘ডাক্তার হতে এসে ছেলে এখন আইসিইউতে’

মামলায় আসামি ১৬, গ্রেফতার ২

নিজস্ব প্রতিবেদক »
হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ব্যান্ডেজ করা একটি মাথায় সবারই চোখ আটকে যাচ্ছে মুহূর্তেই। ধবধবে সাদা ব্যান্ডেজে লেখা Ñ ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ এর নিচেই বিপজ্জনক চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছে। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ করা এই তরুণ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে (চমেক) অধ্যয়নরত মাহাদি আকিব।
আকিবের মাথার হাড় ভেঙে দিয়েছে তারই রাজনৈতিক মতাদর্শের অপর একটি পক্ষ। মাথায় মারাত্মক আঘাত করে তারা। অপারেশনের পর আইসিইউতে রাখা হয়েছে। ব্যান্ডেজের উপর লেখাটির কারণ জানা গেল নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. এস এম নোমানের কাছে। তিনি বলেন, আকিবের মাথার হাড়ের বেশিরভাগ অংশ ভেঙে গেছে। মাথা অনেকটা থেঁতলানো। ব্রেনেও আঘাত হয়েছে। আপাতত মাথার হাড়ের একটি অংশ খুলে তার শরীরের চামড়ার নিচে রাখা হয়েছে। কিছুটা উন্নতি হলে সেটা আবার আগের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই পদ্ধতিকে বলা হয় উব পড়সঢ়ৎবংংরাব পৎধহরবপঃড়সু রিঃয বাধপঁধঃরড়হ ড়ভ বঢ়রফঁৎধষ ধহফ ংঁনফঁৎধষ যবসধঃড়সধ.’ ব্রেন ড্যামেজ হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে মাথায় সফল অপারেশন হয়েছে। তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক অবজারভেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চমেক’র ৬২তম ব্যাচের ছাত্র মাহাদি আকিব। ঘটনাটি ঘটে গত শনিবার সকাল ৯ টায়। চমেকের মেইন গেটের অদূরে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে অতর্কিত হামলা করে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ। তাকে কীভাবে মারা হয়েছে তার বর্ণনা দিলেন চমেকের শেষ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগের নেতা মো. ইমন সিকদার।
তিনি বলেন, গতকাল সকাল ৯টায় সিনিয়ররা তখন চমেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। নিচে ছিলেন মাহাদি আকিবসহ জুনিয়ররা। হঠাৎ ধাওয়া দিয়ে চমেকের মেইন গেটের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে মাহাদি আকিবকে পেয়ে ঘিরে ধরেন প্রতিপক্ষরা। গলায় রিকশার চেইন দিয়ে বাধা হয়। কাঁচের বোতল দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। রামদা দিয়ে কোপানো হয় মাথায়। পরে হকিস্টিক দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। মাথা থেঁতলানো অবস্থায় সহপাঠীরা আকিবকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
মাহাদীর কথা শুনে কুমিল্লা থেকে ছুটে আসা তার বাবা শিক্ষক গোলাম ফারুক মজুমদার সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আকিব খুব মেধাবী ছাত্র, আমার স্বপ্ন ছেলেকে ডাক্তার বানাব। কিন্তু ডাক্তার হতে এসে ছেলে এখন আইসিইউতে। মাহাদীর সুস্থতার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’
তিনি বলেন, যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের শাস্তি চাই। মেডিক্যাল কলেজ হচ্ছে প্রফেশনাল লেখাপড়ার জায়গা। এখানে ছাত্ররা সবাই আসে পাঁচ বছর লেখাপড়া করে ডাক্তার হওয়ার জন্য। পড়ালেখা করে ছেলে-মেয়েরা ডাক্তার হবে, এটাই সব মা-বাবার প্রত্যাশা। ছেলেরা এসে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় নিজেরাই মারামারি করে। রাজনৈতিক দলের দোষ আমি দেখব না। ছাত্ররা নিজেদের স্বার্থটাই বড় করে দেখে। গ্রুপিং করে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। আমি ছাত্রদের আহ্বান জানাব, তারা যেন কেউ আর এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে। সবাই মায়ের কোল থেকে এসে পড়ালেখা শেষ করে আবার যেন মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারে।
গ্রেফতার দুই, রিমান্ড নামঞ্জুর
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মারামারির ঘটনায় একপক্ষের মামলা দায়েরের পর পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। এরা চমেকের ছাত্র।
শনিবার রাতে কলেজ ক্যাম্পাসে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে নগরীর পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। গ্রেফতাকৃতরা হলেন রক্তিম দে (২১) ও এনামুল হোসেন সীমান্ত (২১)। দুজনেই চমেকের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কোর্টে নেয়ার পুলিশের পক্ষ থেকে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে সরোয়ার জাহানের আদালত আবেদনটি না মঞ্জুর করে।
পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদেকুর রহমান সুপ্রভাতকে বলেন, ‘চমেকের ছাত্র আকিবকে মারধরের ঘটনায় মামলা হয়েছে। ওই মামলার এজাহারভুক্ত চমেকের ছাত্র দুই আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার রক্তিম মামলার এজাহারভুক্ত ১১ নম্বর ও সীমান্ত ১৫ নম্বর আসামি।
এর আগে, গত শুক্রবার চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারি হয়। এতে নাছির অনুসারী দু’জন আহত হয়।
এই ঘটনার জের ধরে গত শনিবার ক্যাম্পাসে উপমন্ত্রীর অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী মাহাদি জে আকিবকে (২১) মারধর করে নাছির অনুসারীরা। পরে দুইপক্ষে আবারও মারামারির ঘটনা ঘটে। আহত আকিব বর্তমানে চমেক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন।
এই ঘটনার পর শনিবার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রাতই ছাত্রাবাস ছাড়েন শিক্ষার্থীরা। মাহাদি জে আকিবকে মারধরের ঘটনায় তার ভাই তৌফিকুর রহমান বাদি হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সবাই চমেকের ছাত্র।
মামলার আসামিরা হলেন- সাদ মোহাম্মদ গালিব (২১), আহসানুল কবির রুমন (২১), জাহিদুল ইসলাম জিসান (২১), মাহাদি বিন হাশিম (২৪), আসিফ বিন তাকি (২৫), ইমতিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী (২১), মাহতাব উদ্দিন রাফি (২১), জাহিদুল আলম জিসান (২১), সৌরভ ব্যাপারী (২১), মো. আনিস (২১), রক্তিম দে (২১), এইচ এম আসহাব উদ্দিন (২১), তানভীর ইসলাম (২১), নাজমুস সাদাত আসিফ (২১), এনামুল হাসান সীমান্ত (২১) ও রিজওয়ান আহমেদ (২১)।