স্বাধীনতার অর্থ হলো ‘আমরা পারি’

মোহীত উল আলম »

সতের কোটির ছোট্ট একটি দেশ। লোকের ভিড়ে কোথাও কিছু করার উপায় নেই। আগুন লাগলে ভবনগুলির ঘিচাঘিচি করে দাঁড়ানোর জন্য আগুন নেভানো দলের জলের নলগুলো পর্যন্ত ঢোকানোর উপায় থাকে না। মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়, আগুন দেখার দর্শকের ভিড়ে লাশ নামানোর পর্যন্ত উপায় থাকে না। এমন একটা দেশ এক এক করে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করলো। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি / সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।’
শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজিক নায়ক ম্যাকবেথের একটি উক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের উত্থানের হিসাবটা বেশ মেলানো যায়। ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে খুন করতে যাবেন, কিন্তু একটু দ্বিধা নিয়ে ভাবছেন, ওঁকে যদি আমি হত্যা করি তা হলে যে দয়া একটি সদ্য প্রসূত নাঙা শিশুর মতো অসহায়, সে দয়া ঐশ্বরিক শক্তি প্রাপ্ত হয়ে দেবশিশুর মতো বলবান হয়ে চারদিকে বলে বেড়াবে যে ম্যাকবেথ আমাকে হত্যা করেছে, তোমরা জেনে রাখো। ঠিক বাংলাদেশ যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণার ফলে ২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণ করে দীর্ঘ নয় মাস রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের পর বহু শহীদের রক্তের এবং বহু নারীর সতীত্বের বিনিময়ে, তখন এই বাংলাদেশের অবস্থা ছিল ম্যাকবেথের উক্তির মতো ‘ন্যাকিড নিউ-বর্ন বেইব’ বা নাঙা অসহায় শিশু। তখন বিশ্ব জনমতের একটি মহলে প্রচারিত হয়েছিল বাংলাদেশ হলো একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। কিন্তু আজকে ২০২৪ সালের স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশ বুক উঁচিয়ে ম্যাকবেথের মুখনিশ্রিত দ্বিতীয় চিত্রকল্পটির সমর্থনে বলতে পারছে: ‘হেভেনস চেরুবিনস, হর্সড . . . শ্যাল ব্লো দ্য হরিড ডিড ইন এভরি আই’। অর্থাৎ, পক্সক্ষীযুক্ত দেবশিশু হয়ে এই অসহায় শিশুটিই দুনিয়ার চোখে ম্যাকবেথের আকাম সম্পর্কে জানিয়ে দেবে। এই শক্তিশালী দেবশিশু, যেটি সদ্যপ্রসূত নাঙা অসহায় শিশুর পুরো বিপরীত চিত্রকল্প, সেটিই আজকের বাংলাদেশ।
সদ্য প্রসূত অসহায় নাঙা শিশু থেকে সবল ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত দেবশিশুতে রূপান্তরিত হবার লৌকিক অর্থ হচ্ছে জাতীয় চরিত্রে ‘আমরা পারি না’ এমন একটি ভাব থেকে ‘আমরা পারি’ এমন একটি ভাবের উদয় হওয়া। এই ‘আমরা পারিটা’ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের মূল তাৎপর্য।
অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের ভয়াবহ সূত্র ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুরুর বছরগুলোতে আমরা সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছিলাম। এত মুখ, এত পেট আমরা খাওয়াবো কী করে। খাদ্য যে অপ্রতুল, কিন্তু মানুষ যে প্রচুর। ম্যালথাস বলেছিলেন না, খাদ্য বাড়ছে অ্যালজেব্রার গতিতে, আর মানুষ বাড়ছে তার দ্বিগুণ জ্যামিতির গতিতে, সুতরাং, আমরা ভয়ে ভয়ে একে অপরের দিকে তাকালাম, তা হলে, বাংলাদেশের মানুষ কি ক্যানিবল হয়ে যাবে, নরখাদক হয়ে উঠবে! এর মধ্যে পৃথিবী উত্তরাধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে। বলা হলো, মানুষ সংকট নয়, মানুষ হলো সম্পদ, কারণ মুখ ও পেট থাকলেও, তার চেয়ে অতি শক্তিধর হচ্ছে মগজ, হাত ও পা। অর্থাৎ বুদ্ধি, সৃজনশীলতা আর প্রায়োগিক ক্ষমতা। সে অর্থে বাংলাদেশের অতি বড় লোকসংখ্যা হচ্ছে প্রকৃত অর্থে সম্পদের আধার। একটা বা দুটো তুলনা দিই। ধেনো মরিচ আকারে খুব ছোট, কিন্তু ঝালে প্রচণ্ড, কিংবা হাত বোমা খুব ছোট হয়, কিন্তু শক্তিতে প্রচন্ড। ঠিক সেরকম বাংলাদেশ: আকারে খুব ছোট, কিন্তু লোকসংখ্যায় পৃথিবীতে ৮ম। তা হলে মানবসম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশের কোনো খামতি নেই।
কিন্তু বড় কাজটা হলো এই মানবসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করা। সে পথে আমাদের এগোতে হবে। এই অর্থে আমরা বলি যে আমাদের সম্পদ আছে, কিন্তু সে সম্পদটা কীভাবে ব্যবহার করবো সে পরিকল্পনাটা আমাদের শক্তিশালী না। ব্যাপারটা নীতি এবং তার প্রয়োগের পদ্ধতির প্রশ্ন।
এই জায়গাটা নিয়ে আমি কিছু চিন্তা এখানে প্রসারিত করতে চাই।
প্রতি শুক্রবারে মসজিদে যাবার পথে এবং ফিরে আসার পথে ভিক্ষুকেরা ভিক্ষার জন্য থালা পেতে থাকে। একটু খেয়াল করে দেখি, এই জরাজীর্ণ শাড়ি পরা মহিলার হয়তো কোন গৃহবধূ হিসেবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করার কথা ছিল, নিজের মানসম্মান খুয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ানোর কথা ছিল না। মোড়ে মোড়ে ব্যক্তিগত গাড়ি দাঁড়াতেই পারে না, ভিক্ষুকের মুঠির আঘাত গাড়ির কাচের ওপর পড়ে, গাড়ীর আরোহীর বিবেকের বারবার মৃত্যু হয়। অথচ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সৃষ্টি করার পেছনে অন্যতম অঙ্গীকার ছিল সকল মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। দরিদ্র লোকের দারিদ্রের নি:সঙ্কোচ নিরসন তিনি দেখতে চেয়েছিলেন।
স্বাধীনতার আজকে ৫৩ বছর পূর্তি হচ্ছে, বাংলাদেশ টানেলের যুগে প্রবেশ করেছে, কিংবা রকেট উৎক্ষেপণের শক্তি অর্জন করছে, কিন্তু দারিদ্র নিরসনের কাজটি ব্যাপকভাবে এখনও অবহেলিত। এটা সত্য যে নিরন্ন, দুবেলা দুমুঠো খেতে পায় না এই জনসংখ্যা বহুল পরিমাণে কমেছে, কিংবা আশ্রায়নের ফলে হাজার হাজার দরিদ্র লোকের বসতি হয়েছে, কিন্তু এটাও সত্য যে দারিদ্রের প্রকটতা কমলেও, দেশের অর্থনীতির ছকে ধনী এবং দরিদ্র লোকের মধ্যে বর্তমান দশকগুলোতে বিশাল পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। এবং স্বাধীনতা দিবসের মতো জাতীয় দিবসগুলো পালন করার সময় এই ক্রমবর্ধমান প্রভেদটাই আমাদেরকে কাঁদায়।
গণমাধ্যমে এ খবর এসেছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ভার এ প্রথম ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করল। মোট ঋণের পরিমান প্রায় প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসেবে ১১ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকার মতো। বলা হয়েছে, জনপ্রতি ঋণের ভার ৫৭৪ ডলার বা ৬৩,১৪০ টাকা বছরে। সংস্কৃত শ্লোকে বলে ঋণ করে ঘি খাওয়া।
কিন্তু এ ঋণটি না পেলে টানেল আসতো না, কক্সবাজারে রেল যেত না, মেট্রো রেল হতো না, রূপপুর পারমাণবিক চুল্লী হতো না ইত্যাদি। সমস্যাটা ঋণ বৃদ্ধিতে নয়, সমস্যাটা হচ্ছে অর্থনৈতিক শৃক্সক্ষলা আরোপণে। বাস্তবে তো আমরা এটা দেখছি, যে শিল্পপতির অবস্থা যত ভালো সে শিল্পপতির ঋণ তত বেশি। আসলে ঋণ প্রদান এবং গ্রহণের শৃক্সক্ষলা কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে যে সব সংস্থা কার্যকর ভূমিকা পালন করার কথা তারা সে কাজগুলি করছে না বা করতে পারছে না। এমনও বলা হচ্ছে অর্থনীতিতে বিশৃক্সক্ষলা আনয়নের জন্য যে সব শিল্প প্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গ দায়ী তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী। আমার একজন ব্যাংকার ছাত্র সমস্যাটা আমাকে এভাবে বুঝিয়েছে। সে বলেছে, ধরুন স্যার, আপনার বাসার একটা জানলায় এত জং ধরছে যে আপনি সে জং পরিস্কার করতে গেলে জানলাটাই খুলে পড়ে যাবে। অর্থটা হলো. অর্থনৈতিক দুরাচার এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে সেখানে সরকারি নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থাগুলির কোনো বিধিনিষেধেই কাজ করছে না, কড়াকড়ি করতে গেলেই অর্থনৈতিক ধ্বস নামতে পারে। তখন ক্ষেত থেকে ৬০ টাকা দিয়ে কেনা তরমুজ ৮শ টাকা দিয়েও কিনতে হতে পারে। তার আলামতও শুরু হয়েছে।
কিন্তু আমি আমার ছাত্রের দেওয়া ব্যাখ্যার বাইরে কর্মশীলতা দেখতে চাই। মানলাম যে, সরকারি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর শক্তি নানা অদৃশ্য জটাজালের কারণে নিষ্ফল, কিন্তু একটি দেশপ্রেমিক সরকার, দারিদ্র-নিরসনে উদ্যোগী সরকার, দু:খী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোতে ব্রতী সরকার, যে সরকার জঙ্গী দমন এবং যুদ্ধাপরাধীরদের বিচার করা ও দন্ডপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পেরেছে, যে সরকার নারীর ক্ষমতায়নে ্ও স্বাবলম্বীকরণে দেশকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে, যে সরকার একটি কর্মক্ষম মেধাবী শিক্ষিত চাকরিজীবী যুবগোষ্ঠী তৈরিতে অনেকটা সফল হয়েছে, যে সরকার উদ্যমী সফল ব্যবসার আবহাওয়া গ্রামাঞ্চলের কৃষি অঞ্চলেও ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, সে সরকার কেন অবৈধ আর্থিক লেনদেনের সুরাহা করতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে।
এ ব্যাপারে আমার শুধু একটি যাচনা থাকবে যেন অর্থনীতিবিদ টমাস গ্রেশামের তত্ত্বটি ‘খারাপ টাকা ভালো টাকাকে বাজার ছাড়া করে’ এখানে কার্যকর না থাকে। দলমত নির্বিশেষে অধিকতর যোগ্য ও সৎ লোকদের দিয়ে যেন অর্থনৈতিক শৃক্সক্ষলা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সরকারের সর্ব্বোচ্চ মহল থেকে নেওয়া হয়।
তা হলেই জাতি এবং দেশ হিসেবে আমরা ‘পারি না’ থেকে ‘পারি’র দেশে রূপান্তরিত হবো, সদ্যপ্রসূত অসহায় নাঙা শিশুর পরিবর্তে শক্তিশালী দেবশিশুতে পরিণত হবো। এটাই আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার হোক।
সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।

লেখক : সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ