শেষ ইচ্ছে

শিরিন শবনম »

শুয়ে আছি। কিছুটা দুর্গন্ধ অনুভব করছি। শরীরে ব্যথাও অনুভব করছি।  চোখ খুলে দেখি অপরিচিত একটা রুমে শুয়ে আছি। উঠে দেখলাম, একই রুমে আরো দুজন শুয়ে আছে কিন্তু আলাদা আলাদা জায়গায়। তার মধ্যে একজন বাচ্চা অন্যজন মহিলা। খেয়াল করে দেখলাম, মহিলাটি একা নয় তার মধ্যে আরো একজন আছে, সে গর্ভবতী। চুপ থাকতে বিরক্ত লাগছিল, তাই তাদের ডেকে গল্প করতে ইচ্ছে করছিল। বাচ্চাটি ঘুম। মহিলাটিও হয়তো বিরক্ত হচ্ছিল তাই সেও জেগে ওঠে আমার সাথে কথা বলা শুরু করলো। কথা বলে জানলাম তিনি হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছেন এবং তিনি গর্ভবতী। তারপর আমার কথা জানতে চাইলো … কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলা শুরু করলাম …

আমি রাশেল। গ্রামে এক কৃষকের ঘরে আমার জন্ম। বাবা-মায়ের ভালোবাসার প্রথম চিহ্ন আমি। পরপর আরো দুই ভাই আর এক বোনের জন্ম হয়। খুব সুন্দর আর গোছালো এক পরিবার। বয়স হলো স্কুলে যাবার। বাবার হাত ধরে গেলাম স্কুলে। প্রথমদিন ভালোই লাগলো স্কুল … কিন্তু পড়াশোনা না।

পরদিনও গেলাম। যেতেই থাকলাম। আস্তে আস্তে প্রেমে পড়লাম … এমন প্রেম যা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। মাঝে মধ্যে মনে হতো এই প্রেমের জন্যই বেঁচে আছি। এই জায়গায় অন্য কোন প্রেমের স্থান দেয়া সম্ভব নয়। এবার বলি কার প্রেমে পড়েছি …পড়াশোনা। এই প্রেম নিয়েই আমার জীবনের গল্প।

আমি এমন এক প্রেমিক যে কিনা তার প্রেমকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। আমার ভালোবাসা ছিল খুবই গভীর। দিনরাত আমি তার সাথেই পড়ে থাকতাম। আমার বন্ধু, প্রেমিক, ভালোবাসা সবই ছিল আমার বইপত্র আর পড়াশোনা।

যাক এবার স্কুলে ফিরে আসি।বাবা-মা পড়াশোনা করেনি। তাই আমাদের যা করাচ্ছেন তা হয়তো সমাজকে দেয়া কথা রাখার জন্য আর স্বাক্ষর করা শেখানোর জন্য। ছোট ভাইবোন বাবার স্বপ্নপূরণ করলো। তারা স্বাক্ষর করা শিখে গেলো। তাই তাদের পড়াশোনার যাত্রা শেখানেই শেষ। কিন্তু আমি থামার নই। আমি আমার প্রেম ছাড়বো না। আর এই বিষয়ে সাহায্য করেছে আমার মা। খেতে পাই আর না পাই মাকে সাথে পেয়েছি। আর মায়ের এই সঙ্গ আমার প্রেম থেকে আমাকে আলাদা হতে দেয়নি। আর তখন থেকেই নিজের ভেতর এক ইচ্ছের জন্ম নিয়েছে, আর তা হলো একদিন এমন কিছু হবো যে পুরো পরিবার, সমাজ সকলে আমাকে নিয়ে গর্ব করবে। কোথাও আমার নাম শুনলেই বলবে ‘রাশেল তো আমাদের এলাকার ছেলে’। আস্তে আস্তে স্কুল কলেজ এবং সমাজে ভালো এবং ভদ্র ছেলে হিসেবে সুনাম অর্জন করলাম। সবাই বলতো আমি নাকি দেখতেও বেশ সুদর্শন। অনেকেই জানতে চাইতো কেন আমি কোন রমণীকে আমার জীবনে স্থান দিচ্ছি না। মনে মনে হাসতাম। কারণ আমি তো জানতাম, আমি ইতিমধ্যে একজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। যেহেতু আমি একজনের প্রেমিক সেহেতু অন্য কারো বা কিছুর প্রতি প্রেম অনুভব করা আমার পক্ষে সম্ভব বলে আমি মনে করি না। কিন্তু এই বিষয়ে আমি কারো সাথে কোন তর্ক করতাম না। এইজন্য অনেকেই বলতো আমি নাকি একটু বেশি শান্ত। অনেকের এটি পছন্দ ছিল, আবার অনেকের অপছন্দ।

যাক, সফলতার সাথে স্কুল এবং কলেজ পার করলাম ভালো রেজাল্ট নিয়ে। এরপর চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো একটি বিষয়ে পড়ার সুযোগও পেলাম। সবাই বলছিল আমি আমার যোগ্য জায়গায় পৌঁছেছি। কিছুূদিন পর দেখলাম বাবা-মায়ের একটু মন খারাপ। জানতে পারলাম আমার জন্য। কারণ ছোট দুভাই বিদেশ গিয়ে ভালোই অর্থ উপার্জন করছে আর আমি এখনো আছি আমার প্রেম আর ভালো রেজাল্ট নিয়ে। যাক এসব মনখারাপের কথা মাথায় নিয়ে সামনে এগুতে থাকলাম এবং মাথায় একটি কথা গেঁথে রাখলাম, একদিন বাবা মায়ের সামনে বিসিএস ক্যাডার হয়ে গিয়ে চমকে দেবো …চমকে দেবো পুরো সমাজকে এবং আমি জানি আমি পারবো।

স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করলাম রীতিমতো ভালো ফলাফল নিয়ে। এরপর শুরু হলো আসল যুদ্ধ। বাবা-মায়ের বউ চাই আর আমার চাই চাকরি। এইদিকে দেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী চাকরি পাওয়া এতো সহজ ছিলো না। বিসিএস প্রিলি দিলাম। বিশ্বাস ছিলো যে টিকে যাবো। বিশ্বাসের জয় হলো। এরপর যখনি রিটেন এর প্রস্তুতি নেয়া শুরু করবো তখনি বাবা-মা বলে উঠলো, হয় বাড়িতে এসে এই মাসেই বিয়ে করবি না হয় আর আমাদের মুখ দেখবি না। এইদিকে মেয়েও দেখে রেখেছেন তারা। কি আর করার। বাবা-মায়ের সাথে কথায় পেরে উঠলাম না। পরীক্ষার প্রস্তুতি ছেড়ে বাড়ি গেলাম। বিয়েতে একপ্রকার সম্মত না থাকা শর্তেও বিয়েটা করতে হলো।

বাসর ঘরে সেদিন প্রথম আমার অর্ধাঙ্গিনীর চাঁদমুখ দেখলাম। মাশাআল্লাহ … এই প্রথম এতো সুন্দর রমণী দেখলাম। হয়তো এর আগে কোন রমণীর দিকে এমনভাবে তাকানো হয়নি। তাই সুন্দর কি, তাও দেখিনি। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম হায়রে অভাগী শেষমেশ বেকার স্বামীর সাথে নতুন অধ্যায় শুরু করলি, পারবি তো একসাথে পথচলতে?  সেদিন তাকে কোন উপহার দিতে পারিনি বলে খুব মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু মনে মনে পণ করলাম, একদিন তাকে এমন এক জিনিস উপহার দেবো যেদিন তার মনে হবে আমার মতো স্বামী পেয়ে তার জীবন সার্থক। এরপর থেকে চাকরির জন্য খুব বেশি পড়া শুরু করলাম। কিন্তু আমার অর্ধাঙ্গিনী তার আর আমার মাঝে আমার পুরাতন প্রেমকে সহ্য করতে পারছিল না। কয়েক মাস যেতে না যেতেই সে আমার প্রতি খুব বিরক্ত হয়ে গেলো। স্বাভাবিক তারও তো ইচ্ছে করে তার স্বামী তার জন্য কোন উপহার নিয়ে আসবে তাকে নিয়ে ঘুরবে। তাকে সময়  দেবে … কিন্তু কি করবো বলো প্রিয় … আমার কাছে যে চাকরি নেই। কিছুদিন পর রিটেনের রেজাল্ট দিলো। মা-বাবা বউ সবাই অধিক আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল। বাড়িতে মাথা নিচু করে  ঢোকার পর মা আমায় কিছু জিজ্ঞেস না করে জড়িয়ে ধরে বললো, এটা কোনো ব্যাপার না বাবা। পরের বার আবার দিও। কিন্তু বউ আমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সেদিনই বাপের বাড়ি চলে গেল। তারপর তাকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করলাম। তাকে বলেছিলাম, একটু সময় দাও প্রিয়,  তোমায় আমি সব দেব … কিন্তু কিছুদিন পর সে আমাকে এমন এক উপহার দিলো যা আমাকে সফলতার দুয়ার অবধি পৌঁছে দিয়েছে। সে আমার জন্য তালাকপত্র পাঠালো। বইপত্রের পর সে ছিল আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। কেমনে তার আবদার পূরণ না করে থাকতে পারি। সে ভালো থাকুক … এই আমার প্রাপ্তি। পরে ভাইদের সাহায্য নিয়ে তার দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করলাম। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেলো …

এরপর থেকে আমার একটাই ইচ্ছে আমার মাকে একটি পরিচিতি উপহার দেবো আর তা হলো বিসিএস ক্যাডার রাশেলের মা। ডিভোর্স এর কিছুদিনের মাথায় আমার প্রাইমারিতে চাকরি হয়ে গেলো। ছোট দুই ভাইয়ের বিয়ে হলো। কিন্তু আমি এখানে থামলাম না। একটা মোটরসাইকেল নিয়েছি। এখন আমার বলতে সেই আছে। কাল দিনটা আমার জন্য বড়ই খুশির দিন ছিল … কেন জানেন? বিসিএস ভাইভার রেজাল্ট দিয়েছে … কাউকে কিছু না বলে বাজারে গেলাম। ১০কেজি মাছ, সবজি আর মিষ্টি নিয়ে সোজা বাড়ির পথে যাত্রা করলাম। সবার আগে আমার মাকে বলবো, জড়িয়ে ধরবো মাকে। বলবো, মা তুমি রাশেলের মা। বিসিএস ক্যাডার রাশেলের মা তুমি। তোমার কি লাগবে শুধু বলবে আমায়, আমি সব তোমার পায়ের নিচে এনে  দেবো … ভাবতে ভাবতে মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলাম … চোখে কল্পনা আর স্বপ্ন। ভাবছি এই বুঝি আমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হতে চললো আর তা ভাবতে ভাবতে কান্নায় ঝাপসা হয়ে আসছিল চোখ। এই তো পৌঁছে গিয়েছি, আর বেশিদূর নেই …

চোখ খুলে দেখলাম আমি মেডিকেলের বেডে শুয়ে আছি। মা আমার হাত ধরে বসে রয়েছে। খুব বেশি ঘুম পাচ্ছিল। বেশি কথা বলার মতো শক্তিও পাচ্ছিলাম না। মাকে শুধু বললাম. ‘মা আমায় ক্ষমা করে দিও …

গল্প বলতে বলতে কেঁদেই দিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম রুমে কাগজপত্র নিয়ে কিছু লোক আসলো। বাচ্চাটির কাছে গিয়ে একজন লিখছিল অন্যজন কিছু বলছিল। শোনার চেষ্টা করলাম। তারা বলছিল, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছে। এবার মহিলাটির কাছে এসে বললো, একে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাও। জানতে পারলাম, তার স্বামী তাকে মেরে ফেলেছে। খুব খারাপ লাগলো মহিলাটি আর বাচ্চাটির জন্য। জানি না তাদের গল্প কি। সবাই খুব তাড়ায় ছিল তাই তাদের গল্প জানতে পারলাম না। এবার আমার বাবা এবং বাকি দুজন লোক আমার কাছে এসে বললো, আপনারা কাগজপত্র তৈরি করে ওনাকে নিয়ে যেতে পারেন। আপনাদের ভাগ্য ভালো যে, থানার কাজ জলদি শেষ হয়েছে। টাকা না দিলে হয়তো এতক্ষণে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হতো। এখন আমায় নিয়ে যাবার পালা। মহিলাটি আর বাচ্চাটিকে হয়তো আরো কিছু সময় রাখবে। আমায় লাশ ঘর থেকে বের করা হলো।

এম্বুলেন্সে করে আমায় বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। তখন সন্ধ্যা ৬টা প্রায়। আমায় গোসল দেয়া হলো। পরিষ্কার এক টুকরো সাদা কাপড় পরিয়ে বারান্দায় রাখা হলো আমায়। সবাই দেখতে এলো। কেউ আমার জুতো, কেউ বা জামা নিয়ে কান্নায় ব্যস্ত। হঠাৎ এতো ভিড়ের মধ্যে আমার প্রেয়সীর চাঁদমুখ দেখতে পেলাম। ভাবলাম মৃত্যু কি সুন্দর! আজ আমার ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিস সবার কাছে অমূল্য। আমার বলা প্রতিটি কথা, আমার বসার স্থান সবকিছু। আজ আমার প্রেয়সীর চোখে আমার জন্য জল এনে দিয়েছে। মানে সেও আমাকে ভালোবাসতো। মৃত্যু আসলেই সুন্দও … বিচ্ছিরি রকমের সুন্দর। কিন্তু একট্ ুপর খেয়াল করলাম, তার কোলে আরেকটি চাঁদমুখ। মনে মনে ভাবলাম তোমায় অভাগী ভেবেছিলাম প্রিয়, কিন্তু তুমি অনেক ভাগ্যবতী। যদি তোমায় আটকে রাখতাম তাহলে আজ তোমার পরিচয় হতো বিধাব … বধূ নয়। যাক ওই যে ভেতরে আমার ভালোবাসাগুলো দেখা যাচ্ছে। তাদের দেখে মনে মনে হাসলাম আর ভাবলাম কাল হয়তো এদের বস্তা ভরে বিক্রি করে দেয়া হবে। সময় শেষ … একটু পর আমায় নিয়ে রওনা হবে সবাই ওই গোরস্তানের উদ্দেশ্যে।

আর রাত ১০ টায় আমার জানাজা …