রাহিমার যুদ্ধ

সাঈদুর রহমান লিটন :

একে একে পাঁচটি পরীক্ষা হয়ে গেল মেয়েটির। মেয়েটির মন সবসময় খারাপ থাকে। মুখটি থাকে শুকনো। পরীক্ষা শেষে মেয়েটিকে ডিউটিরত শিক্ষক বললেন,
মারে, তোমার মুখটি শুকনো থাকে কেন, মা। আদরের সুরে কথা বলায় মেয়েটির প্রায় কেঁদে দেয় দেয় ভাব। শিক্ষক মাথায় হাত দিয়ে বললেন, মারে কেঁদ না। কি হয়েছে বলো।
মেয়েটি প্রাক সমাপনী পরীক্ষা দিতে এসেছিল। পরীক্ষাগুলো হয়েও গেছে।
মেয়েটি বলল, আমি যে কয়টি পরীক্ষা দিয়েছি, সব কয়টি না খেয়েই দিতে এসেছি স্যার।
স্যার বললেন, কেন মা, না খেয়ে পরীক্ষা দিয়েছ?
স্যার আমাদের রান্না করার মতো চাল নেই, তাই। বাবা রিকশা চালায়। যা পায় তা দিয়ে রাতে খাবার হয় দিনের খাবার হয় না।
কি বলো?
জ্বি স্যার। আমরা ছয়বোন। আমাদের ভাই নেই। বাবা অসুস্থ। ঠিক মতো এখন রিকশা চালাতে পারে না। যা চালায় তাই দিয়ে রাতে রান্না হয়। সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমাই। সকালের খাবার থাকে না।
শিক্ষক হতভম্ব হয়ে যান শুনে। মেয়েটিকে দোকান থেকে কলা আর রুটি কিনে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে পিছন ফিরে রুমালে চোখ মুছেন। এমনও লোক আছে?
মেয়েটির নাম রাহিমা। পুরো নাম রাহিমা সুলতানা। রাজবাড়ি জেলায় বাড়ি। গ্রামের নাম হাজরাখালি। গ্রামের পাশ দিয়ে একটি নদী বয়ে গেছে। নদীর নাম কুমার নদী। নদীটি এখন নাব্যতা হারিয়েছে। রাহিমার বাবা লতিফ সেক অপরিকল্পিত পরিবার গঠনের জন্য কুমার নদীর মতো তার জীবনেও তেমন সচ্ছলতা নেই। অভাব আর দারিদ্র্য তার জীবনের নিত্যসঙ্গী। রাহিমারা ছয়বোন। একটি ছেলের আশায় রাহিমার বাবা লতিফ সেক গুনে গুনে ছয়কন্যার বাবা হয়েছেন।
রাহিমা কন্যাদের মধ্যে দ্বিতীয়। পড়াশুনায় খুব ভাল। তাকে বিনা দ্বিধায় মেধাবী বলা চলে। সমাপনী পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। রাহিমা এ-প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হলো।
রাহিমাদের পরিবারে আনন্দের উচ্ছ্বাস নেই। অভাবীদের উচ্ছ্বাস করতে হয় না। পরীক্ষার ফলাফলের দিনেও রাহিমাকে বাবার সাথে মাঠে নিড়াতে হয়েছে। রাহিমারা বাবার কাজে মাঠে সহায়তা করে। নিড়ানো, ধানকাটা, পাটকাটা ইত্যাদি করে। যদি সংসারে একটু সচ্ছলতা আসে। এই আশায়।
রাহিমার বড়বোন ক্লাস এইটে পড়ে। দেখতে খুব সুন্দর। রাহিমা ও দেখতে খুব সুন্দর। ফুলের মতো। শুধু সুবাস ছড়াতে বাকি। রাহিমার বড়বোন জেএসসির ফরম ফিলাপের টাকা জোগাড় করতে না পারায় পাশের গ্রামের এক ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। রাহিমা ভাবে, এরপরের সিরিয়াল আমার। আমি তো বিয়ে বসব না। বাবাও তো খরচ মিটাতে পারবে না। তাহলে পড়াশোনার খরচ আমাকেই জোগাড় করতে হবে। রাহিমার সংগ্রামী জীবন শুরু হলো। সে টিউশনি করতে শুরু করলো ছোট বাচ্চাদের। তার পড়ানোর কৌশল, বুদ্ধিমত্তায় এলাকার সকল বাচ্চা রাহিমার কাছে পড়তে শুরু করলো। রাহিমার ক্লাসের ছাত্ররাও কেউ কেউ রাহিমার কাছে পড়েতে আসে। রাহিমার জেএসসি পরীক্ষা হয়ে যায়। রাহিমা স্কুলে না যেয়ে মাঝে-মাঝেই বাবাকে মাঠে সহয়াতা করে। ওর টিউশনিতে রাহিমাদের সংসারের অনেকটা অভাব দূর হতে চলেছে। এই পরীক্ষায়ও রাহিমা গোল্ডেনসহ জিপিএ ফাইভ নিয়ে পাস করে। রাহিমার সকল বোনই স্কুলে যায়। রাহিমার বড়বোনের বিয়ে হওয়াতে ছোটবোনদের দায়িত্ব এখন রাহিমার ওপর। রাহিমা টিউশনির সংখ্যা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। না বাড়িয়ে উপায় নাই।এখন বোনদের পড়ার খরচ রাহিমাকেই বহন করতে হয়।এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফ্লিলাপের সময়ও রাহিমার কারো কাছ থেকে ধার নিতে হয়নি। লেখাপড়া ঠিক চললেও সংসার ঠিক মতো চলছে না। কোনো কোনোদিন সংসারে সবাইকে উপোসও করতে হয়। একবেলা খুদের খিচুড়ি খেয়েও দিন যায় রাহিমাদের। ইতিমধ্যে রাহিমার ছোটবোনকে বিয়ে দেওয়ার জন্য বাবা ছেলে দেখেছে। বিয়ে ঠিকঠাক হলো। কিন্তু বিয়ে উঠিয়ে দেবার মতো লতিফ সেকের টাকা ছিল না।রাহিমার নামে একটি এনজিও থেকে ঋণ নেওয়া হয়। এনজিওরা মেয়েদের নামে লোন দেয়। রাহিমার মায়ের নামে লোন থাকায় বাধ্য হয়ে রাহিমার নামে লোন নিতে হয়।
রাহিমা প্রাইভেট পড়িয়ে লোন পরিশোধ করতে থাকে। মায়ের লোন, নিজের লোন। বাবা অসুস্থ। অসুস্থতা দিন দিন বাড়তে থাকে। বাবা কাজের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এসএসসি পরীক্ষায়ও রাহিমা এ-প্লাস প¬ায় গোল্ডেনসহ। এর মধ্যে রাহিমা কোনো এক দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে মাসে সামান্য মাসিক বৃত্তি পেতে থাকে। যৎসামান্য। সংসার মোটেই চলেই না। রাহিমা পড়াশোনা করবেই। বাবার পাশে দাঁড়াবে, এটাই রাহিমার পণ। ছেলেরা বাবাকে সহায়তা করতে পারলে, রাহিমা কেন পারবে না। রাহিমার মনে প্রচ- দৃঢ়তা। টিউশন এখন মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে করতে শুরু করলো।
অদম্য মনের অধিকারী রাহিমার মাথায় পড়ার চাপ। বোনদের পড়ার খরচ। বাবার ওষুধের টাকা। সংসার খরচ। সব মিলিয়ে কঠিন এক জীবন সংগ্রাম।
অসুস্থ বাবাকে মাঠে সহায়তা তো আছেই। টিউশনি করেও আর চলছে না। কলেজ থেকে ফেরার পথে রাহিমা একটা পার্টটাইম জব নেয়। রাহিমার হাতে কোনো সময় নেই। যান্ত্রিক জীবন।
এইচএসসিও পাস করে রাহিমা। সেবারও জিপিএ ফাইভ পায়। বাড়ির কথা চিন্তা করে নিজের এলাকার একটা কলেজে গণিত বিষয়ে ভর্তি হয় রাহিমা। ডাক্তার হবার স্বপ্ন, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হয় রাহিমাকে। বাবার অসুস্থতা বাড়লে বাবাকে ভর্তি করতে হয় হাসপাতালে।অনেক টাকা খরচ হয় তখন।
রাহিমা তার কাকাদের কাছে সহায়তার কথা তুললে কাকারা বলে তাদের জমিটুকু বিক্রি করে দিতে।
রাহিমা খুব কষ্ট পায়। বলে মরে গেলেও বাবার সম্পত্তি বিক্রি করবে না সে।
আবার ঋণ করে রাহিমা। এবার বড় অংকের ঋণ। বাবাকে সুস্থ করে নিয়ে আসে সে। মাঝে মাঝে কলেজে যেতে হয় তার। সদা হাসির এই মেয়েটির ঠোঁটের নিচে একটি অতি সুন্দর তিল আছে।
এখন অনেক বই কিনতে হবে তার। টাকা লাগবে অনেক। টিউশনিতে, আর পার্টটাইম জবে পারা যায় না সহজে।
চতুর্থ বোনের বিয়ের জন্য রাহিমা অন্য এনজিও থেকে আবার ঋণ নিতে বাধ্য হয়।
বাবাকে মাঝে মাঝেই হাসপাতালে নিতে হয়।
ঋণের পরিমান বাড়তেই থাকে। রাহিমা এনজিও থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে বাবার হাসপাতালের দেনা পরিশোধ করে। রাহিমা লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। লেখাপড়ার যত টাকা লাগবে গ্রামীণ ব্যাংক বহন করবে। চাকরি করে ঋণের টাকা পরিশোধ করবে। তাই লেখাপড়ার খরচ নিয়ে তার অতটা ভাবতে হয় না। ভাবতে হয় সংসার নিয়ে। আর সংসার নিয়ে এত ভাবনার কারণে অনেকে ভালো চাখে তা দেখে না। শুধুমাত্র রাহিমার জন্য লতিফ সেক সংসার পরিচালনা করছে ভালোভাবে। কারো কাছে ধার ধারতে হয় না। যে কারণে রাহিমা তাদের কাছে চোখের কাঁটা। রাহিমা না থাকলে ভিটেবাটি যা আছে তা এতদিন টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যেত। রাহিমার কত স্বপ্ন ডাক্তার হবে, না হয় ইঞ্জিনিয়ার। রাহিমা বাড়ি থেকেই কলেজ করে। সকালে প্রাইভেট পড়িয়ে কলেজে যায়। কলেজ থেকে ফিরে আবার পড়ানো। শুরু হয় যান্ত্রিক জীবন। এর মাঝে আরেকজন ছোটবোনের বিয়ে দেয়। রাহিমার মা একজন সাদাসিধে মানুষ। তিনি রাহিমাকে নিয়েও ভাবেন। রাহিমাকে বলে, তুই ছোটবোনদের বিয়ে দিচ্ছিস। তুই বিয়ে করবি কবে।
রাহিমা বলে, মা আমার ভাই নাই। আমার বাবার মনে দুঃখ। আমি দেখিয়ে দিতে চাই, একজন ছেলে যেমন বাবা-মাকে দেখতে চায়, ভলো রাখতে চায়, আমিও তাই চাই। আমিও দেখিয়ে দেব যাদের ছেলে আছে, তারাই শুধু মা-বাবাকে সুখী করতে পারে না। আমি ও পারি। রাহিমার অনার্স থার্ড ইয়ার চলছে। মাথায় বোনদের পড়ালেখার খরচ। আরেক বোনের পাত্রপক্ষ দেখে গেছে। তার বিয়ের টেনশন। বাবার ওষুধ কেনা। নিজের পড়াশোনা। কলেজ যাওয়া আর টিউশনি করা। একগাদা দায়িত্ব নিয়ে রাহিমার পথ চলতে হয়। রাহিমা টিউশনি এখন শুধু বাড়িতেই করে না। অন্যের বাড়ি গিয়েও পড়ায়।
আজও সেই হেঁটে হেঁটে টিউশনি করতে যাওয়ার ছন্দময় শব্দ শোনা গেল। দূর থেকে কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে আসে ভোরের সূর্যের মতো রাহিমার অবয়ব।