রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আদ্যোপান্ত

আবদুল মান্নান »

বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করছেন। তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত সর্বোচ্চ পাঁচ বছর করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আগামী ২৩ এপ্রিল তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ পূরণ করছেন। কর্মসূত্রে তাঁর সাথে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে কেমন ছিলেন মো. আবদুল হামিদ তা ইতিহাস বিচার করবে। তবে বলতে পারি মানুষ হিসেবে তিনি একজন অসাধারণ ব্যক্তি।
সংবিধানের ৪৮ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার দায়িত্ব সংসদ সদস্যদের। ভারতসহ বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এই রেওয়াজ পরিচালিত আছে। সম্ভবত বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যেখানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা খুবই জটিল। হিলারি ক্লিনটন ত্রিশ লক্ষের বেশী জন সমর্থন পেয়েও জর্জ বুশের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। আবার বুশকে জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্লোরিডা অঙ্গ রাজ্যের গভর্নর বুশের ভাই জেব বুশ ভোট গণনা নানা অজুহাতে বন্ধ রেখেছিলেন। বুশকে বিজয়ী ঘোষণা করার কয়েকদিন পর ওই রাজ্যে ভোট গণনা শেষ হলে জানা গেলো বুশের প্রতিদ্বন্ধী ডেমোক্রেট প্রার্থী এল গোরই সেই নির্বাচনে জিতেছিলেন। মার্কিন মুলুকের হিসাবে তখন সময় শেষ। ভাবা যায় এমন একটা পরিস্থিতি বাংলাদেশে? সেই অন্য প্রসঙ্গ। তাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞার সাথে আমাদেরটা মিলবে কেন?
ফিরে আসি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি মনোনীত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ভারতের তিস্তা নদীর উজানে বাগডোগড়া নামক স্থানে (শিলিগুরি মহকুমা, দার্জিলিং জেলা)। এই সিদ্ধান্তে অংশ নিয়েছিলেন ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে বিজয়ী হওয়া প্রায় চারশত সংসদ সদস্য। এ’ছাড়াও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি করে ছয় সদস্যের মন্ত্রী সভা গঠিত হয়েছিল। গৃহীত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র যা সংবিধানে প্রস্তাবনা হিসেবে অন্তর্ভুুক্ত। প্রস্তাবনা ১৯৭২ সালের সংবিধান সংসদে গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে এই প্রস্তাবনা মূল সংবিধানের শুরুর স্থান হতে পরিশিষ্টের অংশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার এই প্রস্তাবনা পাঠের পর শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানি কারাগারে। তাঁর অবর্তমানে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্ত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরেন। তিনি তখনো রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন নি। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করবেন। ১২ জানুয়ারি শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু প্রথম সরকার গঠন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে নূতন সরকার গঠন করেন। তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েমের কাছে শপথ নেন। তিনি ছিলেন দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণিত হলে তিনি পুনরায় সংবিধানের আলোকে সংসদ সদস্যদের দ্বারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন হলে বঙ্গবন্ধুকে সংসদ দেশের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে এবং একই বছর ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে হত্যার রাজনীতি চালু হয়। ১৫ই আগাস্টের ঘাতকদের অন্যতম শিরোমনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর খোন্দকার মোশতাক আহমদ। তখনো দেশে সংবিধান বলবৎ ছিল। সাংবিধানিকভাবে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার কথা। মোশতাকের কাছে তখন সংবিধানের কোন অস্তিত্ব নেই। তিনি ৮৬ দিন ক্ষমতায় ছিলেন তারপর তাকে হঠিয়ে জিয়া ক্ষমতা দখল করেন এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সায়েমকে সাক্ষীগোপাল রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেন। পরবর্তীকালে সায়েমকে অনেকটা জোরপূর্বক অপসারণ করে জিয়া নিজে ক্ষমতা দখল করে এক অভিনব পদ্ধতিতে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ‘নির্বাচিত’ করে ওই পদটির মর্যদা কলুষিত করেন। ১৯৭৭ সালে জিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একটি তামাশা জাতিকে উপহার দেন যেখানে তিনি একমাত্র প্রতিদ্বন্ধী। জনগণকে বলা হলো তাঁকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সমর্থন করেন কিনা তা ‘হা’ বা ‘না’ বলে অনুমোদন দিতে হবে। মজার বিষয় হচ্ছে অনেক স্থানে ‘না’ বলার কোন সুযোগ ছিল না। সেই নির্বাচনে তিনি নিজের জন্য একটি বিশ্ব রেকর্ডের আয়োজন করেছিলেন যেখানে তাঁকে দেশের অনেক স্থানে ভোটারদের একশত ভাগের বেশি নাকি ‘হাঁ’ বলেছিল। ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দেশে তখন রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা বলবৎ ছিল (চতুর্থ সংশোধনী বলে)
বিচারপতি আবদুস সাত্তার পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে সেনা প্রধান জেনারেল এরশাদ সাত্তারকে হঠিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করে আর এক প্রধান বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে দেশের শাসনভার কব্জা করেন। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বিচারপতি আহসান উদ্দিনকে হঠিয়ে এরশাদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মুখে ডিসেম্বর মাসে এরশাদের পতন হলে তিনি তাঁর উপ-রাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মউদুদের কাছে ঘণ্টা খানেকের জন্য দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। তিনি সকল রাজনৈতিক দল ও তিন জোটের রূপরেখার আলোকে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন নির্বাচন কালীন রাষ্ট্রপতির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন যিনি পরবর্তীকাল নব্বইয়ের জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করেন এবং বিএনপি নির্বাচিত হলে তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত তিনি তাঁর পদে বহাল ছিলেন যদিও এই সময় আর একটি নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছে। তিনি তাঁর সম্পূর্ণ মেয়াদ শেষ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে যথাযথ মর্যাদায় তাঁর দায়িত্ব পালনে সহায়তা করেন।
১৯৯৬ সালের ডিসেম্বের মাসে আবদুর রহমান বিশ্বাস তাঁর মেয়াদ শেষ করলে শেখ হসিনা সকলকে অবাক করে দিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের বাসভবনে গিয়ে তাঁকে অনেক চেষ্টা করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার জন্য রাজি করান। শেখ হাসিনার সেই পদক্ষেপ সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছিল যদিও পরবর্তীকালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন তাঁর পূর্বেও সাহস ও বিচক্ষণতার ছাপ রাখতে ব্যর্থ হন। ২০০১ সালে নির্বাচনে বিএনপি বিজয় লাভ করে সারা দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ বঙ্গে আওয়ামী সমর্থক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর জামায়াত ও বিএনপি’র সমর্থকরা যে ভয়াবহ তা-বলীলা চালিয়েছিল তা বন্ধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান দেশে প্রশাসনিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে তা নিবৃত্ত করকে ব্যর্থ হন। ২০০১ সালে বেগম জিয়া জামায়াতকে সাথে নিয়ে যখন সরকার গঠন করেন তখনো বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের কয়েকমাস মেয়াদ বাকি। তাঁকে অসম্মান করার জন্য তখন বেগম জিয়া ও তাঁর সরকার এমন কোন কাজ নেই যা করে নি। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা সচিবালয় থাকতেও প্রায় সময় মন্ত্রী পরিষদের সভা করতেন রাষ্ট্রপতির কোন অনুমতি ছাড়া বঙ্গভবনে।
বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের মেয়াদ শেষ হলে বিএনপি দলের সিনিয়র সদস্য ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেন। কিন্তু তাকে অত্যন্ত অমর্যাদাকর ভাবে কয়েকমাসের মাথায় অনেকটা এক কাপড়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করতে হয়। তাঁর অপরাধ তিনি জিয়ার মাজার জেয়ারত করতে যান নি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল যে তিনি পদত্যাগ করেও নিস্তার পান নি। তাঁকে বিএনপি’র কর্মীরা রেল লাইনের উপর দিয়ে তাড়া করেছে, তার বাসবভনে আগুন দিয়েছে। এখন সেই বিএনপি নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার কথা বলে।
ডা. বদরুদ্দৌজার পর বেগম জিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ইয়াজুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। তিনি ছিলেন একজন নিরেট ভদ্রলোক, স্বজ্জন ব্যাক্তি। কিন্তু বিএনপি’র পাল্লায় পরে হয়ে যান জি হুজুর। তাঁর সহকর্মীদের অনেকের কাছ হতে জানা যায় তারেক জিয়াও ফোন করলে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে ‘জি স্যার’ ‘জি স্যার’ করতেন। এক এগারোর একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে তাঁর মৃত্যু ঘটে যখন তাঁকে অসাংবিধানিক ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে অনেকটা বাধ্য করা হয়।
যখন এই লেখা ছাপা হবে তখন হয়তো দেশের মানুষ জেনে যাবে কে হচ্ছেন দেশের বাইশতম রাষ্ট্রপতি। আওয়ামী লীগ এই পদের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপর। যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তাদের মধ্যে আছেন একজন সাবেক আমলা ও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা আর আছেন কয়েকজন রাজনীতিবিদ। দলের মধ্যে এই নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে বলে গণমাধ্যম জানিয়েছে। কেউ বলছেন আমলা রাষ্ট্রপতি হলে কি হয় তা অতীতে দেখা গেছে (বিচারপতি সাহাবুদ্দিন)। তারা জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কোন রকমের ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। যদিও রাষ্ট্রপতির পদটি অনেকটা আলঙ্করিক তথাপি সময়ের প্রয়োজনে তিনি সরকার তথা সরকার প্রধানকে নানাভাবে পরামর্শ দিতে পারেন, জাতিকে পখ দেখাতে পারেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এপিজে আবদুল কালাম রাজনীতিবিদ ছিলেন না। অন্যদিকে প্রণব মুখার্জি একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ ছিলেন। দু’জনই অসাধারণ রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আসলে ইচ্ছা, প্রজ্ঞা, ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন ও দৃঢ়তা থাকলে একজন রাষ্ট্রপতি তাঁর শত বাধা বিপত্তির মুখেও তাঁর সক্ষমতা প্রদর্শনে সক্ষম। শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তেমন একটা ভুল করেন না। এই বারও তেমন হবে বলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। যোগ্য ব্যক্তিই বাইশতম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হোক এটাই সকলের প্রত্যাশা ।

লেখক । বিশ্লেষক ও গবেষক