রাফির নানুবাড়ি

হোসাইন আল-নাহিদ :

রাফির বয়স নয় বছর। সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তার নানুবাড়ি গ্রামে।  ছোটবেলা থেকেই সে শহরে থাকে। কোনোদিন গ্রামের বাড়িতে যায়নি। এবার ছুটিতে সে গ্রামের বাড়িতে আসছে।

এর আগে কোনোদিন সে গ্রামের পরিবেশ দেখেনি। এবার ছুটিতে তার  সে চাওয়া পুরণ হলো। গ্রাম আর শহর দুটে যে একদম দিনরাতের মতো আলাদা সে গ্রামে না আসলে জানতেই পারতো না।

এখানে না আছে ট্র্যাফিকজ্যাম, না আছে গাড়ির উচ্চস্বরে হর্নের শব্দ। একদম নিরিবিলি। কোথাও কোনো হইচই নেই। চারদিকে শুধু ছবির মতো সুন্দর সুন্দর দৃশ্য। যেমনটা সে মুভিতে,কার্টুনে দেখেছে।

চারপাশে পাখির ডাক আরো বেশি মনোমুগ্ধকর। সে এর আগে এমন জায়গা কোথাও দেখেনি। দেখবে কি করে! কোনো দিন সে গ্রামীণ পরিবেশে ঘুরতে যায়নি যে! তার তো ঘুরতে যাওয়ার জায়গা চিড়িয়াখানা, জাদুঘর আর বিভিন্ন শহরের উদ্যান। কখনো এমন খোলামেলা জায়গায় আসা হয়নি।

সে নানুর সাথে গ্রামম ঘুরে ঘুরে দেখছে আর অজানা সব জিনিস নিয়ে নানুর সাথে আলোচনা করছে। তার নানুও বেশ রসিক মানুষ। মজার মজার সব উত্তর দিচ্ছে।

রাফির প্রশ্নগুলোও অদ্ভুত অদ্ভুত। এই তো একটু আগে রাস্তায় চলতে গিয়ে দেখতে পায় রাস্তার পাশে একটা লোক দুটি গরু দিয়ে কি যেন করছে। সেটা দেখে রাফি নানুকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা নানু,  লোকটি গরু দুটি নিয়ে কি করছে? বারবার একই জায়গা দিয়ে ঘুরছে কেন? এটা কি  কোনো খেলা?

নানি হাসি দিয়ে উত্তর দেয়, নানু ভাই লোকটা এখানে জমি চাষ  করছে। ফসল বুনবে। সেজন্য জমি চাষ করছে। ফসল বোনার আগে এভাবেই মাটি আলগা করতে হয়। এভাবেই চাষ করে বীজ মাটির নিচে দিতে হয়, না হলে সব ফসল বীজ শুকিয়ে যাবে, পাখিরা খেয়ে ফেলবে।

এই কৃষকরা কষ্টের খেলা করে বলেই তুমি-আমি এত সুন্দরভাবে দিন কাটাচ্ছি। তারাই এদেশের প্রকৃত সোনার মানুষ।

এরপর কিছুদূর যেতেই দেখে একদল লোক তাঁবু টানিয়ে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে আছে। একেকজন এক-একদিকে ব্যস্ত। কেউবা মাথায় কি যেন নিয়ে গ্রামের পথে চলে যাচ্ছে। কেউবা আবার ভিড় করে কি যেন গান-বাজনা করছে। এসব দেখে নানুকে প্রশ্ন করে সে, নানু ঐ লোকগুলো কারা? কি করছে ওখানে?

নানু উত্তর দেয়, নানুভাই,  ওরা হলো বেদের দল। তাদেরকে অনেকে যাযাবর বলে। ওদের নিজস্ব কোনো জায়গা-জমি নেই। ঘরবাড়ি নেই। আজকে এখানে, অন্যদিন অন্য জায়গায় তারা ঘুরে বেড়ায়। ঐ যে মহিলাগুলো মাথায় ঝুড়ি নিয়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছে, ওগুলোতে থালা-বাসন,  কাচের চুড়ি, বিভিন্ন খেলনার জিনিস। ওরা ফেরি করতে যাচ্ছে। আর ঐ যে দেখছ, পুরুষগুলো গান-বাজনা করছে। ওখানে তারা সাপের খেলা দেখাচ্ছে এবং বিভিন্ন গাছগাছালির শেকড়-বাকড় থেকে  তৈরি ঔষুধ বিক্রি করছে। কেউবা আবার সার্কাস দেখিয়ে টাকা তুলছে। ওদের জীবনচক্রই এ রকমই। চলো, আজকে তোমাকে ওদের সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবো।

রাফি এবং নানু দুজনই তাদের সাথে অনেক সময় আড্ডা দেয়, অনেক গল্প করে। রাফি নতুন নতুন অনেক কিছু জানতে পারে সেখান থেকে।

সাপের খেলা, বাঁদর খেলা দেখে অনেক মজা পায় সে। রাফির এগুলো এর আগে কখনোই দেখে নাই।

বেশ কিছু সময় এখানে পার করে আবার গ্রামের পথে হাঁটতে শুরু করে ওরা। আরেকটু সামনে যেতেই নদীতে কিছু মানুষ দেখে আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা নানু, ঐ যে লোকগুলো পানিতে কি যেন টেনে আনছে। ওগুলো কি? ওখানে ছোট বাচ্চাও আছে। তারা কি আমার মতো পানিতে খেলা করছে?

নানু আবার বলে, নানুভাই, ওদেরকে আমরা জেলে বলি। ওরা ওখানে জাল টানছে, জাল টেনে মাছ ধরছে। তুমি-আমি সেই মাছগুলো বাজার  তেকে কিনে এনে মজা করে খাই।

আর ঐ যে ছোট ছোট ছেলেগুলো দেখছো, ওরা জেলেদের ছেলেমেয়ে। তাদের ঘরবাড়ি ঐ নৌকাতেই। ওখানেই ওরা থাকে। তোমার মতো তাদের জীবন না। তারা প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে জীবিকা অর্জন করে।

চলো, তাদের কাছ থেকে আমরা মাছ নেব!

তারপর রাফি ও তার নানু জেলেদের কাছে গিয়ে বড় বড় মাছগুলো নিয়ে আসে। বাসায় এসে সেগুলো রান্না করে রাফির সামনে দেয়। রাফি মজা করে খায়।

রাফির মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছে সব। এ রকম সারাসরি নদী থেকে মাছ এনে খাচ্ছে। সবজি, ফলমূল সব তরতাজা।

রাফি সব সময় শুনেছে শহরে যে ফলমূল, মাছমাংস, শাকসবজি পাওয়া যায়, সবকিছুতেই কীটনাশক দেওয়া থাকে। কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় এগুলো করে। কিন্তু গ্রামে এ রকম কোনো ভয় নাই। সব নিজেদের জমিতেই পাওয়া যায়, একদম টাটকা।

রাফি আরো খেয়াল করেছে, গ্রামের রাস্তাঘাটগুলো একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনা নাই। অথচ রাফি যে শহরে থাকে তার পুরো রাস্তা ময়লায় ভরা। ডাস্টবিন থাকার পরও লোকজন  যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাস্তা নষ্ট করে। কিছু কিছু জায়গায় এমন দুর্গন্ধ যে তার আশপাশ দিয়ে হাঁটাচলা করাই যায় না।

সেদিক থেকে গ্রামের পরিবেশ অনেক সুন্দর! রাফি যতদিন গ্রামে ছিল, সব সে খাতায় নোট করে রাখে এবং ছবি তুলে রাখে। শহরে এসে তার বন্ধুদের সব দেখাবে।

এভাবেই গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতেই কখন যে ছুটি শেষ হয়ে এলো  টেরই পায়নি। এখন বিদায় নেওয়ার পালা। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার সেই শহরে ফেরার পালা। সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারলেও তার নানু এবং গ্রামের কাছ থেকে রাফি বিদায় নিতে পারেনি।

সে বাবা-মায়ের কাছে আবদার করে প্রতিবছর যেন তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়। আর পরের বার আসলে তার বন্ধুবান্ধব সবাইকে নিয়ে আসবে।

এই বলে বিদায় নিয়ে আবার সেই শহরে চলে আসে রাফি।