যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে

রবীন্দ্রসাধক সাদী মহম্মদ। শোক ও শ্রদ্ধা

মোহীত উল আলম »

সাদী ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল টুকটাক কিন্তু পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ। তাঁর রবীন্দ্র সংগীত গায়কীর ভক্ত ছিলাম আমি। খুব নিখুঁত সুরে চমৎকার দরদভরা গলায় গাইতেন। তাঁর সম্পর্কে প্রথম সজাগ হই ২০১১-১২ সালে যখন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক আমার আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু দেলোয়ার হোসনের ওপর দায়িত্ব পড়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা: ১৯৭১’ বাংলা ও ইংরেজি দুটো খন্ড সম্পাদনার দায়িত্ব। কাজ করতে গিয়ে কিছু স্মৃতিমূলক রচনায় মোহাম্মদপুরে অবাঙালীদের নৃশংস কর্মকান্ডের বিবরণের মধ্যে পেলাম সাদী মহম্মদের বাসভবনে অবাঙালীদের আক্রমণের বিভীষিকাময় বর্ণনাটি। একটা রচনায় পেলাম এরকম যে সাদী ভাইয়ের চোখের সামনে তাঁর বাবাকে আক্রমণকারীরা বাসার বাথরুমের মুখে পিঠে ছুরি মেরে হত্যা করে। দিনটি ছিল ২৬ মার্চ ১৯৭১!

এ ব্যাপারটা সবসময় আমি তাঁর গান শুনলেই মনে পড়ত। তাঁর সঙ্গে চাক্ষুষ যোগাযোগ হয় আমি যখন কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলাম, তখন সংগীত বিভাগের বিভিন্ন শিক্ষক পেলাম যারা তাঁর সরাসরি ছাত্র-ছাত্রী এবং একান্ত ভক্ত ছিল। এদের অনেকেই খুব ভালো গাইতো বলে ওদেরকে আমি পছন্দ করতে শুরু করি। এদের মধ্য দিয়ে সাদী ভাইয়ের সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ হয়। এত ভদ্র, নির্বিরোধী ও বাকসংযমী লোক ছিলেন তিনি যে আমি ঐ টুকটাক দেখার মধ্যেই তাঁকে খুব পছন্দ করতে থাকলাম। একদিন টেলিফোন পেলাম তাঁর। সামান্য একটা অনুরোধ! অনুরাধা (প্রকৃত নাম নয়) নামক মেয়েটি খুব ভালো গায়, ফলাফলও ভালো, ওকে বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নেওয়া যায় কিনা একটু যেন দেখি। আগেও কয়েকবার সে ইন্টারভিউ দিয়েছিল হয় নি। নিয়োগ পরীক্ষার সবগুলো ধাপে মেয়েটি খুব ভালো করলো, নিয়োগও পেল। আমি সাদী ভাইকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম যে তিনি ভালো একজন প্রার্থীর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এখানে এটা বলা আবশ্যক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি হলো তদ্বিরের চাপ সামলানো।

আমি কয়েকদিন আগে রবীন্দ্রনাথের “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে” গানটি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। এ গানটি নিয়ে একটি অপপ্রচার আছে। এটা নাকি রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জর্জের ভারতে আগমণ উপলক্ষে তাঁকে সম্মান জানানোর জন্য লিখেছিলেন। সে জন্যই কিনা জানি না, রবীন্দ্রনাথের এই গানটির কথা আগে আমি তেমন গা করি নি। কিন্তু সেদিন নিরালায় গানটি শুনতে শুনতে চমৎকার কথাগুলি পেলাম যে কবি বলছেন সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁকে আপন কোন কাজের গরিমা থেকে মুক্তি দেন। অহংকার সম্পূর্ণ মোচিত হয়ে যেন যায়। বিধাতা যেন তাঁকে আড়াল করে তাঁর হৃদয়পদ্ম ভরে দেয়। নিজেকে গৌরবদান করতে গিয়ে আমরা নিজেদেরকেই অপমানিত করি। এইতো গেল গানটির মুখ্য কথা যে অহংকার পতনের মূল। কিন্তু আরও একটি মেসেজ আছে গানটিতে যেটির সঙ্গে সাদী ভাইয়ের চলে যাওয়ার ধরনটার সঙ্গে আমি মিল খুঁজে পাই না। সেটি হলো, রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতিতে একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি সবচেয়ে জোরালোভাবে ঈশ্বরের সত্তার মধ্যে ব্যক্তিমানুষের সত্তার মিলিয়ে দেওয়া বা বিসর্জন দেওয়াকে শ্রেষ্ঠ ব্রত বলে বিশ্বাস করতেন। সাথে যে কথাটি তিনি উক্ত করেন নি উহ্য রেখেছেন সেটি আধুনিক যুগের মানুষের জন্য একটি অষুধের মতো। সেটি হলো সব জীবনযন্ত্রণার ভার তুমি নিজে নেবে না, সৃষ্টিকর্তার কাছে ছেড়ে দাও। তুমি নিজে সর্বত্র নিজের এজেন্ট হয়ো না, কারণ এ জীবনে কোন কিছু তোমার নিয়ন্ত্রণে নেই। কিছুটা কর, কিন্তু বাকিটা ছেড়ে দাও ভাগ্যের হাতে তথা সৃষ্টিকর্তার ওপর।

আমার কথা হলো, রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত আশাবাদী ঈশ্বরবাদী লোক ছিলেন, তাঁর পুরো রচনা এবং গানে নিমজ্জিত হলে তাঁকে জীবনের বয়া হিসেবে না দেখে উপায় নেই।

তা হলে সাদী ভাই রবীন্দ্রনাথের এই শান্তির জায়গাটা সম্যক আমলে কি নিলেন না, এই প্রশ্নটা রয়েই গেল।

তবে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি ভাষার কবিতা থেকে যতগুলো বাংলায় অনুবাদ আছে, তার মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে আছে ডব্লিও এইচ অডেনের কবিতা “রিচার্ড কোরি” র অনুবাদ। কবিতাটির বিষয়বস্তু হলো এরকম: রিচার্ড কোরি তাঁর শহরের মধ্যে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন, কেন না, তিনি ঠিকমতো কর দিতেন, ঠিক সময়ে অফিসে যেতেন, অর্থাৎ তাঁর সবকিছু ছিল ঠিকঠাক। কিন্তু একদিন সকালে তাঁকে পাওয়া গেল তাঁর ফ্ল্যাটে মৃত, তিনি নিজেই মাথায় পিস্তলের গুলী চালিয়ে তাঁর জীবন শেষ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই তাঁর জীবনদর্শনের সঙ্গে মেলে না বলেই এই কবিতাটিকে অনুবাদের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। আর সাদী ভাইও তাঁর জীবনের সঙ্গে মেলে না এই রকম একটি মৃত্যুপথের প্রতি আকর্ষিত হলেন!

তাঁর ৯৬ বছর বয়স্কা মায়ের মৃত্যুতে তিনি ডিপ্রশনে ভুগছিলেন এরকম একটা কথা তাঁর পরিবার থেকে জানানো হয়েছে।

কিছুই করার নেই, মানুষের চরিত্রের নিগূঢ় চিন্তাগুলো আমরা কোনদিন জানতে পারব না, শুধু জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হয়, “তবু সে দেখিল কোন ভূত, ঘুম কেন ভেঙ্গে গেল তার!”

জীবনানন্দ দাশের এই ‘তবু’টাই মানবচরিত্রের সকলকিছুর নিয়ামক।

সাদী ভাইয়ের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি।