ময়ুখ চৌধুরী : শব্দের নিখুঁত কারিগর

মোস্তফা হায়দার »

কবিতা একটি উচ্চমার্গীয় শিল্পকাঠামোর নাম। যে শিল্পের আয়নায় বসতে জানার মাঝে আরেক শিল্পের উদয় হয়। সে উদয়ের বাসনখানি যখন নিয়ত শিল্পের ব্যবহার চর্চা করে তখনই কবিতা নামক শিল্পের বাহাদুরিতে শিল্পী দাঁড়িয়ে থাকেন কবিতার কাঁধে। কবিতার একটা গুঞ্জরণ আছে। যেখানে কবিতা হেসে ওঠে ভেতরের লুকানো একমুঠো বাতাসার মোহমুগ্ধতা নিয়ে। সেই কবিতাশিল্পের এক ব্যতিক্রমী কারিগর হলেন কবি ময়ুখ চৌধুরী। কবিতাকে তিনি আপনার মতো করে সাজাতে বসেছেন বিমুগ্ধ পাঠকের প্লেটে। রূপের ভেলায় ভাসাতে জানলে শব্দেরাই গীত ধরে কবিকে বাঁচিয়ে রাখে।
কবি ময়ুখ চৌধুরী শব্দের এক নিখুঁত কারিগর। মনে পড়ে কবি আল মাহমুদের উক্তি : ‘পাখির নীড়ের সাথে নারীর চোখের সাদৃশ্য আনতে যে সাহসের দরকার, সেটাই কবিত্ব।’ বাবুইপাখির বাসা বানানো দেখলে কবিতাবুননের শিল্পকলা আত্মস্থ করা সহজ না হলেও ধারণার উদয় নিশ্চিত।
কবিতাকে আপন শার্টের মতো ম্যাচিং করে নিতে জানা এক কবি তিনি। তাঁর কবিতায় ওজনের চেয়ে বোধের জায়গা অনেক ব্যাপৃত। ‘বর্ষা নিজেই কবি, কাব্য লেখে জলের অক্ষরে’ÑÑ যেন অসাধারণ এক ঘোড়ার ক্ষুরের ধার চোখে পড়ে। কবিতা তো এখানেই। পাঠক থমকে দাঁড়ায়। বর্ষা নিয়ে এমন গভীর বাক্য হয়তো চোখে পড়বে না। কবির ভাবনার অন্তঃপুর অনেকদূর। কবিরা সব সময় শিল্পের কাছে আশ্রয় খোঁজেন। আর কবি ময়ুখ চৌধুরী নিখুঁত শিল্পের চর্চা করতে বড় ভালোবাসেন। পাঠক নিয়ে মজা করেন বোধের দরজায় কড়া নাড়িয়ে।
কবির দায় মানুষের বহির্চেতনায় নাড়া দিয়ে বোধের উদয় ঘটানো। আয়নাবিষয়ক একটি কবিতায় কত গভীরে প্রবেশের ঈঙ্গিত দিয়েছেন নিপুণভাবে। কবিতাকে এভাবে যাপিতাংশের মতো করে সহজিয়াশিল্পে রূপ দিয়ে কবির পরিচয়ও দিলেন।
কবির ভাষায় :
ঐ রাক্ষসটা গতকাল দুপুরে একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে।
দুই আর তিন মিলিয়ে মোটে পাঁচ পেগ।
তারপর শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট যাবতীয় সজ্জিত আহার
এমনকি জিন্স প্যান্ট, বেল্টের কঠিন ইস্পাত, ঘোড়ার নিশ্বাস।
(বলছিলাম আয়নাটার কথা, ক্যাঙ্গারুর বুকপকেটে)।
জীবনের পরিশুদ্ধতা খুঁজতে হলে আয়নার সামনে যেতে হবে। যেতে হবে ম্যাচিংশিল্পের ভেতর। যেমনটি আত্মসমালোচনার পরিপূরক অংশও বটে। ইহকাল আর পরকালের এই বিশাল মাঠে আত্মসমালোচনা অথবা আয়নার সামনে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কবি এভাবে বোধের চিন্তাপুরে হাঁটিয়ে আনছেন পাঠককে। গাড়ি ধরতেই হবে। ধরতে জানা গাড়ির মাঝে লুকিয়ে আছে বাঁচতে জানা তরীর গল্প। যে গল্প ভাসতে ভাসতে দিগন্তরেখা ছুঁতে স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্নের বিচ্ছুরণ ঘটাতে চায় আলো-আঁধারির ধোঁয়াশাচ্ছন্ন মাঠে। মাঠের পরিচয় চিনে নিতেই তবে কবিতার আশ্রয়। কবির ভাষায় :
রেখে যাচ্ছি মোমবাতি, মেরুদ-ে শাদা অন্ধকার
যেনো প্রত্যাশার চেয়ে অতিরিক্ত আলো পেতে পারো
(যেতে যেতে রেখে যাচ্ছি, ক্যাঙ্গারুর বুকপকেটে)।
কবি দায় নিয়ে সূর্যোদয়ময় সময়ের প্রত্যাশা রাখেন মনুষ্যসমাজের। সমাজের মুক্তির মাঝে মানবতার মুক্তি ভর করবে। আলোর নিচে আলোরই ছায়া পড়বে। জাগতিক শিল্পের কাছে আলোরা দ্যুতি ছড়াবে। অসংখ্য স্থানের স্থানিক স্খলন ভেতরের কামিজ খোলার মতো সময়ের অযাচিত বিষয় এসে কবির জোড়পায়ে দাঁড়ায়। কবি তখন শিল্পের কাছে মুক্তির দ্যুতি খোঁজেন। যেমন :
পড়ে থাকে ফুটপাতে রাতের ক্ষুধায়
নিহত বিশ্বাসটুকু কুয়াশার কাফনে জড়ানো
এই তো শীতের গল্প, ঋতুচক্র, দেনা আর দায়
আহত পাখির মতো ইতিহাস অন্ধকারে যায়
(শীতগল্প, ক্যাঙ্গারুর বুকপকেটে)
ইতিহাস খুঁড়ে খুঁড়ে হাঁটলেও মানুষের মাঝে জাগ্রত এক সময় কথা বলে যায়। জবাবদিহিতার করতলে। যেখানে দাঁড়াতেই হয়। কবিরা সময় আর ইতিহাসকে মুখোমুখি করতে পছন্দ করেন। এখানেই কবি ও কবিতার শক্তিময়তা। কবি ময়ুখ চৌধুরী তাঁর প্রায় বইয়ের কোনো না কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে টানতে চেয়েছেন। এটাই কবির দায়। কবি তাঁর ‘স্মৃতি ও স্বপ্নের বাংলাদেশ’ কবিতায় ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সময়টুকু মাত্র ২৬ লাইনে এত চমৎকারভাবে টেনেছেন তা যেন এক নতুন সমীকরণের জন্ম দেয়। যেমন :
১৭৫৭
লোহার বাসরঘরে ঢুকেছে মনসা বৃটেনের,
এবার নীলের চাষ, বাজে গান শুধু মরণের।
১৯৫২
আমারই বুলেট এসে ছবি আঁকে আমাদেরই বুকে
আমার মায়ের বুলি কেঁদে মরে আমাদেরই মুখে।
আর কোনো গান নয়, শুনি শুধু বুটের আওয়াজ
জোনাকীরা পাড়াজুড়ে কারফিউ, আততায়ী সাজ।
১৯৭১
সবুজের মাঝখানে লাল হৃৎপি- জ্বলে ওঠে,
এবার ফুটবে হাসি মাটিমাখা মানুষের ঠোঁটে।
১৯৭৫
কেনো আগাছার ভীড়ে বিষধর সাপের ভেতর
বেড়ে উঠেছিলে তুমি, গড়েছিলে স্বপ্নের কবর।
(স্মৃতি ও স্বপ্নের বাংলাদেশ- কালোবরফের প্রতিবেশী)
এই লাইনগুলো পাঠ করলে মনে হয় যেন কবি ইতিহাসকে উসকে দিয়ে, সম্মুখে আয়নার মতো করে হাজির করছেন। চেতনার জাগ্রতসত্তাকে সঠিক জায়গায় ব্যবহার হতে না দেখে কবি আবার ফিরে যেতে চান অজানার কাছে। যে অজানাতে প্রকাশ করেছেন ভেতরের সুন্দরের ক্ষোভ আর লীলাবতীর মূর্ছনায়। কবির ভাষায় :
মুক্তিযুদ্ধ ফিরে এসো, আর একবার মুক্তিযুদ্ধ করো;
পরিকীর্ণ আকুল বিশ্বাসে
পরিপূর্ণ মুক্তির নিশ্বাসে
মুক্তবাজারের মতো কালো থাবা থেকে তুমি করো উদ্ধার
ঘামের শিশিরে ভেজা উজ্জ্বল ভাঁড়ার।
(চলো যাই, মুক্তিযুদ্ধ- আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে)
অন্যত্র বলেন :
গণতন্ত্র মুক্তি পাবে বলে
সভ্যতার কৃত্রিম পোশাক ছুঁড়ে ফেলে
বুক পেতে দিয়েছিলে ক্ষুধাতুর জলপাইরঙের সম্মুখে;
কঠিন দাঁড়িয়েছিলো স্বৈরাচারী চারপায়া ভ্যান
সংসদে যাবে না নূর হোসেন?
(নূর হোসেন, সংসদে যাবে না? -আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে)
যে গণতন্ত্রের জন্য লাল-সবুজের পতাকার উদয়, সেখানে আজ গণতন্ত্রহীন আঁধারের গর্তের কথাই মনে করিয়ে দিলেন মযুখ চোধুরী। সম্ভবত কবিরা শেকড়ে চোখ রাখতে পছন্দ করেন। দেশীয় অনাচারগুলো সব দেশে দেশে হয়ে আসছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণে-অকারণে অনাচারগুলো ইতিহাসের কাছে হাত পাতে। বহু দেশেই এমনটাই ঘটেছে। যা হয়ে যায় কলঙ্কের দায়! যা হয়ে যায় দায়মুক্তির সংকেত। তখন কবিরা সেই দায় আর কলঙ্কের পিঠে চড়ে সময়কে তুলে ধরেন সম্মুখে প্রজন্মের দায় এড়ানো বা মুক্তির অন্য কোনো পথ খুঁজে নিতে ইশারা ছুড়ে। সে রকম কলঙ্কের এক ইতিহাস নিয়ে কবির অবতারণা ঠিক এভাবে :
কোন অপরাধে বলো, সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিল লাল নদী?
কোন অপরাধে বলো, রাতের আকাশে আজও
নক্ষত্রের ভেজা চোখ জ্বলজ্বল করে?
(অপরাধ-১৯৭৫, চরণেরা হেঁটে যায় মু-ুহীন)
ভাবনার এক অন্তঃপুরে হারিয়ে যায় আস্থা ও বিশ্বাসের থলি। বিশ্বাসভঙ্গ আর বিশ্বাসের রঙ্গ এক হয়ে থাকতে চাইলেও পারে না। সময় তা উম্মোচন করে। কবি তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ধরেন ঘটনার আপাদমস্তক। শিল্পের ভাষা বোঝার ক্ষমতাই পাঠকের হয় দায়। পাঠকমাত্রই হতে হয় কবিতার চিন্তক, হতে হয় কবিতার রন্ধনশালার উনুন। ঠিক কবির রেখে দেয়া শেষ চরণগুলো কিসের ইঙ্গিত যেন দেয় :
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা নদী
আজও সে জানতে চায়–
কৃষক-শ্রমিক বুঝি অপরাধ-বিজ্ঞানের ভাষা!
(অপরাধ-১৯৭৫, চরণেরা হেঁটে যায় মু-ুহীন)

এমন অনেক নির্মমতাকে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন কবি ময়ুখ চৌধুরী। অল্পকথায় অনেক গল্প বা ইতিহাসকথার ইঙ্গিত দিতে কোনো ধরনের ভণিতার আশ্রয় নেননি। শিল্পের সঠিক সুষমায় প্রকাশ করেছেন ভেতরের জাগ্রত ইচ্ছেটুকু। কবির ভাষায় :
বুকের জমিন বিষ হয়েছে শব্দপোকার বিষে
অতীতপাখি ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে!
(শব্দের রানি এবং প্রজা, অর্ধেক রয়েছি জালে অর্ধেক জলে)
অথবা –
দুধকলাতে পুষেছিলাম মা মনসার বিষ,
ও দেবী তোর সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।
(ঈশ্বরী পাটনীর বংশধর, ওই)
দেনা আর দায় মাথার মগজে রাখতে পারে না বলে ইতিহস অন্ধকার খোঁজে। ঋতুচক্রের এই সীমানায় মানুষের বোধের জায়গায় পচন ধরে বলে মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। কবির উপসর্গ কবিতায় ওঠে এসেছে :
তোমার প্রতিটি জোড়া খুলে যাচ্ছে, সেলাই দরকার
সুঁইসুতো খুঁজে নাও, অহমিকা জাহান্নামে যাক
কাকে কষ্ট দিতে গিয়ে নিজেকে ছিঁড়েছ বারবার!

সময়ের চিত্রই যেন রাজনৈতিক মাঠে নিয়ে বোধের পরিমাপ দেখাচ্ছে! এক পেয়ালা অহমিকায় চড়ে নিজের মাটিকে বারবার খুঁড়ে খুঁড়ে দেখে চলেছে যারা, ঠিক তাদেরই দিকে কবিতার ইঙ্গিত। ভেতর সত্তার বিস্ময় জাগানিয়া এক বচনও বটে। ঠিক এ রকম আরেকটি কবিতায় কবি বলছেন :
দুধভাতে উড়ে আসে কাক
সোনামণি প্রাণে বেঁচে যাক
ফিরে আয় ঘরে ফিরে আয়
পৃথিবীও থমকে যায় রাজার বাড়ির দরজায়।
(অন্নদামঙ্গলধারা, ক্যাঙ্গারুর বুকপকেটে)
‘নামের কথা বলো না ক, নাম দিয়ে কী হয়?/ নামের মাঝে লুকিয়ে আছে আসল পরিচয়‘। ÑÑ হঠাৎ এ গানটির কথা মনে পড়ে গেল। কবি ময়ুখ চৌধুরীর কবিতাগুলোর রচনা-সময় দেখে বুঝা যায়, স্ফুলিঙ্গের মতো আগুন ছুড়ছে সময়ের দিকে, মানুষের দিকে, মানবতার দিকে।