মাটির মায়া

প্রণব মজুমদার :

ভাই! এই ভাই! আমার কামডা কইরা দ্যান। আইজ কয়দিন ধইরা আইতাছি।

দাঁড়ান দাঁড়ান! কাস্টামাররে পুরি দিয়া লই! এই লন চাচী, একটা গরম পুরি খান! তপ্ত লোহার কড়াই থেকে নেয়া ধোঁয়া তোলা ফোলা ফোলা ডা পুরি! দেখলে  যে কারো জিহ্বায় জল এসে যায়!

বসন্তের মৃদু বাতাসের সন্ধ্যায় বেইলি রোডের মোড়। পথচারী পারাপারের এই ফুটপাতে ক্রেতা-বিক্রেতার বেশ ব্যস্ততা। ভারি কাগজে দোকানি ভবেশ একটি পুরি এগিয়ে দেয় বৃদ্ধাকে! তালি দেয়া ও ছেঁড়া শাড়ির আঁচল বের করেন তিনি। পুঁটলি থেকে ভাঁজ করা টাকা বের করে বৃদ্ধা বলেন

কয় ট্যাকা দিমু?

টাকা লাগতো না!

তাইলে খামু না?

আচ্ছা দুই ট্যাকা দেন। দেড়শ ফিটের একটি দোকান! ভিড় লেগেই থাকে। পরোটা, ডাল, ভাজি, হালুয়া, পুরি, সিংগারা, চপ ও জিলিপি ইত্যাদি  দোকানটার দৈনিক আয়োজন। ভিড় লেগেই থাকে। দোকানে মাত্র দু’জন কাজ করে। ভবেশ ও রমজান। রমজান ভেতরটা সামলায়। দোকানমালিক ভবেশ চন্দ্র দাস। বৃদ্ধাকে বললেন

মেয়ের নাম বলুন?

আয়েশা বেগম

মোবাইল নম্বর

জিরো ওয়ান নাইন …

দোকানটার পাশেই গোয়েন্দা কার্যালয়ের একটি শাখা। সেখানকার কর্মকর্তা ওমর ফারুক ভবেশের নিয়মিত কাস্টমার। দোকানের ভেতর স্টিলের চেয়ারে বসা তিনি। ওয়ারলেস সেটটা নাকের কাছে রেখে তেঁতুল সস দিয়ে গরম পুরি খাচ্ছিলেন। দূর থেকে ভবেশ ও বৃদ্ধার আলাপও শুনেছেন! অনুসন্ধিসু ফারুকের বিস্ময়ের চাউনি। বেশ স্পষ্ট ও শুদ্ধভাবে ইংরেজিতে মহিলা সেলফোনের সংখ্যা উচ্চারণ করছেন। বুদ্ধিদীপ্ত কর্মকর্তা ফারুকের মনে হলো বৃদ্ধা মোটেও সাধারণ নন।

ভবেশের কাছে জানতে চাইলেন বৃদ্ধা বৃত্তান্ত।

স্যার চাচী দোকানে কয়দিন ধইরা আসে। ভোটার কাড দেহায়। ভিক্ষুকও কওন যায় না। নিজ থিকা চায় না। কেউ কিছু দিলে মন চাইলে নেয়। আবার  নেয় না। থাহে শান্তিনগর বাজারের ভেতর। কখনো কখনো আমার দোকানের সামনেও ঘুমায়ে থায়ে। চাচীর শরীরডা বালা না। কইলো মইরা গেলে শরীয়তপুর পালংয়ের আটিপাড়া বাড়িতে ছোটমাইয়ার কাছে যেন পোন কইরা জানাই।

বিল পরিশোধ করে ফারুক মহিলার কাছে এগিয়ে যান। কৌতূহলী হয়ে ওঠেন তিনি। জানতে চান নেপথ্য ঘটনা।

চাচী আপনার কী সমস্যা আমারে বলতে পারেন?

বৃদ্ধার চোখেমুখে আনন্দ অশ্রু। একটা ছোট সবুজ রংয়ের পোস্টারের টুকরো কাগজে লেখা ফোন নম্বর। তাতে লেখা আয়েশা ০১৯ …। কাগজটা ও জাতীয় পরিচয় পত্রের কার্ড এগিয়ে দেন বৃদ্ধা। কার্ডে লেখা নাম : সফুরা বেগম পিতা – রমিজ মিয়া, মাতা -সেতারা বানু , ডেট অব বার্থ – ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯

আইডি নম্বর ৫১ …। বামে অস্পট ছবির নিচে স্পষ্ট স্বাক্ষর  স ফু রা।

এটা কী আপনার লেখা নাম

জী স্যার, আমার সিগনেচার।

কই থাকেন?

শান্তিনগর বাজার বা বেইলি রোড।

দেশের বাড়ি?

শরিয়তপুর আটিপাড়া

কে কে আছে সেখানে?

কেউই নাই

কেউ নাই মানে? ভবেশকে যে বললেন মেয়েরে ফোন দিতে?

হ কইছি মরলে পর ছোড মাইয়ারে খবর দিতে।

তিন পোলা, দুই মাইয়া। ছোড মাইয়া জন্মের পর স্বামী মইরা গেল হাঁপানিতে। জমিজিরাত ছিল। এহনঅ আছে। স্বামী ছিল কাঠমিস্ত্রি। হেয় পড়ালেহা জানতো। নিজে এট্টু পরছিলাম। স্বামীর মরণের পর পোলাগরে লেহাপরা করাইছিলাম। মাইয়া দুইডা সামান্য পরছে। পোলারা বড় অইছে। সংসারী অইছে। রত ছিল যহন তিন পোলার বউয়ের কাছে দাম ছিল। কাম করতে পারতাম। খাওন পাইতাম। শেষে কাম করতে পারতাম না। দাম কইমা গেল। প্রতিদিনই বউরা বকাঝকা করতো। হাতও তুলতো। পোলারা কিছু কইতো না। মনের দুকখে বাড়ির থিকা চইলা আইছি ঢাহায়, লনচে কইরা। কত ঘুরলাম। কেউ কাম দেয় না। শরীরডা বালা না। কোন দিন মইরা যাই ঠিক নাই। দেশে ভিডামাটির পাশে স্বামী শুইয়া আছে। মরার পর হের লগেই থাকতে চাই।

সফুরার জীবনের গল্প শুনে অনেক কথা মনে পড়ে যায় গোয়েন্দা কর্মকর্তা ওমর ফারুকের। দুই ভাই ও এক বোনের পরিবারে ফারুক মেঝো। পিতা বেঁচে  নেই। পিতা একমাত্র বোনকে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে যান। একান্নবর্তী পরিবার ছিল ফারুকদের। কিন্তু ভাবি আসার পর সংসার পৃথক হয়ে যায়। বিধবা মাকে ছেড়ে বড়ভাই ভাবির কথা অনুযায়ী অন্যত্র চলে যায়। গ্রামের বাপের ভিটেমাটিতে মা একা থাকেন। সরকারি চাকরিসূত্রে বিবাহিত ফারুকের ঢাকায় বসবাস। নিজের পরিবারের সঙ্গে সুফরার জীবনের ক’টি বিষয়ে মিল খুঁজে পান ফারুক। তাহলো সম্পর্কের খুনসুটি। বউ ও শ^াশুড়ির দ্বন্দ্ব। ফারুক নিজের কাছে প্রশ্ন রাখেন। সংসারে কেন এক মেয়ে আরেক মেয়েকে সহ্য করতে পারে না বিয়ের পর? বৃদ্ধারও তো সব ছিল একদিন। তার মায়েরও তো এমন হতে পারে। এসব ভাবনায় আনমনা হয়ে যান ফারুক। ভাবনার শেষে স্বাভাবিক হয়ে সুফরাকে খুঁজতে থাকেন। বয়স্ক মহিলার বাকি জীবনের ঠিকানা করে দেবেন এমন পরিকল্পনাও মনে মনে আঁটেন। কিন্তু বৃদ্ধা ততক্ষণে ট্রাফিক জ্যামের ভিড়ে হারিয়ে যায়। দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ওমর ফারুক তার অফিসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।