অদৃশ্য প্রেম

জসিম উদ্দিন মনছুরী :

সেদিন রাতে ভুল ডিজিটে কল চলে যায় অন্যজনের কাছে। ভাগ্য ভালো রিসিভ হয়নি। আমি আর দ্বিতীয়বার কল দিইনি। ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ঘুম ভাঙে ফোনকলের সৌজন্যে। আননোন নাম্বার; যে নাম্বারে আমি গত রাতে ভুলে ফোন দিয়েছিলাম। রিসিভ করে হ্যালো বলতেই জবাব আসে- আমি। ভাইয়ার ওখান থেকে করছেন নাকি?

না তো, কোন ভাইয়া!

উকিল ভাইয়া।

না, আসলে স্যরি। মনে হয় রং নাম্বার।

তাহলে কালরাতে যে এই নাম্বার থেকে কল এসেছিল?

না মানে, ভুল ডিজিটে আপনার কাছে চলে গেছে!

আসলে হয়েছে কি, আমার ভাইয়ের বাইপাস হার্ট সার্জারি, তাই কিনা ওখান থেকে কোনো খবর…।

স্যরি, ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করবেন।

না, না, স্যরি বলার কি আছে, ভুল তো হতেই পারে।

ফোনালাপে মনে হলো তিনি একজন সুশিক্ষিত ভদ্রমহিলা। ভাইয়ের জন্য দোয়া চেয়ে সেদিনের মতো ফোন রেখে দিলেন। আমি কিন্তু তাকে মনে রেখে দিলাম। আমি না আসলে, আমার মনটাই তাকে মনে রাখতে ইন্ধন যুগিয়েছে। কারণ এই ক’মিনিটের কথাবার্তায় আমি তার মায়াজালে আটকে গেছি! কণ্ঠস্বরে কি এক মায়া যেন ছোট-ছোট বাক্যে ব্যক্তিত্বপূর্ণ কথামালা। এসবকে আসলে অদৃশ্য এক অনুভবের স্নিগ্ধ শিহরণ বললে ভুল হয় না। এ ধরনের আচমকা ফোনকল এবং সরব কথাবার্তার রেশ ঠিক আলোও না আবার আলেয়াও না। এক প্রকারের ধূম্রজাল বলা যায়। তার ব্যাপারে আমার আগ্রহ প্রকট হচ্ছে সারাদিনমান। নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্য দিয়ে কেটে যায় তিন-চারটে দিন। কেউ কাউকে ফোন দিই না। আমিও না, উনিও না। এ ক’দিন আমি এক ধরনের অস্থিরতায় ভুগছিলাম। একটা ফোনকলই যেন আমার এ রোগের একমাত্র দাওয়াই। একদিন সেই ভুল ডিজিটের নাম্বার থেকে মায়াবী সুরের ব্যঞ্জনাটি শুনতে পেয়ে শান্ত হই কিছুটা।

কেমন আছেন?Ñ বলতেই বলি, ভালো। কিন্তু আমার মধ্যে এই মুহূর্তে কিছুটা সংশয় কাজ করছে। তার কণ্ঠস্বর ঠিক চেনা মনে হচ্ছে না দেখে বললাম, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। তিনি আমাকে মনে করানোর চেষ্টায় বললেন, ওই যে সেদিন ভুলে… সকালবেলায়।

ও হ্যাঁ। স্যরি, চিনতে বিলম্ব হওয়ার জন্য। তো আপনার ভাইয়ের কী অবস্থা?

আল হামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ রহমতে এখন তিনি ভালো আছেন। আপনি ভালো আছেন তো?

হ্যাঁ।

আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করতে পারি?

কি বিষয়ে?

না, মানে এমনিই; কোনো বিষয় ছাড়াই। টপিক ছাড়া কি আলাপ করা যায় না!

আমি লজ্জা পেয়ে বলি, কেন নয়, অবশ্যই।

আপনার বাড়ি?

চট্টগ্রামে

কি করেন?

পড়াশোনা।

কিসে?

অনার্সে।

আপনি কী করেন জিজ্ঞেস করলে বলেন, শিক্ষকতায় আছি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াই এবং একটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। আমার বাড়ি নওগাঁ।

তার এটুকু পরিচয় জেনে এক নিশ্বাসে বলে দেইÑ ম্যাডাম, আপনি অনেক বড় মানুষ। আমার মতো ছাইপাঁশ লোকের সঙ্গে কথা বলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। তিনি বললেন, ওকে, ভালো থাকবেন। পরে কথা হবে। আমিও ভালো থাকার ইচ্ছে ব্যক্ত করি। সেদিনের মতো কথা শেষ হয়। এরই মধ্যে আরো বেশ কিছুদিন গত হয়ে যায়।

এই ক’দিন তার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে কল দিই।

হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?

হ্যাঁ, ভালো

আপনি?

আল হামদুলিল্লাহ, ভালো।

এতদিন পর আমাকে মনে পড়লো বুঝি?

না, মানে ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আজ সাহস করে আপনাকে বিরক্ত করলাম।

ভয়ের কোনো কারণ নেই এবং আমি বিরক্তও হইনি। চাইলে আপনি কল দিতে পারেন, দুজনে কিছু কথাবার্তা হলো; এই আরকি। আপনি যেহেতু স্টুডেন্ট, মিসডকল দিতে পারেন। আমার নির্দিষ্ট আয় আছে, আমি কলব্যাক করার অধিকার রাখি।

তার এমন সৌজন্যে মনে মনে মুগ্ধ হই। এদিন আর বেশি কথা হয়নি।

রাতে দেখি ফোন করে বললেন, আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। মাঝে-মাঝে এ ধরনের টুকটাক কথা বললে খুশি হবো। আমিও সায় দিলাম, ওকে। সেই রাতে আমাদের কথার স্থায়িত্ব ছিলো প্রায় পাঁচ মিনিট। এখন পূর্বের চেয়েও তার প্রতি আমার এক ধরনের আকর্ষণ ও ভালোলাগা কাজ করছে। এরপর প্রতিরাতে কথা হয় তার সঙ্গে। হাই-হ্যালো বলতে পারলে বাঁচি, নইলে আমার অবস্থা যায় যায়! তার মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল। তিনি দিনের বেলায় কথা বলতে পারেন না। যা কথা হতো রাতেই। এভাবেই যাচ্ছিল দিনকাল। একদিন কথা না বলতে পারলে দুজনার মাঝে অস্থিরতা তৈরি হতো ভীষণ রকম। একরাতে আমার মোবাইল বন্ধ ছিল। তিনি খুব অভিমান করে বসলেন। কাঁদলেন অঝোরে। যেন অনেক দিনের সম্পর্ক থেকে এই মান-অভিমান। এ ধরনের পাগলামির কিছুটা মানে হয়। এসবের বেদনার অর্থ থাকে এবং থাকতে হয় বলে মনে করি আমি। নইলে মানুষ বেঁচে থাকার আশা হারাবে। এই সিনিয়র নারীর সখ্যকে আমি প্রেমপর্ব জ্ঞান মনে করে নিয়েছি। আমার ইচ্ছের বাঁকবদল হয়েছে তার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে। এখন আমার একটাই ভয়াল শখ সিনিয়রদের সঙ্গে অন্বিত থেকে সমস্তই বিনিময় করা। আমি এ পথে দারুণ সফলতা পেতে চাই। সেটা বয়সের কারণে হোক অথবা ভাবে হোক। অথচ ভালোলাগার এমন উত্তুঙ্গপর্বে তার ফোন বন্ধ!  একদিন নয়; এভাবে টানা বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ পাই। তার শূন্যতা আমার মধ্যে হাহাকার তৈরি করে।

কোরবানির ঈদ এসে গেছে। পশুর সঙ্গে আমারও কোরবান হয়ে যাবার জোগাড়। কোরবানের সময় বাইরের পশুরা যেমন ঘরে ফিরে আমিও বাড়ি ফিরি রিক্ত হস্তে। তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় না কোনোক্রমে। কোরবান চলে যায়; আমি অর্ধ জবাইকৃত প্রাণীর মতো ছটফট করতে থাকি। অর্ধমাস পর লটারি লাগার মতো ফোনে পেয়ে যাই তাকে। হ্যালো, কেমন আছেন?

হ্যাঁ, ভালো; আপনি?

আমি বিনয়ের সাথে বলি, আমাকে ভালো থাকতে দিলেন কই! দীর্ঘ পনেরো দিন ধরে নিখোঁজ আপনি। আপনার নিখোঁজ সংবাদ আমাকে ভালো থাকতে দেয়নি একদম। আচ্ছা, এবার বলুন, এতদিন কোথায় ছিলেন?

বাড়িতে।

মোবাইল বন্ধ কেন?

আমি দ্বন্দ্বে পড়ে ফোন বন্ধ রেখেছি। আপনার কাছে আমার একটা বিষয়ে জানার আছে। বলুন তো বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে কী আসলে বন্ধুত্ব হয়! একজন নারী পুরুষের কাছে কি চায়? পুরুষই বা কি চায় নারীর কাছে? এই বিষণœতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে মোবাইল বন্ধ রাখা। আজকে পণ করেছি যে, মোবাইল অন করবো এবং নিজেই এর একটা সমাধান খুঁজে বার করবো।

এ বিষয়ে অনেকক্ষণ কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে আনমেরিড।

কেন? উত্তরে যা শোনালেন তাতে আমি খুব হতাশ হলাম। তার জীবনেও প্রেম আসে। কিন্তু স্থায়িত্ব পায়নি। ভোগের বন্ধ্যাত্বে প্রেমের বিলয় ঘটে। এর জন্য তিনি পুরুষকেই এককভাবে দায়ী করছেন। বিচ্ছেদ-দাহন তার মধ্যে পুরুষের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা ধরিয়েছে। পুরুষের প্রতি তার কঠিন মনোভাব তৈরি হয়ে আছে দীর্ঘ সময় ধরে। পুরুষ শব্দের সঙ্গে তার বৈরিতার পাথর জমে আছে। এই পাথরে ফুল ফুটানো কঠিন। এসব জেনেও আমি পাথর গলানোর ব্রতে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। আমাদের মাঝে বিন্দু বিন্দু প্রেম তিমির আঁধারে জোনাকির মতো আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হয় একসময়। তীর্থের কাকের মতো ছোঁয়াছুয়ির ইচ্ছা জাগে পরস্পরের মধ্যে। ভালোবাসার নীড়রচনার বাসনা জাগে দু’জনার মাঝে। একদিনের বিচ্ছেদ আমাদের মাঝে হাজারো বিষাদ হয়ে ঝরতে থাকে। পুরুষের প্রতি কঠিন আত্মার এই মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দুনিয়ার প্রান্তসীমা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। স্বর্গের কিনারায় স্বর্গীয় প্রেমের অদৃশ্য আত্মার সাদৃশ্য প্রেমে মিলিত হওয়ার চরম বাসনা তখন চরমে। যেন দেবীসত্তা সেবক হয়ে চোখের নীড়ে অঞ্জলি দিয়ে যায়। এ প্রেম অদৃশ্য আত্মার ভোগের উপভোগ কামনা করে। জন্ম-জন্মান্তরে মিলনের প্রতীক্ষায় থাকে সময়ের প্রতিটি ফোঁড়ে। একটি রাতের ভুলের মাশুল হয়ে থাকার দ্বন্দ্ব চলে। সাহারা মরুর তৃষ্ণার্ত পিপাসায় একবিন্দু জলের আকাক্সক্ষায় পেন্ডুলাম আমাদের মন-মনন। বিন্দু বিন্দু হয়ে জমে যাওয়া প্রেমের পাহাড় ভালোবাসার স্মৃতিস্তম্ভে ঠাঁই হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে আমি অর্ঘ্য দিয়ে ফুলের সুবাসে ধন্য হই। ফুলেরাও প্রাণ ফিরে পায় ফুলেল বসন্তে। চৈতালি হাওয়ায় ভ্রমরের গুঞ্জনে, অমৃতের সন্ধানে। যেখানে ভাঙামনে রিক্তদহন হয়। কেন জানি একরাতে যমজকণ্ঠে বলে ফেলিÑ হ্যাঁ, কখনো তোমার হাত ছাড়বো না; আসুক যত জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, ঝড়-তুফান। সাগরের বিদ্রোহী ঢেউ। যদি থেমেও যায় স্রোতস্বিনীর ধারা। যদিও থামে ঝরনার প্রবাহ। দু’জনে এগিয়ে যাবো জঞ্জাল ডিঙিয়ে নিষিদ্ধ ভোগের উন্মাদনায়।

হৃদয়ের দোলনায় দুলে-দুলে আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে ইতোমধ্যে। চাকরির সন্ধান করি ফাঁকে ফাঁকে। ভাগ্যে জুটে যায় চাকরি নামের লোহার শিকলও। বিচ্ছিন্ন এক প্রান্তসীমায় আমার পোস্টিং। যেখানে মৃত্যুরা মাথার খুলি হয়ে দ্রোহ দেখায়। পথিক ভয় পায়। কেউবা ডুবে পৃথিবীর মুখ আর দেখে না। সাগরের জলরাশিতে মিশে আরাফাতের প্রান্তরের নেশায় হাতছানি দিয়ে ইসরাফিলের শিঙায় ফুৎকারের অপেক্ষায় থাকে কেউ কেউ। দিনভর চাকরি নামের শিকলপরার ছলে আমি গেঁথে থাকি। ক্রমান্বয়ে যোগাযোগের ক্ষণে প্রেমের উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাটা নামতে থাকে। মেঘলা আকাশ বৃষ্টি ঝরিয়ে রোদের ঝলমল আলোতে নীল হয়ে ভালোবাসার ঋণ বাড়ায়। যখন ভাঙায় না প্রিয়রা প্রিয়ার মান তখন  গ্রীষ্মের খররৌদ্রে বরফখ- গলে ঝরনা হয়ে সাগরের লোনাজলে মিশে যায়। তখন ভেদ করা যায় না কোনটা চোখের জল আর কোনটা নদীর কিবা সাগরের। তখন নিজস্বতা বলতে কিছু থাকে না হেতু প্রেম কখনো সর্বনাশী কখনো গরলে পরিণত হয়ে আকাশের মেঘের মতো উড়ে উড়ে যায়। ব্যবধান বাড়ে বিস্তর। প্রেমের বিলুপ্তির, বিপত্তির রেখা দেখা দেয় ভাগ্যাকাশে। চাওয়ার বিলয় ঘটলে পাওয়াটুকু সম্বল করে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির গাণিতিক খেলায় ভালোবাসার হিসাবের লেনদেনে ঘাটতি থাকে প্রচুর। এই ঘাটতি জোগাড়যন্ত্র করেও ফিলআপ করা যায় না।

এখন আর তার সঙ্গে তেমনটা কথাবার্তা হয় না। মান-অভিমানের কিবা দ্রোহের বিউগল আর বেজে ওঠে না। কান্নার আওয়াজ পাই না। শোকের ভয়াবহতায় সে ফিরে যায় পাথরে। পূর্বের চেয়েও বেশ শক্ত-সামর্থ্য এই পাথর। একে ভেঙে গড়ার হিম্মত আমার নেই দেখে একদিন চড়–ই থেকে ভালোবাসা ধার নিয়ে কুঁড়েঘরে নীড় রচি। প্রেমের সন্ধানে সন্ধিৎসু হই। স্বর্গসুখের আহ্বানে সাড়া দেই, পাড়ি দেই। আমার চৌচির মনে ঝড় আসে প্লাবন হয়ে। চোখের ঝরনায় নদী হয়ে সাগরে মিশে জলোচ্ছ্বাস বাড়ায়। ধুয়ে-মুছে অশুচি হয় শুচি, নব পত্রপল্লবে নতুনের প্রত্যাশায়। নতুনের কটাক্ষ বাণে। কোমল হাতের স্নিগ্ধ শিহরণে। নতুন প্রেমে নতুন ফুলের ঘ্রাণে। শূন্য কুঁড়েঘর পূর্ণ হয় নয়া ভালোবাসায়; নয়া প্রেমের অবগাহনে।

এখানে মান-অভিমান নেই, শুধু আছে চাওয়া পাওয়ার মিষ্টি দ্বন্দ্ব। এখানে ঘ্রাণ নেই, আছে কেবল পাথরখ-ের অসাড় প্রাণ। তবুও অভিমানের খোঁজে অদৃশ্য প্রেমের স্মৃতিফলকে মিনার হয়ে প্রভাতের প্রতীক্ষায় থাকে ডিজিট ভুলে যাওয়া ফোনকলের দারুণ এক নেশা।