বিপুর অপেক্ষা

বিপুল বড়ুয়া :

কার্তিকের শেষাশেষি সময়। হাড়কাঁপুনি শীত জেঁকে বসেছে। হিমেল বাতাসে পাতায় কাঁপন ধরে না। ভারী কুয়াশা ভর করেছে পাতায় পাতায়। ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে খানিকটা।

রাত কতো হবে? দেড়-দুটো বেজে গেছে, চারদিকে সুনসান নিস্তব্ধতা। পাড়ার নেড়ি কুকুরগুলোরও সাড়া নেই। উঠোন দুয়ারে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে হয়তোবা।

বিপুরা চারজন এই কনকনে শীতের রাতে ঘুম ঘুম চোখে জেগে আছে-বড় পুকুরের উত্তর পাড়ের টং ঘরে। ঘুম ও জড়তার পাশাপাশি চোখ কান সদা সতর্ক। অস্পষ্ট শব্দেও জানান দিয়ে যায়-হুঁশিয়ার-জেগে থাকো-সাবধান…।

গেল ক’মাস থেকে এই জোর পাহারা। রাত নামলেই শংকা-হামলা হলো বলে। রাজাকাররা উঠে আসছে দীঘির পাড় হয়ে। আরো ভয়ংকর পিলেকাঁপানো পাকিস্তানি সৈন্য ছুটে আসছে কী? দুশ্চিন্তায় অস্থির গাঁও গেরামের মানুষ।

খোকা মামাদের বিরাট আলীশান বাড়ি দু’দুটো পুকুর পিছনে-সামনের পুকুর দীঘিসমান। গোয়ালে দুধেল গাই-কামধেনু; সামনে আড়ায় বাঁধা শিং সুচালো ষাঁড় আরো গোটা পাঁচেক হালের বলদ। জমি-জিরেত ম্যালা, গোলায় ধানে মচ্ছব-ভারি রমরমা অবস্থা। কেবা রাঁধে কেবা খায়-কোন কামরায় কে ঘুমায়। গ্রামে মান্যি-গণ্যি লোক তো বটেই। তাদের বিষয়-সম্পত্তির বহর দেখে চোখ ফেরানো যায় না।

ভারি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে দেশজুড়ে। পাকিস্তানি সৈন্য শহর চষে বেড়াচ্ছে-‘মুক্তি কিধার হায় বোলো’ এই বলে বলে আস্ফালন করছে। আর তাদের প্রতিরোধে যুদ্ধে নেমেছে আপামর বাঙালি, মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিফৌজ-গেরিলারা। যুদ্ধের সেই তা-ব ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামাঞ্চলে-হানাদার পাকিস্তানিদের মদদ দিচ্ছে রাজাকার-আলবদর তাদের দোসররা। যুদ্ধ শুরুর মাঝামাঝি শহর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে বিপুরা। সেই অব্দি এখানে আছে। হাটবাজারে, দোকানে যেতে দেয়নি মামারা। মফজল চেয়ারম্যান খবর রাখছে কারা কারা মুক্তিবাহিনীতে গেছে, কাদের বাড়িতে অপরিচিত লোক দেখা যাচ্ছে, কারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছে। সেটা গহিরাতে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে জানাচ্ছে, রাজাকার দল গঠন করেছে।

এখানে হাটবাজার-ইশকুল-ঘাটকূলে সেই যুদ্ধের কথাবার্তা বেশ ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের মনে নানা সন্দেহ। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ-কে জয়বাংলার লোক, কে পাকিস্তানের লোক, ফিসফাস অই বাড়ির ছেলে মুক্তিতে যোগ দিয়েছে-কারা রাজাকারে নাম লেখাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মুখ চুপসে চলাফেরা গ্রামে।

মামাদের সেই কোঠপাড়ে মুক্তি আর পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে ম্যালা মাতামাতি। বিপুদের মামাবাড়ি গ্রামের সেই পশ্চিমে-শেষ মাথায়। পশ্চিমে ভোলাদীঘির ওদিকে আলাপুর, খাঁরপাড়া ও মুজুরিপাড়ার লোকজন খুব একটা সুবিধের নয়। এদিককার নওশাপাড়া, গাজিরহাট, চারাওলের আওলাদ মুনশী, হোসেন ডিলার, মামুদ মিয়া সজ্জন মানুষ-তাদের মাঝে ধর্ম-বর্ণ বিভেদ বলতে কিছুই নেই। তারা চায়না-ধর্মের ধুয়া তুলে এই যুদ্ধদিনে কেউ কারো ওপর হামলা করে-ঘাপলা দিয়ে ফায়দা নিক বিবাদ ছড়িয়ে পড়ুক।

তাই তাদের সাফ কথা। এই গ্রামের কারো ওপর অবিচার-হামলা-জবরদস্তি হওয়া যাবে না। আপনারা নিশ্চিন্তে-নির্ভয়ে থাকুন। ওই মুজুরিপাড়ায় কুলাঙ্গাররা যদি হামলা ক্ষতি করতে চায় আমরা আছি, আমরা আপনাদের পাশে দাঁড়াব। তবে আপনাদের সজাগ থাকতে হবে-সচেতন থাকতে হবে। আমরা গাঁয়ে বিশৃঙ্খলা বরদাশত করব না।

সেই থেকে পাড়ায় পাড়ায়-বাড়ি বাড়ি রাত জেগে পাহারা চলেছে। ঝিম রাত থেকে সেই শেষ রাত অব্দি। সজাগ আছে-সবাই-খাঁর পাড়ার অসাধু বদমেজাজি লোকজন কিছু উঠকো ছুতো খুঁজে কারো ঘরে আগুন দিতে না পারে-নিদেন পক্ষে ঝগড়াঝাটি বাঁধাতে না পারে। এসব নিয়ে সবাই সজাগ।

শীতে কাবু বিপু’র এইসব কতো কথা-মনে আসে-তার পিঠে ঘটনা-অঘটনের ছবি ভাসে, মন খারাপ হয়ে যায়। ভয় পেয়ে যায় বিপু। বুকে কাঁপন ধরে যায়।

আচ্ছা মেজো মামা অই পশ্চিমদিকের বদ লোকরা যদি কোনো ছলছুতোয় হামলা করে বসে বসতঘরে আগুন-টাগুন ধরিয়ে দেয় বড় ঘরে না হোক গোয়াল ঘরে তবে কী হবে? কে আমাদের রক্ষা করবে হারামজাদাদের হাত থেকে।

মেজো মামাও ভাবনায় পড়ে যায়। চট করে কোনো উত্তর দেয় না বিপুর কথায়। কথার জবাব খুঁজতে থাকে। হ্যাঁ-তাইতো। কী হবে তাইলে এক দল লোক যদি ছুটে আসে কিরিচ-দা-লাঠিসোঁটা নিয়ে ভিটেবাড়ির জনা কয়েক লোক কী করে ঠেকাবে ওদের? তার ওপর হারামিরা গোয়ালে-পিছ বারান্দায় খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দিলে তা কীভাবে সামলাবে-তা ভাবতে শিউরে ওঠে মেজমামা। তখন কে কাকে বাঁচাবে।

‘না, না তুই ভয় পাসনে বিপু। ওদের জানের ভয় আছে না। অতো সোজা নাকি একদল লোক এসে অন্যের ঘর-বসতে হামলে পড়তে পারে নাকি। ঘরে লুটপাট চালাবে-আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে-গরু, ছাগল নিয়ে যাবে-গোলা ভেঙে ধান নিয়ে যাবে। মেজমামা শক্ত হতে চায়।

চারদিকে ল-ভ- অবস্থা হবে তো মামা। কে কাকে বাঁচাতে আসবে তখন। শুনেছি-লুটপাট করে ওরা ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মজা দেখে। বিপু ভয় পেয়ে বলে।

‘মজা আর দেখতে হবে না বিপু। দেখিস আমরা জয়বাংলার লোক বলে ওরা আমাদের ওপর ফুঁসছে। আমাদের ওপর হামলা করার ফন্দি ফিকির খুঁজছে। কিন্তু বলে দিলাম-মুক্তিযোদ্ধারা বসে নাই। ওরা জোর কদমে যুদ্ধ করছে। আমাদের আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। যুদ্ধে তো আমাদের জয় হবেই। পাকিস্তানের সৈন্য ও তাদের দোসর ওই রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর তখন কি হাল হয় দেখিস। এ কথা মনে রাখিস বিপু।

বিপু মন দিয়ে শোনে মেজোমামার কথা। দোনোমনো ভাবে খুশি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভয়ও গায় কাঁপুনি ধরয়ে দেয়। শুনেছে-দেশের কোথায় কোথায় গ্রামাঞ্চলে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ি বাড়ি আগুন দিয়েছে। লুটতরাজ চালিয়েছে-পালাতে যারা চেয়েছে তাদের নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করেছে, ছোট থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও রেহাই পায়নি। ভাবতেও বুক কাঁপে বিপু’র।

বিপুর ভয়তরাসে শীত কোথায় উবে যায়। মেজোমামার যুদ্ধদিনের কথা-পাকিস্তানি সেনার নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা ভেবে তার পিলে চমকে যায়। চোখের সামনে ভাসে বিপুর সে সব বিভীষিকাময় অদেখা ঘটনার ছবি। এতো মন খারাপ করা ভাবনার পর-ভয়াবহতার ভাবনার পর কিছু কিছু সুখময় ছবি বিপুর চোখের খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে দেয়। বিপু মনে করে দেখে হাইস্কুলের মাঠে সরগরম। ‘লেফট রাইট, মার্চ অন। লেফট রাইট, অ্যাবাউট টার্ন’ মুক্তিযোদ্ধাদের প্যারেড চলছে হরদম। চারপাশের গ্রামের ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে তৈরি হচ্ছে।

সাজ পোশাকের বিন্দুমাত্র তাদের নেই। সেনার পোশাক আশাক তো নেই। অস্ত্রশস্ত্রের বালাই নেই। কিন্তু তাদের আন্তরিকতা যুদ্ধে যাওয়ার মনোবল, একাগ্রতা দেখে বুক যেনো একহাত ফুলে ওঠে। বিপু অবাক করা চোখে দেখে আগামীর মুক্তিযোদ্ধাদের-ওরা যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের হারিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনবে ভাবতে বুক ভরে যায় অপরিসীম আনন্দে।

কিন্তু অতসবের পরেও বিপুর মনে শংকা কাটে না কিছুতেই। তাই কিছু একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে যাওয়ার রেশ থাকে আঁকড়ে। এই মুজুরিপাড়ার ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদের’ লোকজন-রাজাকারদের গ্রামে হামলা-অগ্নিসংযোগ-লুটপাট, পাকিস্তানি সৈন্যের হামলে পড়া ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞের দুর্ভাবনা তার পিলে কাঁপিয়ে দেয়। তাই সে মামাদের না করা সত্ত্বেও সেওরাতে পাহারায় যোগ দিয়েছে। ভয়ে তার দুচোখের ঘুম কোথায় যেনো উবে গেছে।

তার ওপর ভয়ংকর কথা। ফিসফিস করতে শুনেছে বড় মামার সঙ্গে কয়েকজনকে। ওই মুজুরিপাড়া, খাঁ পড়ার লোকজন নাকি যুগারহাটে বলাবলি করছে লুটপাটের পর মেঘদা বাড়ির দেয়াল ঘড়ি, কামধেনু গাভি, ধানের গোলার ধান, দেয়ালজোড়া পুরোনো আলমিরা, আর শিং উঁচু ষাঁড় আর চন্দ্রবাড়ির হালের বলদ, গোলার ধান, আর সোনাদানা কে কে ভাগাভাগি করে নেবে-তার সর্বনাশা কথা…।

শহুরে বিপু-বেশ বোঝে অতসবের পেছনে রয়েছে পাকিস্তানিদের এ দেশের দোসররা। ওরা তক্কে তক্কে আছে। সুবিধা হচ্ছে না আওলাদ মুনশী-হোসেন মিয়াদের চোখ রাঙানির কারণে।

এতে বেশ ভরসাও পায় ছোট্ট বিপু, তারপরও এই মাঝরাতে কি কি বলেই ফেলে বিপু। রাত শেষ হয়ে আসে। মেজো মামা ঝিম মেরে চেয়ে আছে পশ্চিমের দীঘির পাড়ের দিকে কোনে টর্চ জ্বললো কি না। তার ভাবনায় অপঘাত-দুঃস্বপ্ন।

আর বিপু। বিপু অপেক্ষায় এই ঘোর অমানিশার রাত ফুরলো বলে। ঝলমলে জয়বাংলার সূর্যোদয়ের অধীর অপেক্ষায়।