বিনিয়োগ সক্ষমতা এবং ব্যবসার পরিবেশ বিবেচনায় নতুন উচ্চতায় বাংলাদেশ

ছবি: পিআইডি

সুপ্রভাত ডেস্ক »

নির্মাণাধীন একশোটি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও এক ডজন হাই-টেক পার্ক, সম্ভাবনাময় ১১টি খাত এবং নতুন পাওয়া সামুদ্রিক অঞ্চল— সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য এই তিনটি বড় শক্তি রয়েছে বাংলাদেশের হাতে।

তার ওপর বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। এর ফলে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে ৪১১ বিলিয়ন ডলারের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে বিপুলসংখ্যক পণ্য ও সেবার জন্য বাংলাদেশ এক বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে।

বিনিয়োগ সক্ষমতা এবং ব্যবসার পরিবেশ বিবেচনায় নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। আছে বন্দর অবকাঠামো ও কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান। সব মিলিয়ে এশিয়ার উদীয়মান তারকায় পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।

এসবই নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি জানিয়ে এখনই এফডিআইয়ের (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) জন্য সঠিক সময় বলে মনে করছেন বিদেশী বিনিয়োগকারী, সহযোগী সংস্থা, কূটনৈতিক ও ব্যবসায়ীরা।

গতকাল দুই দিনব্যাপী ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২১ বাংলাদেশের প্লেনারি সেশনে এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন বক্তারা।

শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম দিনের অধিবেশনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশে কর্মরত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা অবকাঠামো ফাস্ট-ট্র্যাক করতে এবং ভোক্তা বাজার বড় করতে সরকারের গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য প্রধান আকর্ষণ বলে স্বীকার করেছেন।

তারা অবশ্য বলেছেন যে, কর ব্যবস্থা আরও সহজ করা দরকার। এবং কোনো ক্রুজ জাহাজকে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করতে যেন ৪০টি দপ্তরের ছাড়পত্র না লাগে, সেজন্য একটি ওয়ান-স্টপ সমাধান প্রয়োজন।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কর্তৃক আয়োজিত শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিনিয়োগকারীদের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের আশ্বাস দেন।

শীর্ষ সম্মেলনের মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। তিনি বলেন, ১১টি খাতে আগামী কয়েক বছরে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। কারণ বাংলাদেশ এখন আগের চেয়ে বেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করছে।

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি রূপালী হক চৌধুরী দেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য পূরণে এফডিআই বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন।

তিনি বলেন, এফআইসিসিআই সরকারের নীতি ও প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থা তৈরিতে সহায়তা করার জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সাথে যোগাযোগ রাখছে।

ইউনিলিভার দক্ষিণ এশিয়ার প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব মেহতা বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে ইউনিলিভার বাংলাদেশে আছে। চট্টগ্রামে একটি মাত্র কারখানা নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ঢাকায় দ্বিতীয় কারখানা স্থাপন করা হয়।’

বিশাল ভোক্তা থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ খুব আকর্ষণীয় গন্তব্য বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কর-কাঠামো সহজ করা হলে বাংলাদেশ একটি দুর্দান্ত বিনিয়োগ গন্তব্য হতে পারে।

বাংলাদেশ ও ভুটানের জন্য নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. মার্সি মিয়াং টেম্বন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখন পণ্য বৈচিত্র্য, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

তিনি বলেন, ‘আমি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে গিয়েছি। আমার মনে হয়েছে, শিল্পাঞ্চলগুলোতে পোশাক খাতে প্রায় ১ লাখ নতুন কর্মসংস্থান দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য গেমচেঞ্জার হবে।’

ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনে (আইএফসি) বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ম্যানেজার নুজহাত আনোয়ার বলেন, ‘এই পর্যায়ে আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশ একটি উন্নয়ন মডেলে পরিণত হয়েছে। এখন পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছার জন্য দেশের নতুন অর্থায়ন কৌশল থেকে শুরু করে নীতি সংশোধন পর্যন্ত একটি কৌশল প্রয়োজন।’

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবকাঠামোর জন্য ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৬০৮ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এই অর্থায়নের ৭৫ শতাংশ আসতে হবে  বেসরকারি খাত থেকে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন বলেন, “বাংলাদেশ অসম্ভবকে সম্ভব করছে, বিশ্বজুড়ে এর স্বীকৃতিও আছে।”

এদেশে ব্রিটিশ বিনিয়োগের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন।

তিনি বলেন, “অর্থনীতিকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে সম্পদ যথেষ্ট না। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব।”

“দ্বিতীয় বিষয়টি হলো বিদেশি পুঁজি বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক খাতের সংস্কার। আমি মনে করি পুঁজি বাজার আধুনিকীকরণের দারুণ সুযোগ আছে। এমনভাবে বিকাশের সম্ভাবনা আছে যাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে।”

সম্মেলনের অন্য সেশনে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, দেশী ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক।

মৎস্য জরিপের জন্য যৌথ উদ্যোগ, টুনা ফিশিংয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের আওতায় প্রকল্প নির্ধারণ, জ্বালানির জন্য ভর্তুকি ও দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা রাখার মত পরামর্শ দেন তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড একে আবদুল মোমেন বলেন, “বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমির বেশিরভাগ সম্পদই কাজে লাগানো হয়নি। এর ভগ্নাংশ থেকেই আমরা লাভবান হচ্ছি।”

আরেকটি সেশনে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান ৪৫৯টি কারখানার সাথে আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ জোন চালু আছে।

“এসব কারখানায় প্রায় ৪৭ হাজার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আছে, ৩৮টি দেশের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আছে,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী সদস্য এম এরফান শরীফ শিল্পাঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের জন্য কর ছুটি, শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা এবং অন্যান্য কর ছাড়ের কথা তুলে ধরেন।

তবে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া এর আগে বলেছিলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নে অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে ও একই সাথে বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স ছাড় দেওয়ার কারণে বোর্ড প্রায়ই সংকটে পড়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ নীতিগত সহায়তা দিতে প্রস্তুত কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, “এটি এক নতুন, আলাদা বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ দেখে সরে দাঁড়ায় না।”

“কোভিড-পরবর্তী বিশ্বের সব নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগকে আলিঙ্গন করে নিতে প্রস্তুত আমরা। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে ভিশন ২০৪১ এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ার আহবান জানাই,” বলেন তিনি।

সূত্র : টিবিএস