বাস্তুচ্যুতদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসনে পরিকল্পনা নিন

সুভাষ দে »

জীবিকার সন্ধানে দেশের মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, এটি স্বাভাবিক ঘটনা, অনেকে আবার কাজের মৌসুম শেষ করে নিজ বাসস্থানে ফিরে আসে। যেমন হাওর অঞ্চলে ধান কাটার সময়, আখ মাড়াই এর সময় উত্তরাঞ্চলের মানুষ যায়। ঠিকাদারের সর্দার অবকাঠামো নির্মাণে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল থেকে মানুষদের কাজে নিয়োজিত করে। আমরা দেখেছি মঙ্গার সময় উত্তরাঞ্চলের মানুষ দেশের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে যেত। এখন সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, টেস্ট রিলিফ, এনজিওদের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, বিদেশে কর্মসংস্থান, দেশের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ প্রাপ্তির ফলে স্বÑকর্মসংস্থান এবং স্থানীয়ভাবে ছোট শিল্পের বিকাশ ঘটায় গ্রামাঞ্চলে নিজ বাড়িঘরে থেকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
কিন্তু এরপরও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা কারণে বাস্তুচ্যুতি ঘটছে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রধান কারণ; ঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন, প্লাবন এসবের প্রভাবে প্রতিনিয়তই মানুষের বাস্তচ্যুতি ঘটছে। যদিও দুর্যোগ কেটে গেলে অথবা পরিস্থিতি সহনীয় হলে বাড়িতে ফিরে আসে কিন্তু তখন জীবিকার অনিশ্চয়তা, অভাব অনটন তাদের সামনে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও নানা কারণে মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটছে। এর মধ্যে আছে সহিংসতা, রাজনৈতিক হানাহানি ও প্রতিশোধপরায়ণতা, গ্রামাঞ্চলে প্রভাবশালী ও ধনীদের পরের জমি ও ভিটার ওপর লোভ ও নানা ছলছুতোয় গরিবের বসত ও জায়গাÑজমি গ্রাস করা, আদিবাসীদের জায়গা জমি থেকে উচ্ছেদ করা, সংখ্যালঘুদের নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বাড়ি ছাড়া করা ইত্যাদি।
সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএসসি) অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি: বছরের মধ্যবর্তী চিত্র’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। গত বছরের পুরো সময়ে সংখ্যাটি ছিল ৪১ লাখ ৭০ হাজার (সূত্র : প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর ২০২০)।
প্রতিবেদনটি গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, নিজ দেশের ভিতর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়ার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। এক নম্বরে রয়েছে ভারত। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম ৬ মাসে ২৪ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পানের’ শঙ্কায় আশ্রয়কেন্দ্রে যায়, আরো ১ লাখ নিজ ব্যবস্থায় অন্য জায়গায় যায়, বন্যার সময় ও কয়েক লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র সড়ক ও স্থানান্তরে আশ্রয় নেয়। দুর্যোগ শেষে অনেকে ঘরে ফিরে যায়। দেশে দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলি এ সংখ্যা আরো বেশি বলেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সংবাদ মাধ্যমে বলেন, যারা ঘরে ফিরতে পারে না এমন আট লাখ মানুষের জন্য সরকার গুচ্ছগ্রাম তৈরি করে দিচ্ছে (সূত্র : প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর ২০২০)।
আইডিএমসির প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্যোগে মানুষের ফসল, সবজি ও মাছের ক্ষতি হয়েছে। এর সাথে করোনার সংক্রমণেও মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইডিএমসি দুই ধরণের বাস্তুচ্যুতির কথা উল্লেখ করেছে। অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সংঘাতে বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে সিরিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক কঙ্গো, বুরকিনা ফাস্কো, দক্ষিণ সুদান ও সোমালিয়ার মানুষ। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেও এ ধরণের বাস্তুচ্যুতির ঘটনা নিয়মিত ঘটছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকার মানুষের দুর্ভোগের কারণ ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ। এই বাঁধগুলি কয়েক দশক আগের তৈরি। জোড়াতালি ও নি¤œমানের কাজের কারণে বেড়িবাঁধ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যায়। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে খুলনার কয়রা উপজেলার বাঁধ ভেঙে যায় গত ২০ মে, সে বাঁধ মেরামত করা হয়নি। জোয়ার ভাটায় মানুষ ভাসেÑএরা বাড়িঘরে যেতে পারেনা। সড়কের ওপর এদের দিনরাত্রি যাপন। এর প্রায় ১দশক আগে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার তা-ব এবং জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় বাঁধ ভেঙেছে। ভালোভাবে স্থায়ী মেরামত হয়নি। তাছাড়া ফসল ও মাছের ঘেরে লবণাক্ত পানি ঢুকেছে। উপকূলীয় এলাকায় মানুষের জীবনযাত্রা, চাষাবাদ কষ্টকর হয়ে উঠেছে। বাধ্য হয়ে তাদের বাস্তুত্যাগ করতে হয়েছে।
একই সাথে আছে নদীভাঙন এর ফলে প্রতিবছর জনপদ ভাঙে, তলিয়ে যায় নদীগর্ভে। ছোট হয়ে আসে জেলা উপজেলার মানচিত্র। বাস্তচ্যুতি ঘটে, আশ্রয় নেয় শহরের বস্তিতে, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুপরি তুলে। একদার সম্পন্ন জীবন হারিয়ে যায়। সব কেড়ে নেয় নদী, সাগর। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, হালদা, শঙ্খ, মাতামুহুরি, বাঁকখালি নদীগুলি প্রতিবছরই নতুন নতুন জনপদ, স্থাপনা গ্রাস করে। উদ্বাস্তু হয়ে নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেক পরিবার কয়েকদফা স্থানান্তরে গিয়েও নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পায় না।
সুইডেনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা রাউল ওয়ালেনবার্গ ইনস্টিটিউট (আরডব্লিউআই) এবং ইনডেপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি) এর এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল এই এক দশকে বাংলাদেশে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে ৬৮ লাখ মানুষ। ‘দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত : আইন ও নীতি সুরক্ষা’ শীর্ষক এই গবেষণাটি ১০ দেশের ওপর করা হয়েছে যেগুলি জলবায়ুজনিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে তাদের ঘরবাড়ি রক্ষায় নদী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারের একশ বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনার কাজ কিছু শুরু হয়েছে। দেশের নদীগুলি দখলÑদূষণ থেকে রক্ষা করা, নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। নদীভাঙন বড় সমস্যা আমাদের দেশে। এ ক্ষেত্রে দেশিÑবিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। বাস্তুচ্যুতরা যাতে নিজ এলাকায় থাকতে পারে সেভাবেই পরিকল্পনা নিতে হবে। এজন্য উপকূলীয় ও নদীতীরবর্তী এলাকায় উঁচু করে বাঁধ ও সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চগুলিতে তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ঝড়, বন্যা, নদীভাঙন এবং নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবছর এসব দুর্যোগে মানুষ ঘর ছাড়া হচ্ছে। সহায়Ñসম্বলহীন এসব মানুষ শহরে গঞ্জে ভিড় করছে এছাড়া নানাবিধ ফসলের ক্ষতিও ব্যাপক। মানুষ উঠে দাঁড়াতে পারছে না প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে। দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে তারা। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে স্বাস্থ্য, পুষ্টি সংকট ব্যাপক, সন্তানদের লেখাপাড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা, কিংবা স্থায়ী পুনর্বাসন নিয়ে সরকারের প্রচেষ্টাও তেমন দৃশ্যমান নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাৎক্ষণিক কিছু ত্রাণ সাহায্য দিয়েই কর্তব্য শেষ হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য জাদুঘরে পাঠাবে বলছে সরকারি কর্মকর্তারা কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি প্রতিকার, অভিযোজন ক্ষমতা কোথায়? সরকার থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্প কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে কিছু, কয়েক ক্ষেত্রে দুর্যোগ সহনশীল ঘর তৈরি করে দিচ্ছে সরকার। এসব প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই সামান্য। প্রয়োজন স্থায়ী পুনর্বাসন ও সুরক্ষার কর্মসূচি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে স্থায়ী পরিকল্পনা, যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন নদীর ড্রেজিং করে গভীরতা বাড়ানো, নদীর তীর উঁচু করা, নদীকে দখল থেকে মুক্ত করা। যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ পানির স্বাভাবিক ¯্রােত বাধাগ্রস্ত করে। নদীশাসন করে নদীভাঙন রোধ করা প্রয়োজন। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী দ্বীপাঞ্চল, উপকূলবর্তী এলাকা ভাঙনে ছোট হয়ে এসেছে। দেশের সমগ্র উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ, সড়ক ও বনায়ন সৃজন প্রয়োজন। যে সব মানুষ প্রতিবছর বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাদের সুরক্ষায় আইনি ব্যবস্থা ও স্থায়ী পুনর্বাসন পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে জরিপ, গবেষণা চালানো জরুরি। এতে ক্ষয়ক্ষতির অনুমান ও প্রতিকারে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়। মোট কথা প্রতিবছর বাজেটে এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বিস্তারিত কর্মসূচি, অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক