ফুঁ বাবা

মইনুল আবেদীন »

মুনার বাপের ফুঁ-এর কেরামতির গোপন খবর  গ্রামশুদ্ধ লোক জানতে পারে ফাল্গুনের মাঝামাঝি। উত্তরপাড়ার বাবুল মাস্টারের বৃদ্ধা মা জইতুন বিবি দীর্ঘ সাতবছর প্যারালাইসিসে বিছানায় পড়ে  থেকে এখন কিনা মুনার বাপের ফুুঁঁ দেয়া পানি খেয়ে দিব্যি হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে। ‘চলো চলো জইতুন বিবিরে দেখতে চলো’- এ পাড়ায় এখন এমনই সাজসাজ রব। সকলে আরো জেনে গেছে মুনশি বাড়ির সাতবছরের মেয়ে মায়মুনা, যে কিনা হাজারো ডাক্তার-বদ্যি দেখানোর পরেও এতদিন পর্যন্ত ‘ও আ’ গোঙাানি ছাড়া আর কোনো অর্থবহ শব্দ শিখেনি, মুনার বাপের পানি পড়া খেয়ে তার মুখে এখন খই ফুটার মত কথা। আর ভূঁইয়া বাড়ির বারিক ভূঁইয়ার ছেলের ঘরের নাতনি জোবেদা, বিয়ের সাতবছরেও সন্তান হয় না। জামাই তাকে এই ত্যাগ করলো বলে হাটে-বাজারে গুজব, সেও কিনা এখন তিন মাসের  পোয়াতি?  তাও তো ওই মুনার বাপের ফুঁ দেয়া পানির গুণে।

‘আরে মুনার বাপের লগে যে জিন আছে হিয়ান তো আঁরা বওত আগেরত্ন্ ুজানি।‘  ভোলামিস্ত্রী বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে। কথাটা কেনু ফকিরের মনে ধরে। কেননা সে তার বাবা রাজা মিঞার কাছে শুনেছে সোলেমান নবী যেসব দুষ্ট জিনদের বোতলে ভরে গভীর সাগরে ফেলে দিয়েছিলেন, ৯১’র প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র জলোচ্ছ্বাসে সেই  বোতলগুলো ভেঙে জিনেরা সব মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। এমনি এক জিন, যিনি নাকি মুসা নবীর আমলের, বয়স যার তিন হাজার বছরের কম না, গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে অনেক পুরোনো এক জংগলাকীর্ণ  গোরস্তানের বুড়ো বটগাছটার মগডালে আস্তানা গেড়ে আছেন।

মেট্রিক ফেল খোরশেদ, তবুও তো মেট্রিক দিয়েছি বলে যার বুকটা এখনো গর্বে ভরে থাকে, এ কথায় চমকে ওঠে।

দুইদিন আগের কথা। তার বাড়ি আসতে হলে ওই গোরস্তানটা পেরোতে হয়। হাটবার ছিল বলে সওদা নিয়ে ফিরতে-ফিরতে ভরসন্ধ্যার মতো হয়ে যায়। বাজারের থলেটা একটি গাছের নিচে রেখে, ভাবে যে একবার ময়-মুরুব্বিদের কবর  জেয়ারত করে যায়। দুহাত বুকে ভাঁজ করে ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহ্লাল্কবুর’ এতটুকু পড়তেই দেখে কি মুনার বাপ, হ্যাঁ, মুনার বাপই তো, বটগাছের নিচে উবু হয়ে কি যেন খুঁজছে। খোরশেদ সাথে-সাথে ডাক দেয়, ‘ও জেডা, কি তোয়াই তা লাইগ্য?’ মুনার বাপ এমনভাবে ধড়ফড়িয়ে উঠে যে ডানতালুর পেছন দেখানোর ভঙ্গি করে হাত নেড়ে-নেড়ে বলে, ‘বাদ দে ও বাজি বাদ দে’। তারপর হনহনিয়ে একদিকে হাঁটা দেয়। মুনার বাপের কথা এবং আচরণের এ রকম অসঙ্গতি দেখে  খোরশেদ জেয়ারত শেষ না করেই বাড়ি ফিরে বৌয়ের কাছে একগ্লাস ঠান্ডা পানি চায়।

এখন খোরশেদের বৌ জুলেখা, মাত্র একবার সন্তান প্রসব করে আর দ্বিতীয়বার মা হওয়ার সাধ যার আর কিছুতেই ঘুচছে না,  সে এখন কী করবে? সে মনে করে রেখেছে  সেদিন তার স্বামীর কেঁপে-কেঁপে পানি খাওয়ার দৃশ্য এবং জিনের সাথে মুনার বাপের কথিত গোপন সম্পর্কের প্রত্যক্ষদর্শীও সেই খোরশেদই, তাই মুনার বাপের ফুঁ-এর কেরামতির ওপর তার একধরনের অধিকারবোধ জন্মায়। রাতে বিছানায় খোরশেদের গলা জড়িয়ে সে আবদার করে শীঘ্রই দুজন যাবে কিন্তু মুনার বাপের কাছে।

কেনু ফকির ছোটোবেলায় টাইফয়েডে দুই  চোখ হারিয়ে এখন লাঠি ঠুকে-ঠুকে বাস আর রেলস্টেশানে মারফতি গান গায় আর ভিক্ষা করে। সে যখন হাতটা বাড়িয়ে ধরে করুণসুরে গান বাঁধে :

‘আছেন কি এমন কোনো আল্লার বান্দা,

দিনরাত করেন আল্লা-রসুলের ধান্দা,

আল্লার আরশের সাথে যার পরাণটা

আছে বান্দা!’

দূরদূরান্তে গমনোন্মুখ যাত্রীসাধারন তাদের নিজেদের এবং পরিবারের সার্বিক কল্যাণে তার হাতে বেশ ভালো একখানা নোট ধরিয়ে দেয়। এতে করে কেনুর আয়  রোজগার মন্দ হয় না। এখন মুনার বাপের এক ফুঁতে তার চোখ যদি ফের ভালো হয়ে যায়, এ ভাবনায় সে মুষড়ে পড়ে বলে বসে, ‘তোঁআরা যাইলে য, যেই ভিড়ের ঠেলা’

আসলেই এখন মুনার বাপের বাড়ির সামনে পুকুরপাড়ের শিমুলগাছের নিচে হইহই ভিড়। গ্রাম তো গ্রাম, এমনকি সুদূর শহর  থেকেও দামি চকচকে গাড়ি নিয়ে সুন্দর  পোশাকের ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলারাও আসছেন। লাঠি হাতে বেজায় তৎপর  স্বেচ্ছাসেবকেরা এসব গাড়ির লাইন সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। মহাসড়কের ওপর বড় লাল ব্যানার ঝুলিয়ে  কেউ তিরচিহ্ন এঁকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে : ‘ফুঁ বাবার আস্তানা এদিকে’।

শহরের লোকজন বলাবলি করে, ‘আরে শুনেছো, ওই এএসপি সাখাওয়াত, ওতো ধুম করে কক্সবাজারের এসপি হলো এই ফুঁ বাবার দোয়ায়। কাউকে কিছু না বলে চুপিচুপি এসেছিল তো গত সপ্তায়।’

রোডস্ এন্ড হাইওয়ের সহকারী প্রকৌশলী লিয়াকত, প্রমোশন হয় না বলে যে দিনরাত সুন্দরী বৌয়ের ধ্যাতানি খাচ্ছে, ওপাশ  থেকে এ কথা কানে আসায় সে আশার আলো দেখে এবং এত কষ্ট করে এতদূর আসার সার্থকতা খুঁজে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

রাস্তার পাশে বাঁশ পুঁতে একটি খাপড়াঘরের মতো তোলা হয়েছে এবং সেখানে টেবিল  পেতে রাখা কার্টনভর্তি মিনারেল ওয়াটারের  বোতল নিয়ে বসে আছে দুজন মাঝবয়সী  লোক। ফুঁ বাবদ বেশ মোটা অংকের হাদিয়া আর মিনারেল ওয়াটারের দাম চুকিয়ে  লোকজন লাইনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। কে যেন ঘাড় থেকে ফাল্গুন মাসের দুপুরের ঈষৎ গরম ভাপ মুছে বলে ওঠে, ‘টেন্ডারটা যদি এবার ভাগ্যে না জোটে তো জীবনে আর  সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব না। এবার ফুঁ-বাবার দয়ায় একটা হিল্যে হলেই হয়।’

রংজ্বলা জিন্স-এর কালো রোদ চশমা একজন লম্বা মতো তরুণ তড়িঘড়ি লাইনে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বিড় বিড় করছিল, ‘মুন্নির মনটা এবার সত্যি সত্যি পাব তো?’

এত সব শহুরে লোকের মধ্যে লাইনের একেবারে অগ্রভাগে মেট্রিক ফেল  খোরশেদও এসেছে বৌ নিয়ে। অনেক সকালে রওনা দিয়েছিল বলে রক্ষা। ঘরের ধানবেচা সামান্য কিছু টাকা গচ্ছিত ছিল, তাই দিয়ে ফুঁ-বাবার হাদিয়া দিয়েছে।  বৌকে অনেক ভালোবাসে ও, বৌয়ের মন রক্ষায় সবকিছু পারে। খুব দ্রুতই তার পালা যখন আসে, ত্রস্তে সামনে এগিয়ে গিয়ে ছিপি খুলে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা সসম্ভ্রমে মুনার বাপের দিকে এগিয়ে দেয় ও। মুনার বাপ তিনবার ফুঁ দিয়ে বোতলটা যখন ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে পেছন থেকে  কে যেন ওকে সজোরে ধাক্কা দেয়।  বোতলসমেত মুখ থুবড়ে পড়ে ও, সব পানি  বেরিয়ে গিয়ে পলকা বোতলটা গড়িয়ে-গড়িয়ে ওর চোখের সামনে অনেক দূরে চলে যায়। ভিড়ের মধ্যেকার  মৃদু গুঞ্জন ক্রমশ বাড়তে থাকে। ভূঁইয়া বাড়ির কে  যেন হেঁড়ে গলায় চেঁচায়, ‘আঁরর গ্রামের মাইন্ষের গাত হাত তুইল্য খন্রে?’

মেট্রিক ফেল খোরশেদ ফ্যালফ্যাল করে অদূরে পানিশূন্য বোতলটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। উত্তর পাড়ার রজব সারেং, যার গায়ে ধাক্কা লেগে  খোরশেদের এই সর্বনাশ, সে রুখে ওঠে, ‘এই হালা লাইন ভাংলো খিল্লাই? আঁইতো ইতার আগে আছিলাম যে।‘

খোরশেদ এবার তার ভূঁইয়া বংশের আহত অহম নিয়ে রাগ ঝাড়ার ভালো মওকা পায়। ‘চোদানির পোয়া তুই আঁরে ধাক্কা দিলি কা?’

ভুঁইয়া বাড়ি আর উত্তর পাড়ার মানুষ নিমেষে দুই জোট বাঁধে আর হা হা করে একে অন্যের দিকে তেড়ে আসে।

মুনার বাপ মাচার ওপর দাঁড়িয়ে আচমকা শুরু হওয়া এসব হুড়োহুড়ি হট্টগোল দেখে আর সবই তার ভীষণ চেনা-চেনা লাগে।

সে প্রায় বছর দশেক আগের কথা। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দিন মুনাকে নিয়ে ভোট দিতে এসে হঠাৎ এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। বলা নেই কওয়া নেই, ভীষণ জোরে বোমা না ককটেল ফুটলো। ভোট দিতে লাইনে দাঁড়ানো লোকজন দিগবিদিক ছুটে গেল। এই সময় পরপর গুলির শব্দ। তার চোখের সামনেই মুনা চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মুনার বাপ রক্তাক্ত ছেলেকে  কোলে তুলে আহাজারি শুরু করলো। তার জোয়ান ছেলেটাকে বাঁচাতে কেউ কাছে এগিয়ে এল না। কিছুক্ষণ পর একদল পুলিশ এসে নিথর মুনাকে ট্রাকে করে নিয়ে গেল।  ছেলেকে আর কখনো দেখেনি মুনার বাপ।  ছেলের শোকে মুনার মা’টাও মরলো ছ’মাস পর। এরপর গত দশ বছর একরকম ঘরছাড়া বাউন্ডুলে মুনার বাপ আশপাশের নতুন-পুরনো গোরস্তানে ছেলের লাশ খুঁজে  বেড়াচ্ছে।

ঠিক সেদিনের মতই লোকজন যে যেদিক পারে ছুটছে। শহুরে মানুষগুলোর গাড়িগুলো অবিরত ভেঁপু বাজাচ্ছে। এমন সময় মাচায় দাঁড়িয়ে থেকে মুনার বাপ খেয়াল করে কয়েকজন পুলিশ লাঠি হাতে বাঁশি বাজাতে-বাজাতে তার দিকে তেড়ে আসছে। যা হোক অনেকদিন পর এদের কাছে নিজের ছেলের লাশের একটা হদিশ পাওয়া যেতে পারে ভেবে মুনার বাপের  বেশ খুশি-খুশি লাগে।