প্রধানমন্ত্রীর কাছে চট্টগ্রামের ২৫ বিশিষ্টজনের খোলা চিঠি

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

প্রাচ্যের রানী খ্যাত চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।

আপনার অবিদিত নেই চট্টগ্রাম বিশ্বের প্রাচীনতম একটি নগরবন্দর। প্রখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পোলো, ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম ভ্রমণ করে এই নগরের গৌরবগাঁথা বর্ণনা করে গেছেন। পাহাড়, সমুদ্র ও নদী বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি চট্টগ্রাম মহানগরী বহুকাল ধরে প্রাচ্যের রানী হিসেবে খ্যাত। দুঃখের ব্যাপার, এই নগরীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এই শহরে এক সময় অনেক পাহাড়, দীঘি ও পুকুর ছিল, ছিল শাল, রেইনট্রি ইত্যাদি বৃক্ষ আচ্ছাদিত রাস্তা, ছিল বাটালি হিল এবং ফেয়ারি হিল বা কাচারি পাহাড়। বাটালি হিল পাকিস্তান আমলেই ধ্বংস করা হয়েছে। কাচারি পাহাড়ের উপরও আঘাত হেনেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার যখন এই পাহাড়ের পাদদেশের বিশাল অংশ কেটে তৈরি করা হয় নিউ মার্কেট, জেনারেল পোস্ট অফিস ও স্টেট ব্যাংক। এক সময় কাচারি পাহাড় এবং কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত সদরঘাট ব্রিজ ছিল প্রকৃতি প্রেমী চট্টগ্রামবাসীর বেড়ানোর জায়গা, ক্লান্তি অপসারণের জায়গা। আজ সদরঘাট ব্রিজের কথা দূষিত কর্ণফুলীর কারণে মানুষ ভুলে গেছে। দুই দশক আগেও কাচারি পাহাড়ে ভ্রমণ পিয়াসীরা বেড়াতে গেলে দেখতে পেতেন কর্ণফুলী নদী কি অবর্ণনীয় সুন্দরভাবে চট্টগ্রাম শহরকে  ‘মেখলা বা ‘মালার মতো বেষ্টন করে রয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতি এবং মানুষের লোভের আঘাতে আজ প্রকৃতির অপরূপ এসব দান তিরোহিত। কেবলমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে মহানগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি। শতবর্ষী বৃক্ষরাজি পাহাড়, টিলা ও উপত্যকায় ঘেরা বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমন্ডিত একটি অনন্য প্রাকৃতিক স্থান এই সিআরবি।

বর্তমানে প্রকৃতির অসীমদানে-ঋদ্ধ এরকম বড় উন্মুক্ত স্থান চট্টগ্রামে আর নেই, যেখানে ঢাকায় রয়েছে রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাহাদুর পার্ক সহ বৃক্ষ-শোভিত বহু উন্মুক্ত অঞ্চল ও বহু খেলার মাঠ। চট্টগ্রামের এই সিআরবির উন্মুক্ত স্থানেই এখন আয়োজিত হয় বাংলা নববর্ষ বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী, নজরুল জন্মবার্ষিকী ও বাঙালির অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এক সময় বাঙালির প্রাণের এই অনুষ্ঠানগুলো উদযাপিত হতো ডিসি হিলে, সার্কিট হাউজের সামনের উন্মুক্ত স্থানে যা এখন জিয়া শিশু পার্ক এবং আউটার স্টেডিয়ামে যা এখন একটি বিশাল কংক্রিট আচ্ছাদিত সুইমিংপুল ও বিপণী কেন্দ্র।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আপনার প্রকৃতি প্রেম, প্রকৃতি বান্ধবতা বিশ্ববিদিত। ২০২১ সালের ২২শে এপ্রিল ‘লিডার্স সামিট অন ক্লাইমেট’এ প্রকৃতি নিয়ে যে ৪০ জন বিশ্ব নেতা বক্তব্য রেখেছেন সেখানে আপনি কার্বণ নিঃসরণ হ্রাসের মাধ্যমে বিশ্বের প্রাকৃতিক উষ্ণতা যেন বর্তমান পর্যায় থেকে দেড় শতাংশের বেশি না বাড়ে তা দাবী করে যে আহবান জানিয়েছেন তা বিশ্ব নন্দিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, আপনি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় দীর্ঘকাল ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই উদ্যোগেরই অংশ হিসেবে আপনার নেতৃত্বে আজ যেখানে বাংলাদেশ জুড়ে বিপুলভাবে বৃক্ষ রোপণের বিরাট উদ্যোগ শুরু হয়েছে, সেখানে বোটানিকাল গার্ডেনের মতো বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য শতবর্ষী বৃক্ষরাজি শোভিত চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি এলাকায় যদি বিত্তবানদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য একটি মুনাফাভিত্তিক বেসরকারি হাসপাতাল নির্মিত হয় তার চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আর কি হতে পারে!

তাই, চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের আপনার কাছে ঐকান্তিক আবেদন, চট্টগ্রামের এই অপরূপ প্রকৃতি-ঋদ্ধ সিআরবি এলাকাটিকে রক্ষা করুন। পরম সম্মানিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা আরো জেনেছি, এই উপরে উল্লেখিত হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার জন্য ২০১৭ সালে আহূত ইনভাইটেশন ফর বিড (আইএফবি) নোটিশে প্রকল্পের স্থান হিসেবে সিআরবির নাম ছিল না। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৪ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, “বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমন্ডিত স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহকে বিকৃতি, বিনাশ বা অপসারণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। এছাড়াও মাস্টার প্ল্যানের আলোকে ২০০৯ সালে সিডিএ কর্তৃক প্রণীত “ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)” এ সিআরবি-কে “সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য” হিসেবে সংরক্ষণের কথা উল্লেখ আছে। সুতরাং আমাদের বক্তব্য, সিআরবি অথবা রেলওয়ের বৃক্ষ আচ্ছাদিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত অন্যান্য জায়গা ব্যতিরেকে রেলওয়ের মালিকানাধীন বিশাল বিস্তৃত সমতল ভূমির অন্য যেকোন একটি জায়গায় যেমন; বিজিএমই ভবনের কাছে, ইউএসটিসি এবং ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের পাশে এই হাসপাতালটি নির্মাণ করা যেতে পারে। অবশ্য আমরা আশা করি, সরকারি জায়গায় যদি কোন বেসরকারি স্থাপনা নির্মাণ করা হয় তা যেন প্রকৃত অর্থেই জনকল্যাণমূলক হয়, মুনাফাভিত্তিক নয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদ হিসেবে আত্মোৎসর্গ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭১ সালের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শহীদ আব্দুর রব। তাঁর এবং আরো ৮ জন শহীদের সমাধিস্থল এই সিআরবি এলাকা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান এসব বীর শহীদদের গৌরব স্মৃতি এখানে অম্লান ও অক্ষুণ থাকুক এই আমাদের কামনা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আপনার অসাধারণ নেতৃত্বে চট্টগ্রাম আজ ভৌত অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বিপুলভাবে এগিয়ে গেছে। চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নির্মিত হয়েছে ফ্লাইওভার, কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে মিরসরাই পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে বে ভিউ হাইওয়ে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি করা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল; বঙ্গবন্ধু টানেল।

কিন্তু এসব মহতী অর্জন সত্ত্বেও চট্টগ্রাম শহর আজ পরিণত হয়েছে “ইটের পরে ইট” বিশিষ্ট একটি নগরীতে। এখানে শিশু কিশোরদের খেলার জন্য কোন মাঠ নেই, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের জন্য নেই কোন হাঁটার জায়গা; সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ক্লান্তি থেকে মুক্তির জন্য নেই কোন বেড়ানোর উন্মুক্ত স্থান, কেবলমাত্র সিআরবি ছাড়া। অসংখ্য বৃক্ষরাজি শোভিত এই নগরটি আজ প্রায় বৃক্ষহীন। সভ্যতার অগ্রগতি একদিকে এই শহরটিকে করেছে চাকচিক্যময়, অন্যদিকে প্রকৃতির দাক্ষিণ্যহীন প্রাণহীন নগর।

আপনার কাছে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে আমরা আকুল আবেদন জানাচ্ছি, চট্টগ্রামের শেষ প্রকৃতি-ঋদ্ধ স্থান সিআরবিকে রক্ষা করুন।। আপনার মহতী নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি মানবিক, পরিবেশ সমৃদ্ধ উন্নত দেশে পরিণত হোক, এই কামনা করি। আপনার জয় হোক।

বিনীত নিবেদক

প্রফেসর ড. অনুপম সেন, সমাজ বিজ্ঞানী, একুশে পদক প্রাপ্ত শিক্ষাবিদ, সদস্য, কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মন্ডলী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বেগম মুশতারী শফি, শহীদ জায়া, এম. এ মালেক, সম্পাদক, দৈনিক আজাদী (স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র), ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, সম্পাদক, দৈনিক পূর্বকোণ, অধ্যাপক আবুল মনসুর, বিশিষ্ট চিত্র শিল্পী ও প্রাক্তন অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, আবুল মোমেন, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কবি, মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সভাপতি, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ, অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠক, ডা.মাহফুজুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, সভাপতি, চট্টগ্রাম পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, খোরশেদ আলম সুজন, সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ ও প্রাক্তন প্রশাসক, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ, মো. মফিজুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ, আহমেদ ইকবাল হায়দার, একুশে পদক প্রাপ্ত বিশিষ্ট নাট্যজন, মাহবুবুল আলম, প্রেসিডেন্ট, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি, অধ্যাপিকা ফেরদৌস আরা আলীম, কবি, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম, শিক্ষাবিদ, আলহাজ্ব আলী আব্বাস, সভাপতি, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব, রুশো মাহমুদ, সম্পাদক, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, মুজিবুর রহমান সিআইপি, সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ, সৈয়দ উমর ফারুক, সম্পাদক, দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ, মোজাফফর আহমেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডার, চট্টগ্রাম মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মো. ইউনুস, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মহাসচিব, বিজয় মেলা পরিষদ, কামরুল হাসান বাদল, কবি, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি।