পুলিশ হেফাজতে দুদকের সাবেক কর্মকর্তার মৃত্যু

সিএমপির তদন্ত কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক »

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক উপপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ মঙ্গলবার রাতে নগরীর চান্দগাঁও থানা হেফাজতে থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এ ঘটনায় নানা প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। তার পরিবারের লোকজন একে হত্যাকা- বলে অভিযোগ জানালেও পুলিশ বলছে, শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শহীদুল্লাহ হার্টের রোগী ছিলেন। সেইসঙ্গে তাঁর ডায়াবেটিস ছিল। মঙ্গলবার রাত আনুমানিক সাড়ে এগারোটার দিকে শহীদুল্লাহকে তাঁর চান্দগাঁও থানাধীন এক কিলোমিটার এলাকার বাসভবন থেকে সাদা পোশাকধারী দুজন লোক এসে একটি মামলার ওয়ারেন্ট জারির বিষয়ে অবহিত করে থানায় নিয়ে আসেন। এর কিছুক্ষণ পরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরিবারের অভিযোগ
শহীদুল্লাহর ভাতিজা (ভাইয়ের ছেলে) সৈয়দ সাকিব আহমেদ অভিযোগ করেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার সময়ে সিভিল ড্রেসে দুজন লোক এসে আমার চাচাকে চান্দগাঁও থানায় নিয়ে যান। পরে আমরা জানতে পরি ওনারা পুলিশ ছিলেন। তারা একটা মামলার ওয়ারেন্টের কথা বলে ছোট একটি কাগজ দেখিয়ে নিয়ে চাচাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যান। খবর পেয়ে রাত প্রায় ১২টার দিকে আমার বাবা-চাচারা থানায় গেলে থানার কলাপসিপল গেট তালা দেওয়া ছিল। তাদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। ওনারা চাচাকে মেডিসিন দেওয়ার কথা বলা হলেও পুলিশ দিতে দেয়নি। এর একটু পরে পুলিশ গেট খুলে দিয়ে ওনাদের সবাইকে ভেতরে যেতে দেয়। আমার বাবা গিয়ে দেখেন, আমার চাচা টেবিলে মাথা দিয়ে পড়ে আছেন। এরপর তাঁকে প্রথমে পার্কভিউ হাসপাতালে এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পার্কভিউ হাসপাতালেই তাঁকে ডেড (মৃত) ঘোষণা করা হয়।’

সৈয়দ সাকিব আরও অভিযোগ করেন, বুধবার সকাল বেলা চান্দগাঁও থানা থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এর বক্তব্য ছিল অনেকটা এরকম, পুলিশ ওনাকে ভদ্রভাবে থানায় নিয়ে আসে এবং পরে উনি হাসপাতালে মারা গেছেন। এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগপত্র যাতে দাখিল করা না হয়। পাশাপাশি বিনা ময়নাতদন্তে লাশ নিয়ে আসার কথাও বলা হয়। আমরা পরে ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার নিয়ে ময়নাতদন্ত করেছি।’

পুলিশের বক্তব্য ও অভিযোগের জবাব
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খায়রুল ইসলাম সুপ্রভাত বাংলাদেশকে বলেন, একটি সিআর মামলার আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল দুদকের সাবেক কর্মকর্তা এস এম শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে। বিষয়টি জানিয়ে আমাদের দুজন অফিসার ওনাকে থানায় নিয়ে আসেন। আমি ওই সময়ে থানায় ছিলাম না। পরবর্তীতে ওনার পরিচয় জানার পরে তাঁকে আমি আমার রুমে বসাতে বলি। কিছুক্ষণ পর ওনি অসুস্থবোধ করার বিষয়টি আমাকে জানালে আমি দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে বলি। এরমধ্যে থানার গেটের বাইরে অপেক্ষমাণ তার পরিবারের সদস্যদের জানানো হলে তারা অ্যাম্বুলেন্সের পরিবর্তে দ্রুত চিকিৎসার জন্যে সিএনজি অটোরিকশা আনার কথা বলেন। তখন সিএনজিতে করে তাঁকে পার্কভিউ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় আমাদের পুলিশ ভ্যানও সেখানে যায়। রাত ১২টা ২৮ মিনিটে ওনি মারা যান। রাত ১১টা ৪০ এর দিকে ওনাকে থানায় আনা হয়।

সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর পরিবারের অভিযোগের জবাবে ওসি মো. খায়রুল ইসলাম জানান, ওনার ছোট ভাই আমার রুমে এসে ওনাকে মেডিসিন দিয়েছেন। আমাদের ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি আছে।

অপর অভিযোগের জবাবে ওসি বলেন, ‘আমরা থানা থেকে কোনো ময়নাতদন্ত না করা, অভিযোগ না করার বিষয়ে কোনো চিঠি পাঠাইনি। বরং ওনাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আমরা মামলা করবেনা, কোনো পোস্টমর্টেম করবো না, কাটাছেঁড়া করবো না। তাছাড়া ময়নাতদন্তের বিষয়টি আমাদেরও এখতিয়ারে পড়ে না। ময়নাতদন্ত ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করে।’

রাতে আসামি ধরে আনার ব্যাপারে ওসি বলেন, ‘বেসিকেলি ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি পালিয়ে থাকে, কোর্টে হাজির হয় না। এখন পুলিশ রাতের সময়টাকে বেছে নেয় কারণ আসামি সে সময়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। তাছাড়া ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ধরে আনা পুলিশের দায়িত্ব, এ ব্যাপারে কোর্টে জবাবদিহি করতে হয়।’

মামলা এবং জায়গা জমির বিরোধ
শহীদুল্লাহর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শহীদুল্লাহর সঙ্গে জমিজমা নিয়ে তার এক ভাই এবং স্থানীয়ভাবেও একটি গ্রুপের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা ছিল। এ নিয়ে শহীদুল্লাহকে প্রায়ই বিব্রত থাকতে হতো।

এ ব্যাপারে শহীদুল্লার ভাতিজা সৈয়দ সাকিব আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে জায়গাজমি নিয়ে এক চাচার সঙ্গে বিরোধ ছিল। জমি নিয়ে একটা গ্রুপের সঙ্গে বিরোধ ছিল। মামলা ছিল। সাফার করেছেন।’

এ বিষয়ে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘ওনার এলাকায় জমি নিয়ে ঝামেলা ছিল। আমার এখানে একটি অভিযোগ দিয়েছেন। আমি মামলাও নিয়েছিলাম। উনি আমার থানার একটা মামলার বাদি। আমরা আসামি ধরেছিলাম, তাতে উনি খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন আপনি এতো রিস্ক নিয়ে আসামি ধরলেন।’ এদিকে মঙ্গলবার রাতের ঘটনায় ওয়ারেন্ট প্রসঙ্গে ওসি বলেন, ‘মামলার ওই বিবাদি পক্ষ কোর্টে মামলা করেছে, সেটিরই ওয়ারেন্ট এসেছে। আবার এ মামলার আমরা কিন্তু কোনো তদন্ত করিনি।’

৬৮ বছর বয়েসী সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ২০১৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তার দুই ছেলে। বড় ছেলে আসিফ শহীদ এবং ছোট ছেলে নাফিস শহীদ।

দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবাদ
বুধবার দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে সংগঠনের সভাপতি মো. মশিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি একটি প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়। এতে এ হত্যাকে মানবাধিকার লংঘন সংক্রান্ত গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানানো হয়।

সিএমপির তদন্ত কমিটি
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নগর পুলিশ। এতে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর জোনের উপ-কমিশনারকে প্রধান করা হয়েছে। বুধবার বিকেলে নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় তিন সদস্যের কমিটিকে তদন্ত করে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন- নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর) এবং বিশেষ শাখার সহকারী কমিশনার।