দশ বছর পর সুড়ঙ্গে আলো

বে টার্মিনালের নির্ধারিত স্থান। ছবিটি তুলেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শোয়েব ফারুকী।

স্বপ্নের বে-টার্মিনাল নির্মাণ

শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »

দেশের বাণিজ্য প্রসারণে কাজ করছে চট্টগ্রাম বন্দর। আর এ সমুদ্র বন্দরের একটি মেগাপ্রকল্প হলো বে-টার্মিনাল। পতেঙ্গা ও হালিশহর সমুদ্র উপকূলভাগের বিস্তীর্ণ ভূমিতে বে-টার্মিনাল নির্মাণ ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু প্রায় ১০ বছরেও প্রকল্পটি এগোয়নি। ভূমি জটিলতা, পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণ ও পরিবেশের ছাড়পত্র- এ তিনটি প্রধান কাজ বাকি থাকায় আলোর মুখ দেখেনি প্রকল্পটি। তবে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বর্তমানে জোর তৎপরতা শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে বে-টার্মিনাল নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের পর ২০১৪ সালের মে মাসে ভূমি বরাদ্দের জন্য আবেদন করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে প্রায় ১ হাজার ৬০০ একর ভূমি সমুদ্র থেকে পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় ভূমি আরো বাকি থাকে ৮৫৮ দশমিক ৬৩ একর। এরমধ্যে ৬৬ দশমিক ৮৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হলেও বাকী রয়ে যায় ৭৯১ দশমিক ৭৮ একর জায়গা। পাশাপাশি ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো সম্ভাব্যতা যাচাই প্ল্যান জমা দেয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শেলহর্ন ডব্লিউএসপি-একুয়া কেএস। কিন্তু ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নকশা ও নির্মাণ পরিকল্পনা জমা দেয় কুনওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটিং কোম্পানি লিমিটেড এবং ডাইয়াং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু ব্রেক-ওয়াটারসহ নির্মাণের জায়গা নিয়ে আপত্তি আসলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনাটি রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা চূড়ান্ত না হওয়ায় পরিবেশের ছাড়পত্র পায়নি প্রকল্পটি। তবে, পরিবেশের ছাড়পত্র নিয়ে চবকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভূমি নিশ্চিত ও পরিকল্পনা করা শেষ হলে পরিবেশের ছাড়পত্র পাওয়া নিয়ে আর কোনো জটিলতা থাকবে না।

ভূমি জটিলতা নিয়ে জানতে চাইলে চবকের ভূমি শাখার এস্টেট-১ এর সহকারী ব্যবস্থাপক মুহম্মাদ শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘বে-টার্মিনাল প্রকল্প শুরু না হওয়ার অন্যতম একটি কারণ ছিলো ভূমি জটিলতা। কিন্তু এ জটিলতা নিরসনে গত সপ্তাহে (আগস্টের শেষ সপ্তাহে) চেয়ারম্যান (চবক চেয়ারম্যান রিয়াল এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল) স্যারসহ আমাদের সঙ্গে ভূমিমন্ত্রী (সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি) মহোদয়ের একটি সভা হয়েছে। সভায় বেশ ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে। ভূমিমন্ত্রী মহোদয় ৫০০ দশমিক ৭১ একর ভূমি প্রতীকী মূল্যে দেওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন। বর্তমানে প্রতীকী মূল্যে ওই বরাদ্দ পেতে ভূমি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আশা করছি, আগামী সপ্তাহে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ফাইলটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাবে। আর পুরো বিষয়টিতে প্রধানমন্ত্রী মহোদয় আন্তরিকভাবে চট্টগ্রাম বন্দরকে সহযোগিতা করছেন। তাই আশা করি, ভূমি সমস্যা নিয়ে বে-টার্মিনালের কাজে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না।’

বাকি জায়গার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন ৬৬ দশমিক ৮৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ২৬৭ একর জমি সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে বনবিভাগের মালিকানায় থাকলেও সেখানে কোনো বন নেই। এ নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তারাও বে-টার্মিনালের জন্য জায়গাটি ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আর কিছু জায়গা মামলাধীন রয়েছে। সে জায়গাও ২০১৭ সালের সংশোধিত আইন অনুযায়ী ভূমির দামের তিনগুণ অর্থপ্রদান করে অধিগ্রহণ করা হবে। সেক্ষেত্রে রাণী রাসমণিঘাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারর জায়গা চট্টগ্রাম বন্দরের হবে। ৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী কার্যলয়ের নির্বাহী সেল ও পিইপিজেডের মহাপরিচালক শাহিদা সুলতানা স্যার চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক অবস্থাসহ বে-টার্মিনাল এলাকা পরিদর্শন করবেন।’

পরিকল্পনার ত্রুটি ও তা রিভিউ নিয়ে জানতে সুপ্রভাতের সঙ্গে কথা হয় বে-টার্মিনালের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী রাফিউল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মাঝে একটি নকশা হয়েছিলো। কিন্তু সেটি নিয়ে কিছু জটিলতা হলেও এখন আর তা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এ পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্ব কুনওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটিং কোম্পানি লিমিটেড এবং ডাইয়াং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে দেওয়া হয়েছে। তারাই আবার ২০১৭ সালের ফিজিবলিটি স্টাডি অনুযায়ী তাদের প্ল্যান জমা দিবে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তহে তারা প্ল্যান ও ব্রেক ওয়াটারের পজিশন কোথায় হবে তা জানাবে। আশা করছি অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।’

প্ল্যানটি কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্ল্যান বলতে ওখানে ৬ দশমিক ১৫ একর জায়গার মধ্যে রাসমণিঘাট অংশ থেকে ৩ দশমিক ৫০০ কিলোমিটার জায়গায় বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। বাকি ৩ কিলোমিটার পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষ বিস্তৃত করবে। বর্তমানের প্রকল্পে দুইটি কনটেইনার টার্মিনাল ও একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল হবে। মাল্টিপারপাস কনটেইনার টার্মিনালটি বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজে অপারেট করবে। ওখানে বেশ কয়েকটি চ্যানেল তৈরি করা হবে। আর এখন ওখানে যে মাটি ভরাট হয়েছে, তা মোটেই টার্মিনাল নির্মাণের জন্য নয়। এ কাজটিকে পুরো কাজের ১-২ পারসেন্ট (শতাংশ) বলা হয়। টার্মিনাল নির্মাণের আগে ওখানে আরও অনেক ড্রেজিংয়ের কাজ করা হবে। ওখানের ড্রাফট হবে ১২ মিটার। ফলে যেকোনো দৈর্ঘ্যের জাহাজ সেখানে ভিড়তে পারবে। এছাড়া বে-টার্মিনালে একইসঙ্গে ভিড়তে পারবে ৩৫ থেকে ৫০টি জাহাজ।’

বে-টার্মিনাল নির্মাণ কাজের পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথের কাজ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওখানে বে-টার্মিনাল হলে, ট্রান্সপোর্ট ফ্যাসিলিটি তো বাড়াতে হবেই। এই টার্মিনালের ট্রানজেকশন স্ট্রাকচার রিপোর্ট জমা দিবে ভারতীয় আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে তারা বিস্তারিত পরিকল্পনা দিবে। এছাড়া রেললাইন নিয়ে অবশ্যই একটি পরিকল্পনা থাকার কথা। তবে রেল কীভাবে যাবে এবং  বে-টার্মিনালের পণ্য আনায়ন করবে তা নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ কাজ করবে।’

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে বে-টার্মিনালটি নির্মিত হচ্ছে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে জিটুজি (সরকারের সঙ্গে সরকারের) পদ্ধতিতে। সে অনুযায়ী আগ্রহী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বরে প্রস্তাব জমা দেওয়ার শেষ দিনে ২১টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব জমা দিলেও সেখান থেকে ৭টি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করা হয়। এই ৭ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি (পিএসএ), সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড, সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে, ভারতের আদানি গ্রুপ, ডেনমার্কেও এপিএম টার্মিনালস, চীনের চায়না মার্চেন্টস গ্রুপ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই গ্রুপ। সেখান থেকে পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি (পিএসএ) কনটেইনার টার্মিনাল-২ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড কনটেইনার টার্মিনাল-১ অপারেটর হিসেবে মনোনীত হয়।