থমকে গেছে ‘ক্রসফায়ার’

মোহাম্মদ রফিক :
টেকনাফে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকা-ের পর সারাদেশে থমকে গেছে ‘ক্রসফায়ার’। এর আগে জুলাই মাসে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৪৬ জন। মেজর সিনহা হত্যাকা-ের একদিন পর ২ আগস্ট সিলেটের জকিগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন আবদুল মান্নান মুন্না নামে এক যুবক। এ ঘটনার পর গতকাল বৃহস্পতিবার ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ মাস দুইদিনের ব্যবধানে দেশের কোথাও ‘ক্রসফায়ার’ এর ঘটনা ঘটেনি।
জানা গেছে, ২০০৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে সারাদেশে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিন হাজার ৮৮০ জন কথিত ক্রসফায়ারে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন। সেই হিসাবে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পরই কার্যত সাময়িকভাবে থেমে গেছে ক্রসফায়ার। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মেজর সিনহার মৃত্যুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এ কারণে আপাতত ‘ক্রসফায়ার’ বন্ধ রাখা হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন সিনহার হত্যাকা-ের ইস্যু থিতিয়ে এলে ফের শুরু হবে ‘ক্রসফায়ার’।
এ প্রসঙ্গে র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল সুপ্রভাতকে বলেন ‘আসলে গোলাগুলির ঘটনা তো নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। মেজর সিনহা হত্যাকা-ের পর একটা স্থবিরতা বিরাজ করছে এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করছেন। আপনি (প্রতিবেদক) দেখেন যে, সারাদেশে শুধু গোলাগুলিতে নিহতের ঘটনা যে কমে গেছে তা নয়, পাশাপাশি মামলা দায়েরের সংখ্যাও কমে গেছে। একটা ঘটনা নিয়ে যথন আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়, এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরও বেশি সতর্ক থাকে।’
একাধিক মানবাধিকার সংগঠন ‘ক্রসফায়ার’ বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা ক্রসফায়ারকে বিচারবহির্ভূত হত্যা হিসেবেই দেখছে, বিষয়টি কিভাবে দেখেন প্রশ্ন করলে র‌্যাব-৭ অধিনায়ক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল বলেন, ‘মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিষয়টাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করে, আমরা যারা অভিযান পরিচালনা করি বিষয়টাকে সেভাবে ব্যাখ্যা করি না। আমরা যখন অভিযানে যাই, যখন সন্ত্রাসীরা আমাদের দিকে গুলি ছুঁড়ে তখনই আত্মরক্ষার্থে আমরা গুলি চালাই।’
এদিকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদকে গুলি করে হত্যার ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে এখনো সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, গত ১৬ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯ দিনে ওসি প্রদীপসহ ৫ জন পরিদর্শক এবং একাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধেই দায়ের হয়েছে ৮টি মামলা।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর টেকনাফ থানায় যোগ দেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তার যোগদানের পর কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক পরিণত হয় ‘ক্রসফায়ার জোন’ হিসেবে। শুধু টেকনাফেই ওসি প্রদীপের (২২ মাসে) তার হাতে ১৪৪টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় মারা গেছেন ২০৪ জন। তাদের অর্ধেকের বেশি লাশ পড়েছিল মেরিন ড্রাইভ সড়কে।
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ক্রসফায়ার কমে গেছে বলার সুযোগ নেই। একটা ঘটনার পর দৃশ্যত থমকে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেওয়ায় কৌশল হিসেবে ক্রসফায়ার হয়তো বন্ধ রাখা হয়েছে। এটি সাময়িক। যতদিন এটি বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রের দৃশ্যমান পদক্ষেপ না দেখব, ততদিন ক্রসফায়ার বন্ধ হবে না। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একক বিষয় নয়। রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তারা এটি কীভাবে দেখেন, সেটিই মুখ্য। সরকারের প্রচ্ছন্ন নির্দেশনা ছাড়া এটি বন্ধ হবে না।’
প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনার পর অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের দাবি জানান।
জানা গেছে, ১৮ বছর আগে সেনা পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ এবং ২০০৪ সালে র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশে চার হাজারের বেশি মানুষ কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন (মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর তথ্য অনুযায়ী)। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের মনে যে ঘৃণা জন্মেছে মেজর সিনহা হত্যাকা-ের প্রতিবাদের মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে।
এদিকে সিনহা হত্যাকা- তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সিভিল প্রশাসনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ক্রসফায়ারে অতি উৎসাহী ছিলেন। তবে এসব অপকর্মের সাথে কেবল প্রদীপ একা জড়িত নয়। এর নেপথ্যে আরো অনেকেই আছেন। কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পুলিশ বাহিনীর কিছু ‘বিপথগামী’ সদস্যদের ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু দোষটা গিয়ে পড়ে পুরো পুলিশ বাহিনীর উপর। কাজেই পুলিশ বাহিনীর উপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকার এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা ।