জেঠার সিন্দুক

নূরনাহার নিপা :

তন্ময় আজকাল লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগী। কারণ জেঠা মশাইকে কথা দিয়েছে জিপিএ-ফাইভ তাকে পেতেই হবে।

এমনিতে সে ভালো ছাত্র। আর একটু মন দিয়ে রুটিনমাফিক  লেখাপড়া করলে এর সুফল সেই পাবেই।

এদিকে পরীক্ষাও সামনে। যে-ক’টা দিন সময় আছে, শুধু পড়াশোনা করবে। তাই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট না করতে বলে। তন্ময় পড়ালেখায় ব্যস্ত দেখে জেঠামশাই খুব খুশি হলেন।

রহমান জেঠা পাকিস্তান আমলের মেট্রিক পাস। জেঠা খুব কষ্ট করে দুধ বিক্রি করে পড়ালেখা করেছেন।। তখনকার কালে মেট্রিক পাস মানে বিরাট ব্যাপার।

এলাকাবাসী তখন খুশি মনে কেউ গাছের ফল কিংবা পুকুরের মাছ নিয়ে জেঠাকে দেখতে এসেছিল। জেঠা তো এসব দেখে চোখেমুখে দারুণ খুশি। অথচ সেই জেঠার ছেলেমেয়েরা পড়াশুনার কথা শুনলে ভয় পায়। জেঠার অনেক দিনের পুরানো একটা সিন্দুক আছে, সবার নজর ওটার ওপর।

সবাই চিন্তা করে নিশ্চয় ওটাতে বহু সোনাদানা, টাকা-পয়সা আছে। কারণ জেঠা সিন্দুকটির চাবি কাউকে দেন না।

তন্ময় আচমকা ঘুম ভাঙার পর দেয়ালঘড়িতে তাকায়। এতো  বেলা হয়ে গেল! ঘড়িটা হয়তো ঠিকঠাকই চলছে। পেটে কিছু দানাপানি দেওয়া দরকার। তারপর পড়াশোনা করবে। মিষ্টি  ভোরের শান্ত বাতাস। এদিক-সেদিক ছোটে পাখিরা। ডানা মেলে উড়ে এ-ডাল থেকে ও-ডালে। পাখিরা কতো সুখী। আহা যদি ভোরের সুখের মতো সবার জীবন হতো!

তন্ময় জেঠার ঘরে ঢুকতেই জেঠা বলেন,  কী মতলব?

তোমাকে দেখতে মন চাইল।

সবার নজর তো আমার সিন্দুকে। তাই অনেকে ভাব দেখায় কত ভালোবাসে আমাকে।

জেঠা মশাই আমি তোমাকে রেসপেক্ট করি, ভালোবাসি। তুমি আমার অহংকার।

কেন যে তোমার ছেলেমেয়েরা তোমার মতো গুণী মানুষের কদর করে না।

জানিস তন্ময় কবিগুরু বলেছেন, দেহের সব থেকে দামি অংশ হলো হৃদয়। সেখানে থাকার যোগ্যতা সবার থাকে না।

জেঠার দু’চোখ ছলছল করে ওঠে।

সেরকম ব্যাকুলতা আমারও আছে। স্ট্রোক হবার পর সংসারের সবাইকে চিনতে পারলাম। সংসার একধরনের যৌথ প্রযোজনা। নিয়মকানুন মেনেই সবাইকে এগোতে হয়।

ছোট ছোট স্বপ্নগুলো সুখ হয়ে হাসুক। নিজেকে চেনার জন্য প্রত্যেক মানুষের একান্ত কিছু কষ্ট থাকা ভালো।

ঝিম মেরে পড়ে থেকেও ঘুম আসে না। সবকিছু স্নান হয় পুরাতন হয়। যেন মায়ার শহর পলকেই ছুঁয়ে দেয়। নীরবে দীর্ঘশ্বাস আড়াল করেন। এই জগতে কেউ কারো না। জেঠা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। মনের খুব অস্বস্তি বোধ হয়। বয়স হলে যা হয়। ক্লান্তিতে শরীরটা  নুয়ে আসতে থাকে। একজন তো জুয়া খেলতে গিয়ে প্রতিরাতে মাতাল হয়ে আসে। এসব অচেনা মুখ দেখার জন্য  বেঁচে থাকতে হবে আরও কিছুদিন।

বারান্দা থেকে ঘরের দিকে যেতেই তাদের সব কথা শুনতে পাই। রহমান জেঠার ছোটভাই রহিম শাহ ঘরে ঢুকে বলে, ভাইজান আপনার কী শরীরটা খারাপ? এই শহরের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারটি আপনাকে দেখাবো।

না ভাই, বয়স হয়েছে। এখন আগের মতো তো আর ভালো থাকতে পারি না। তুমি তো সারাজীবন সংসারের জন্য কষ্ট করলে। নিজেই তো পড়োনি আমাকে পড়াতে সাহায্য করলে।  তোমার অবদান।

ছি ভাইজান, এমন করে বলবেন না।

রহমান আমি জানি তুমি আমাকে খুব শ্রদ্ধা করো। ভাইজান আপনি শুধু তন্ময়কে দোয়া করেন।

আমি জানি ভাই তোমার ছেলে তন্ময় মেধাবী স্টুডেন্ট।  সে প্রতিটি ক্লাসে প্রথম মার্ক পাবে। অনেক দোয়া। সে মানুষের মতো মানুষ হোক।

তন্ময় বলে, জেঠা তোমাকে এলাকার মানুষ কতো মান্য করে।  তোমাকে ছাড়া এখানকার রাস্তাঘাট, পাড়া-মহল্লাগুলো খালি-খালি লাগে।

তুমি সুস্থ হলে আবার বগার বিলের পুকুরের মাছের সাঁতার  দেখবো। জানিস বেঁচে থাকার ইচ্ছাগুলো মরার আগে মরে যায়।

স্বপ্নগুলো বারবার নালিশ দেয়।

কিছুটা অভিমান আঁচড়ে পড়ে বেদনার দেয়ালে। কখনো মগজের ভিতর ভাবনাগুলো চক্কর কাটে।

চারিদিকে মনে হয় সাপের বিচরণ। জানিস একলোক সাপকে বড্ড ভালোবেসে কাছে রাখে। খাবারও দিতো সময় মতো। সাপটা  লোকটার সাথে এক বিছানায় থাকতো। তাদের মধ্য বেশ বন্ধুত্ব।

সাপটা তাঁর গায়ের ওপর ওঠে ঘুমাতো। এভাবে সে বেশ লম্বা-চওড়া হলো। সাপটা প্রতিদিন তার শরীরের ওপর শুয়ে কত ইঞ্চি লম্বা হচ্ছে দেখতো। কিন্তু লোকটা তা কখনো বুঝতে পারিনি।  বেশ কিছুদিন সাপটা কিছু খাচ্ছে না। তাই লোকটা চিন্তিত। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডা. বলে সাপ সুস্থ আছে। কোনো  রোগ নেই। তবে সে কখন কি করে সব জানতে চাইল। লোকটা সব খুলে বলে, সাপ তার বিছানায় ঘুমায়।

ডাক্তার বলে সাপটা না খেয়ে পেটে জায়গা করে আপনাকে খাবে বলে। লোকটা তো তা শুনে অবাক। কেঁদে ফেলে। এতোদিন যাকে নিজের বাচ্চার মতো ভালোবাসলাম, সে আমাকে ছোবল দিতে চায়।

আমাকে গ্রাস করবে? ভয়ে বুকটা কুঁকড়ে যায়।

কিছু বুঝতে পারছো?

তন্ময় জি জেঠামশাই।

হঠাৎ করে পান চিবুতে-চিবুতে পানের রস পাঞ্জাবিতে ছিটকে পড়ে।

তন্ময় বলে, রজঠামশাই একি করলে তোমার পাঞ্জাবিতে দাগ পড়ে  গেছে।

কিযে বলিস জীবনের রঙে যে দাগ পড়েছে তার আবার পাঞ্জাবির দাগ। একদিন দেখিস, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। হঠাৎ করে  বগার বিল থেকে গ্যন্ধা এসে জেঠার পা ধরে কান্না করে,  জেঠামশাই, আমার ছেলেটার খুব অসুখ। ডাক্তার বলল, অনেক টাকা লাগবে চিকিৎসা করাতে। এতো টাকা কোথায় পাবো।

আমার ছেলেটার যদি কিছু হয়ে যায়। ছেলেটার এখন খুব খারাপ অবস্থা।

কী বলিস গ্যান্ধ্য তার কি এমন রোগ।

জেঠা ছেলেটাকে দেখতে গেল।

কী হয়েছে দাদুভাই তোমার।

দাদু তোমাকে দেখার পর আমার অসুখ ভালো হয়ে গেছে।

জেঠা সিন্দুক থেকে ছোট একটা মোহর দিল তাঁর মা-বাবার হাতে। সবাই বড় বড় চোখ করে দেখে।

তন্ময় বলল,  জেঠামশাই এতোদিন তোমাকে সবাই হাড়কিপটে মনে করতো। আসলে তুমি অনেক বড়মনের মানুষ।