চট্টগ্রামের ঐতিহ্য মোহনীয় মধুভাত

হুমাইরা তাজরিন »

‘আমার বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। আশ্বিনের শেষে কার্তিকের শুরুতে প্রতিবছর চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই খাবারটি আমার মা প্রস্তুত করেন। তৈরি হয়ে গেলে সকাল সকাল কলসিতে বা পাতিলে করে আমার বোনের বাড়িতে এটি পাঠানো হয়। এটাই চট্টগ্রামে রেওয়াজ। আমার বোনের ছেলে-মেয়েরা এটি খেতে খুব ভালোবাসে। শীত আসি আসি করলেই তারা এটি খাওয়ার জন্য বায়না করে। বড়োরাও এটি খেতে পছন্দ করেন।’- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবার মধুভাত প্রসঙ্গে এভাবেই বললেন ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা মাহমুদুর রহমান।

শীতকাল এলে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর বেশ তোড়জোড় পড়ে যায়। ঐতিহ্যবাহী সব পিঠাপুলিও শীতকালে প্রস্তুত হয়। বাংলার একেক অঞ্চল একেক খাবারের জন্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মধুভাতের যেন জুড়ি নেই। মধুময় স্বাদের কারণে এই খাবারটি চট্টগ্রামে ইতোমধ্যে অর্জন করেছে বিশেষ মর্যাদা। চট্টগ্রামে মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে আশ্বিন-কার্তিক মাসে কলসি ভর্তি করে এই অনন্য খাবারটি পাঠানোর রেওয়াজ রয়েছে।

ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা মাহমুদুর রহমান আরো জানান, চট্টগ্রামের মানুষের খুব প্রিয় একটি খাবার মধুভাত। বাড়িতে যখন ডেকচি ভর্তি করে মধুভাতের রান্না বসানো হয় তখন সবার মধ্যে খাওয়ার আগ্রহ বাড়ে। দুধ-ভাত খাওয়ার কথায় যেসব ছেলেপুলেদের তালবাহানা শুরু হয়ে যায় তখন তারাও ছুটে আসে দুধ চালের তৈরি এই অতি সুস্বাদু খাবার খেতে। তরল জাতীয় খাবার হওয়ায় ছেলে বুড়ো সকলেই এটি খেতে পারে। দুধ, চাল, নারিকেল, মধু ও বীজের মতো পুষ্টিকর উপাদান থাকায় এ খাবার বেশ স্বাস্থ্যকরও। বিশেষ করে শীতকালে এই খাবারটি প্রস্তুত করা হয়। কেবল চট্টগ্রামবাসী নয়, যারাই একবার এই মধুভাতের স্বাদ গ্রহণ করেছেন তারাই হয়েছেন মোহিত। তবে বর্তমানে মধুভাতের দেখা মেলে কদাচ। এর উপকরণ ও প্রস্তুত প্রণালি সাধারণ খাবারের মতো নয়। তাই গ্রামাঞ্চলে অল্প বিস্তর রান্না হলেও দিন দিন ব্যস্ততা বাড়ায় নগরবাসীর মধ্যে এই সুস্বাদু ঐতিহ্যবাহী খাবারটি প্রস্তুত করার প্রবণতা নেই বললেই চলে। অথচ এই একটি খাবার স্বাদে মানে প্রকরণে অনন্য।

এই খাবারটি প্রস্তুত করতে প্রথমে ৪ টেবিল চামচ চিনির সাথে ২ কাপ পরিমাণ দুধ মিশিয়ে ‘বলক’ আসা পর্যন্ত চুলোয় গরম করে নিতে হয়। এবার ১ কেজি পরিমাণ বিন্নি চালকে ভালোভাবে ধুয়ে হাতের তিন দাগ পরিমাণ পানি দিয়ে মধ্যম আঁচে চুলোয় বসাতে হয়। এবার পরিমাণ মতো লবণের সাথে ১ কাপ পরিমাণ কোড়ানো নারিকেল তাতে ঢেলে ‘বলক’ আসলে নেড়ে দিতে হয়। ভাত হয়ে গেলে নামিয়ে নিতে হয়।

ধান চারা করার জন্য চালকে যে বীজ করা হয় , সেই চালকে জালা চাল বলা হয়। এই চালের ব্যবহার খাবারটিকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। এই চালকে আগেই থেকেই গুঁড়া করে প্রস্তুত করে রাখতে হয়। পাশাপাশি চালের সাথে মিশিয়ে তরল তৈরি করার জন্য বাটিতে গরম দুধ রাখা হয়। একটি ডেকচি ধুয়ে চুলোর আঁচে রেখে পানি শুকিয়ে তাতে ৩ থেকে ৪ কাপ পরিমাণ পূর্বে রান্না করা বিন্নি চাল দিয়ে দিতে হয়। তার উপর ছিটিয়ে দিতে হয় জালা চালের গুঁড়া। এবার রান্না করা বিন্নি চাল ও জালা চালকে ডাল ঘুটনি দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী দুধ মিশিয়ে তাকে ইচ্ছে মতো ঘন বা পাতলা করা যায়। তবে দুধ বা পানি যা-ই ব্যবহার করা হোক তা অবশ্যই গরম হতে হবে।

এবার মিশ্রণের সাথে প্রয়োজন অনুযায়ী মেশানো হয় মধুভাতের জাদুকরী উপকরণ মধু। মধু ঢেলে অবশ্যই দুধ, বিন্নি চাল ও জালা চাল ঘুটে নিতে হয়। ভালোভাবে মেশানো হয়ে গেলে ঢাকনা দিয়ে গরম কোনো স্থানে ১০-১২ ঘণ্টার মতো রেখে দিতে হয়। তবে এই সময়টিতে মিশ্রণটিকে কোনো ভাবেই হাতে স্পর্শ করা হয়না। প্রক্রিয়াটি অনেকটা দই জমানোর মতোই। এরপর নামিয়ে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ফ্রিজে রেখে উপরে কোড়ানো এবং কুচি করা নারিকেল ছিটিয়ে খাবারটি পরিবেশন করা হয়। প্রস্তুতের ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার মধ্যে খাবারটি খেতে হয়। এর বেশি সময় গড়ালে এটি টক হতে শুরু করে। অর্থাৎ খাবারটিতে এক প্রকার বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রামে মিশ্রণটি ডেকচিতে বসানো হয় রাতে, পরদিন সকালে প্রস্তুত হলেই তা খাবারের উপযোগী হয়।

খাবারটির আরো একটি বিশেষত্ব হলো শর্করা জাতীয় খাবারটি দীর্ঘক্ষণ ঢেকে রাখার কারণে গাঁজন প্রক্রিয়ায় এর মধ্যে অল্প পরিমাণ অ্যালকোহল উৎপাদিত হয়। খাবারটি খেলে এই উৎপাদিত অ্যালকোহল শরীরে প্রবেশের ফলে হালকা ঝিমুনি আসার সম্ভাবনা থাকে।