এবারের নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ

ড. আনোয়ারা আলম »

আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে সারাদেশে মোট ১২৮ জন নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এ সংখ্যা ৩০০ আসনের মোট ২ হাজার ৭১৩ জন প্রার্থীর মাত্র ৪.৭১ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৯টি আসনে লড়বেন নারীরা। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ সালের তৃতীয় সংশোধনী অনুসারে, রাজনৈতিক দলগুলোকে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটির পদে অন্তত ৩৩ শতাংশ নারী রাখতে হবে। তবে বাস্তবে কোন বড়ো রাজনৈতিক দল এই বাধ্যবাধকতা পালন করতে পারেনি।
নারীর প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, অর্থ ও পেশীশক্তির প্রাধান্য, ধর্মান্ধতা, ঐক্যের অভাব এবং রাজনীতি সম্পর্কে পরিবারের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে ৩৩ শতাংশ নারীর উপস্থিতি কোন দলেই নিশ্চিত হয়নি।যদিও শীর্ষ নারীর নেতৃত্বেই চলছে দেশ, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২৩ সাল অব্ধি।
একজন মহিলা এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান নারীদের ক্ষমতায় নিয়ে আসতে, কিন্তু তাঁর পাশে সব পুরুষ। রাজনীতি তো এই পুরুষতন্ত্রের কবল থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি।’
নারীর সরাসরি নির্বাচনে আসতে বড়ো বাঁধা- পুরুষ, পেশিশক্তি ও অর্থ। এছাড়া নারীর কাজগুলো প্রতিফলিত হয়না। এলাকায় নারীর কাজ বেশি হলেও পুরুষের নাম ফলাও করে প্রচারে হয়। নারীর রাজনৈতিক অবস্থান ভালো হলেও মাঠ পর্যায় থেকে উচ্চপর্যায়ে সেই তথ্য উঠে আসে না। আবার নারীর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে প্রচারের ক্ষেত্রে পুরুষেরাই প্রাধান্য পান। তাই সংসদের মাননীয় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন ‘নারী শুধু নির্বাচিত হয়ে এলেই হবে না তিনি যেন ভূমিকা রাখতে পারেন সেই জন্য সহায়ক পরিবেশ দরকার। তবে সেই পরিবেশ কেউ তৈরি করে দেবেন না। নারীর নিজেকেই নিজের যোগ্যতায় করে নিতে হবে।’
ইতিহাস বলছে অবিভক্ত ভারতে ১৯২৬ সালে ভোটাধিকার অর্জনের পরপরই কলিকাতা করপোরেশনের নির্বাচনে প্রথম মহিলা কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়েছিলেন পশ্চিম বাংলার কুমুদিনী ঘোস ও জ্যোতির্ময় গাঙ্গুলী। ১৯৩৫ সালে ভারতবর্ষের নারীদের সর্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত হলে পুরুষ প্রার্থীর বিরুদ্ধে অংশ নিয়ে যশোর মিউনিসিপালিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন আমিনা বেগম। ১৯৪৬ সনে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিষদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হন কংগ্রেস কর্মী আশালতা সেন। ঐ বছর ইস্ট বেঙ্গল এসেম্বলির সদস্য নির্বাচনে জয়লাভ করেন আনোয়ারা খাতুন এম এ এল এল বি।
পাকিস্তান আমলেও ১৯৫৪ সনে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের বেগম নুরজাহান মোর্শেদ, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ ও বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন অগ্নিকন্যা আমেনা বেগম। এর ধারাবাহিকতায় আরও অনেক নারী সরাসরি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।
বাংলাদেশ আমলেও একজন প্রতি মন্ত্রী হিসেবে যেমন বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ আর তার সূত্র ধরে অনেক মহীয়সী নারী।
১৯৯১ সাল থেকে দেশের সর্বোচ্চ পদে আমরা পেলাম নারীকে। অর্থাৎ দেশ চলেছে নারীর নেতৃত্বে। এরপরে ও একটু শতকে এসে ও সংরক্ষিত আসনে নারীদের সংসদে পেলেও সরাসরি নির্বাচনে খুব কম।যদিও স্থানীয় পর্যায়ে নারী মেয়র থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখছি নারীকে।
তাহলে কেন প্রত্যক্ষ নির্বাচনে নারীর সংখ্যা কম! যেখানে আমরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখছি নারীকে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বের এক পরম বিষ্ময়!
দেশ এগিয়েছে সন্দেহ নেই কিন্তু বিশেষত রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা এখনো পিছিয়ে। রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বিবেচনায় আনতে হয় সংসদে কতোজন সরাসরি মনোনীত সদস্য আছেন, মন্ত্রী পরিষদে কতোজন নারী, কতো বছর নারী রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে এগিয়ে আছেন এই বিবেচনায় কোন সন্দেহ নেই নারীরা এগিয়ে আছেন। তবে ৩৩ শতাংশ নারীর অন্তর্ভুক্তি এবং সরাসরি নির্বাচনে নারীরা এখনো পিছিয়ে। এজন্য প্রয়োজন পরিবার সমাজ ও দেশ পরিচালনার সর্বক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্ধারক পরিচালক ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালনের অধিকার। নারী যখন কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়ে দলের নির্ধারক পরিচালক ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে পারবে তখনই নারীর যথার্থ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ ও সরকার পরিচালনায় নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের জন্য নারীর মতামত গ্রহণের মধ্যে দিয়ে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় জাতীয় সংসদ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব বাস্তবে না থাকলে নারীর প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়।
সংরক্ষিত নারী প্রতিনিধি জাতীয় সংসদে। তাঁরা মনোনীত হয়ে আসেন সংসদে। যে কারণে একটা সময়ে বলা হতো অলংকার। এক্ষেত্রে ও পরিবর্তন আনা দরকার এটিকে অর্থবহ করার জন্য। কারণ আপনি সংসদে যাবেন এ জন্য ভোট চাইতে হবে,সংশ্লিষ্ট এলাকায় যেতে হবে। সেই এলাকার লোকজনের সাথে, সুখ দুঃখ বা তাদের দাবি বা প্রত্যাশার কথা জানতে হবে।কিন্তু এসব না করে মনোনীত হয়ে সংসদে যাওয়া মানে এলাকার অনেক কিছু না জেনে যাওয়া। এটি মানুষ হিসেবে নারীর প্রতি একধরনের করুণা। এতে নিজস্ব সত্তা বা মতামত বলে কিছু থাকে না। জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের বাড়তি বোনাস ছাড়া আর কিছুই না। অবশ্যই এটি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অন্তরায়। তাই সংরক্ষিত আসন হতে হবে সরাসরি নির্বাচিত যেখানে রাজনৈতিক দলের সদস্য, সমাজকর্মী নারী আন্দোলন কর্মী সবাই মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন হয়েছিল মাত্র দুটি মেয়াদের জন্য যাতে পরবর্তীতে তারা নিজেরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে পরিবর্তন এখনো হয়নি। এখন এ বিষয়েও ভাবা দরকার। আশা করি ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবেন। পরিশেষে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন যথার্থ অর্থে বাস্তবায়িত হোক এই প্রত্যাশা।