ঈদ : দ্যোতনাময় আনন্দের নাম

হাফিজ রশিদ খান »

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ ॥

তোর সোনাদানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ

দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ ॥

 

আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে

যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ ॥

 

আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,

তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্বনিখিল ইসলামে মুরিদ।

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ ॥

 

যারা জীবনভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী

সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ।

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ ॥

 

ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,

তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ ॥

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

 

তোরে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইটপাথর যারা

সেই পাথর দিয়ে তোল রে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ॥

(কাজী নজরুল ইসলাম)

 

সংক্ষেপে ঈদ বা ঈদুল ফিতর একটি দ্যোতনাময় আনন্দের নাম। দীর্ঘ সিয়াম সাধনার শেষে এ জনপদের প্রত্যেক সামর্থ্যবান, এমনকি সামর্থ্যহীন নরনারী, শিশু-কিশোর এদিনকে কেন্দ্র করে উত্তাল খুশির ঢেউয়ে ভাসতে থাকে। এই খুশি প্রকাশের পেছনে রয়েছে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনার প্রেরণা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি মুসলমান দেশে, জনপদে ও নিভৃত পল্লিতে এর আবেদন ও আবহ প্রায় সমান্তরাল। এ যেন ধ্যানী মানুষের জাগরণ। আল্লাহর নৈকট্যলাভের ধ্যানে যাঁরা পুরো একটি মাস কঠোর কৃচ্ছৃতার ভেতর সময়গুলো অতিবাহিত করেছেন, এ যেন তাঁদের জন্যে ঐশী রহমতের ধারা। নতুনপ্রাপ্তি ও নতুন সম্পর্ক সৃষ্টির পথে পা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এ যেন এক দিব্যশক্তি।

ঈদের দিনের কোলাকুলি বিগত দিনের সকল মলিনতা, কুটিলতা ও দূরত্বকে অনেকটাই ধুয়ে-মুছে দেয়। মুরুব্বি ও বয়স্কদের সামনে নত হয়ে নবীন ও অপ্রাপ্তবয়স্করা যেন সসম্ভ্রমে গ্রহণ করে আগামী দিনের চলার পাথেয়। অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্নরা এ দিনের উদার মহিমাকে ধারণ করে দান করেন তাঁদের সঞ্চিত অর্থ ও সামর্থ্যরে কিয়দংশ। গরিব ও পথপ্রান্তের অসহায় প্রতিবেশীকে গভীর আন্তরিকতা দিয়ে এদিন বরণ করা হয়, অতীতের ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়।

ঈদ কোনো কাষ্ঠ আনুষ্ঠানিকতা নয়। বাইরের কোলাহল আর আনন্দময় উদ্ব্যস্ততার ভেতরেই ঈদে রয়েছে সাচ্চা মানবিকতার সাধনার ইঙ্গিত। মুমিনেরা এই দিনটিকে অতি পবিত্রভাবে হৃদয়ে ধারণ করেন। এবং এই পবিত্রতার অনুভূতি তাঁর সত্তাকে বিকশিত ও পবিত্র করে।

বাংলাদেশ একটি বহুভাষী ও বহু ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্মভূমি। প্রধান ও বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালি মুসলমানদের পাশে এখানে স্মরণাতীতকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছেন অন্য ধর্মাবলম্বীরাও। এরা পরস্পরের প্রতিবেশী। আর পাশের জনকে অভুক্ত রেখে বা অবহেলা করে, তার সুখ-দুঃখের ভাগিদার না-হয়ে ভালো মুসলমানের অন্তরে প্রশান্তি আসতে পারে নাÑ এ ইসলামেরই শিক্ষা। প্রতিবেশীর প্রতি নমনীয় ও সদাচরণের শিক্ষা ইসলামের আরও একটি বড় দিক। তাই প্রতিবেশীর আনন্দ-বেদনাকে সমভাগ করে নেবার কথা আল্লাহর হাবিব, প্রিয়নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) বারবার বলেছেন।

সংঘাতক্ষুব্ধ আজকের বিশ্বপরিসরে নবীজির ওই শিক্ষাকে হৃদয় ও মস্তিষ্কে ধারণ করে পথ চলতে হবে আমাদের। বাংলাদেশে আজ জঙ্গি-সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতন, শিশুহত্যা ইত্যাদি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ও দুর্ভোগের খুব বাড়াবাড়ি চলছে। দিন দিন যেন তা বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়ে চলেছে জীবনধারণের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসমূহের আকাশচুম্বী মূল্য। স্বল্পআয়ের মানুষ, মুটে-মজুর ও দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ এই যাঁতাকলে নিত্য পিষ্ট হচ্ছে। তাই এমন সুন্দর ও পবিত্র দিনটিতে তাদের মুখে ও পরনে ঠিক মতো জুটবে কিনা দুটো ভাত-কাপড়, সে ভাবনা ধার্মিক ও সচেতন মানুষকে নিশ্চয় বিমর্ষ ও বিচলিত করে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নিবেদিতপ্রাণ, ন্যায়পরায়ণ মানুষেরা এই বেদনাদায়ক পরিবেশে নিশ্চয় উদ্বিগ্ন ও ভাবিত থাকেন। অথচ ইসলামে মজুদদারি, মুনাফাখোরি, মানুষে-মানুষে বৈষম্য ও অসাম্য সৃষ্টিকে প্রবলভাবে নিরুৎসাহিত ও ঘৃণামূলক বিষয় হিশেবে বর্ণনা করা হয়েছে অত্যন্ত জোরালোভাবে। বিপরীতে উচ্চাসন দান  ও পুরষ্কৃত করা হয়েছে উদার মানবতবোধ ও সমসামাজিক আচরণকলাকে।

ইসলামের এই সৌন্দর্য ভারি মনোরম ভাষায় প্রকাশ করেছেন কবি নজরুল :

 

আজি ইসলামী ডঙ্কা গরজে ভরি জাহান

নাই ছোটবড় সকল মানুষ এক সমান

দু’জনার হবে বুলান্দ নসিব

লাখে লাখে হবে বদনসিব

এ নহে বিধান ইসলামের। …

 

ঈদ দেশের বৃহত্তর মুসলমান সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। সেই সঙ্গে এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা এখানে বিচিত্র ও বহুমুখী। এ উৎসব আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে ওতপ্রোতভাবে। ঈদ উৎসবের আদি আদলে এসেছে নানা পরিবর্তন। ধর্মীয় ঐতিহ্য অক্ষুণœ রেখে এর অন্তর্নিহিত বাণী ব্যাপক সর্বজনীনতা লাভ করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি, যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, নগরায়ণ, গ্রামীণ জীবনের মন্থরতা থেকে জেগে ওঠার কোলাহলে ঈদ উৎসব জাতীয় সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে বিপুলভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। কাব্য, সংগীত, চিত্রকলা, সাজসজ্জাকেন্দ্রিকসমন্বিত সাংস্কৃতিক আয়োজন, খাদ্যবৈচিত্র্যের মধ্যে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণের আমেজটি নির্মল আকার-আকৃতি লাভ করেছে এখন। এদেশের চিরায়ত সমাজ ও সংস্কৃতির রূপটি এখানে তাই ধরা পড়ে অজান্তে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র-দীন-একাকী। কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একাত্ম হইয়া বৃহৎ। সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’

প্রাত্যকিতার গ্লানি, কষ্ট ও বেদনা সত্ত্বেও উৎসবের দিনে মানুষ উদারতা, আনন্দময়তায় মানুষের সঙ্গে মিলিত এক অনির্ববচনীয় অনুভূতি অর্জন করে। তার চারপাশের পৃথিবী সুন্দর, মহৎ হয়ে উপস্থিত হয়। সে ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে, সংকীর্ণ থেকে উদারতায় অভিষিক্ত হয়। তার প্রাণশক্তিকে বিচিত্র সম্ভাবনার দিকে প্রসারিত করে। উৎসব শুধু ব্যক্তিকেই যে ভিন্নতর পর্যায়ে নিয়ে যায় তা নয়, বরং জাতিকেও নতুন-নতুন সৃজনশীলতায়, উদ্দামতায় সমৃদ্ধ করে তোলে। শত অক্ষমতা, পীড়ন আর গ্লানি থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়। ঈদোৎসব বিশেষ করে এই আবহটি ছড়িয়ে দেয় গ্রামীণ জনপদে, গরিবের কুটিরে কিংবা সম্পন্নের আঙিনায়।

বিগত শতকের প্রথম দিকে গ্রামীণ মুসলমান সমাজের মধ্যে ধীরে-ধীরে শিক্ষার্জন, জ্ঞানাকাক্সক্ষা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও উদার চিন্তার যে-বিকাশ ঘটতে শুরু করেছিল তার ছাপ এখন তাদের সকল ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিস্ফুট হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এটি বাঙালি মুসলমান সমাজের এক গুণগত উত্তরণ, যা তার স্বতন্ত্রতাকে চিহ্নিত করে। সেই সঙ্গে জাগরণের ধ্বনিটিও শোনা যেতে থাকে। বাঙালি মুসলমানের এই উদার অথচ ধর্মীয় অনুরণন-সমৃদ্ধ উৎসব ও মনোজগতসৃষ্টিতে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, সংগীতশিল্পী কে মল্লিক, শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ, কবি ফররুখ আহমদ, কবি জসীম উদ্দীন, নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, কবি সুফিয়া কামাল-এরসবিশেষ অবদান রয়েছে। তাঁদের অবদান কি শহর কি গ্রাম সকল পর্যায়ের বাঙালি মুসলমানকে সুপ্তি থেকে জাগিয়েছে। জীবনের সৌরভে আমোদিত হবার দীক্ষা দিয়েছেন তাঁরা।

পবিত্র রমজান মাসে চিত্তশুদ্ধি আর আত্মশুদ্ধির যে-অনল প্রত্যেক মুসলমান নরনারীর ভেতর প্রবাহিত হয়,পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে তার বিস্তার ঘটে ভ্রাতৃত্ববোধে, মমতায় আর মানবতার অঙ্গীকারে। এই সংস্কৃতিই এই জনপদের আসল আদল, প্রকৃত প্রেক্ষাপট।