ইদ্রিস মিয়ার সাথে মাদ্দোর দেখা

চিরহরিৎ »

ইদ্রিস সাহেব চট্টগ্রামে বেড়াতে এসেছেন প্রায় বছর দেড়েক পরে। নিউমার্কেটের মোড়ে দাঁড়িয়ে উত্তপ্ত আকাশটাতে চোখ রাখতেই তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। আঞ্চলিক ভাষায় গ্রীষ্মের গরমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মাইল্লেফিরের গরম। ‘মাইল্লেফিরের’ অর্থটা যে কি, তিনি নিজেও জানেন না। তবুও গালিটা ছুঁড়ে দিয়ে রাস্তার মানুষের ভিড়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তৃপ্তির হাসি হাসেন। আর মনে মনে ভাবেন, শালা, তোরা আসলেই কুত্তার বাচ্চা। দেশের গ-ি পেরিয়ে দুনিয়াটা দেখলি না। আর এই যে আমি ‘ইদ্রিস আহমেদ ইদ্রিস’, বাংলাদেশকে চালিয়ে খেয়ে, কানাডায় ডেরা বাঁধলাম। ইদ্রিস এবার মনের অজান্তেই তার সাদা টি-শার্টের গায়ে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে সেয়। তাতে ঘামে ভেজা গেঞ্জিটার ভিতর থেকে বিশাল ভুঁড়িটা জিন্সপ্যান্ট থেকে উপচে পড়ে যেন।

ওল্টোদিক থেকে হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ইদ্রিস, ফ্যাট ইবে এত্তোর কা অইয়ি তোঁয়ার? (পেটটা এত বড় হলো কেন তোমার?)

ইদ্রিস পূর্ব-পশ্চিম-উত্তরে কয়েকবার ঘাড় নাড়াতেই, ধপাস করে শুকনো একটি হাত তার ঘাড়ে আলতো ভাবে আঘাত করে। শুকনো, বাঁকানো লোকটার মরা চোখগুলো ইদ্রিসের মনে ভয় ধরিয়ে দেয় তাৎক্ষণিক ভাবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে আবিষ্কার করে, এটা হলো তার স্কুলজীবনের বন্ধু আবুল বশর যাকে সবাই ‘মাদ্দো’ বলেই সম্মোধন করতো।

মাদ্দো : কবে এসেছিস?

ইদ্রিস : এই তো গত পরশু। দুই বন্ধু ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে থেমে পড়ে সেই পুরনো হোটেলটি দেখে। গরম গরম পরোটা ভাজা হচ্ছে বিশালকায় কালো তাওয়ায়। ইদ্রিসের জিবে পানি চলে আসে। মাথার ভিতরে ফুটে ওঠে সদ্যভাজা ডিমপোসের ছবি। সে নুইয়ে পড়া মাদ্দোর মরা হাতটিকে টেনে নিয়ে হোটেলের ভিতর ঢুকে পড়ে। তারপর বলে, কী খাবি? মাদ্দো তখন গরুর কালাভুনার স্বপ্নে বিভোর। সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, কালাভুনা।

ইদ্রিস : এই বয়সে কালাভুনা খাওয়াটা কি উচিত হবে?

মাদ্দো : উচিত-টুচিত বুঝি না। যেটা খেতে ইচ্ছে করছে সেটাই খাবো। … আর কয়দিন বাঁচবো?

ইদ্রিস তার ছাত্রজীবনের নেতাগিরির কথা ভাবতে ভাবতে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ বেয়ারাটাকে উদ্দেশ্য করে গলা উঁচিয়ে বলে, দুইটা ডিমপোস, একটি কালাভুনা আর চার পরোটা। সদ্য ষাট পেরনো বেয়ারা আবুইল্লে মাথা নাড়িয়ে হাঁ-সূচক ঈশারা দিয়ে, ঠ্যাং দুটো চেগিয়ে-চেগিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে চলে।

এদিকে অর্ডারের খাওয়া আসতে দেরি হতে দেখে দুইবন্ধু টেবিলে রাখা শুকনো ধইন্যা চিবোতে থাকে আর প্রতিবারের মতই তাদের আড্ডার বিষয় ইসলাম, পশ্চিমাবিশ্ব, ইজরায়েল এই তিন স্তরেই ঘুরপাক খেতে শুরু করে।

ইদ্রিস : বুঝলি মাদ্দো, বাংলাদেশে এসেছি কেবল দুটি উদ্দেশ্যে। মা-বাবার কবর জেয়ারত করতে আর হালাল খাবারদাবার গিলতে। শালার কানাডা সরকার আমাদের যতই বেকারভাতা দিক, অমুক সুবিধা দিক। তারা আসলেই ইসলামের শত্রু। কোথায় যে কখন শুয়োর, বিভার গিলে ফেলছি, নিজেও জানি না।

মাদ্দো : মুখের ওপরের পাটিতে আটকে থাকা তরমুজের বিচি সদৃশ্য লালচে দাঁতগুলো বের করে বলে, আলহামদুলিল্লাহ্, তুই যে কানাডা গিয়ে খাঁটি মুসলমান বনে গেছিস, তাতে আমার শুকনো কলিজাটা আজ জমজমের পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। মারহাবা, মারহাবা। এটাই তো মুমিনের চিহ্ন।

ইদ্রিস : হাসতে হাসতে বলে, আমার একটাই স্বপ্নÑ কখন কানাডাতে মুসলমানদের সংখ্যা খ্রিস্টানদের ছাড়িয়ে যাবে!

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে যেতেই দুই বন্ধু ঝড়ো বাতাসের ভিতর আরেকটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। ইদ্রিস ভাই …। ইদ্রিস ওল্টোদিকে ফিরে দেখে, সেটা তার ছোটভাই জাহেদ।

জাহেদ  : চলুন দাদা, আজকের লাঞ্চটা আমার বাসায় একসাথে সেরে নিই। জাহেদ আগে আগে হাঁটতে-হাঁটতে বলে, ঐ যে দেখছেন হলদে টাওয়ারটা, ওটার চৌদ্দতলায় আমার বাসা।

তার কথা মতো দুই সত্তরোর্ধ্ব যুবক সুরসুর করে লিফটের সামনে জড়ো হল।