ত্রিভুজ প্রেম

চৌধুরী শাহজাহান »

শেলীর তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সবুজ, সাবিনা আর সানি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে একে অপরের সাথে হার্দিক সম্পর্ক আরো প্রগাঢ় হয়। একই কলেজের ছাত্র হলেও ইন্টারে  তেমন যোগাযোগ ছিল না। তারা মননে আধুনিক ও চেতনায় স্বাধীন। অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে। কোনো দলের সঙ্গে লেজুড়বৃত্তিতে জড়িত নয়। শেলী সাহিত্যের ছাত্রী। সংবেদনশীল মনের অধিকারী। সে সৌন্দর্য ও মননশীল নাট্যচর্চায় অনন্যা। শহরের একটি নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত। গান ও অভিনয় করতে সে

পছন্দ করে। তার বাবা একটি সরকারি কলেজের অধ্যাপক। উদারমনের মানুষ। শেলীদের বাসা মেহেদিবাগ। বাসার নিকটেই জেলা শিল্পকলা একাডেমি। ইচ্ছা করলে হেঁটেই  সে নাটকের রিহার্সেল ও শো করতে যেতে পারে। নাট্যজগতে তার অনেক বন্ধু তৈরি হয়। অনেক সময় রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়। তার মা খুব টেনশন করে। ছোটভাই রবীন শহরের একটি কলেজে পড়ে। সেও বাবার মতো উদারমনের অধিকারী। যেদিন শেলীর শো থাকে সেদিন বন্ধুরা তার অভিনয় দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে।  প্রেক্ষাগৃহ থাকে দর্শকে পরিপূর্ণ। প্রিয়া, জাফর, রাজীব, তনুজা, মামুন, সাথী, সবুজ, সানি, শাকী, মাওলা সবাই মিলে ‘ইডিপাস’ নাটকটি উপভোগ করে। শেলী গুরুত্বপূর্ণ একটি নারীচরিত্রে অভিনয় করে। তার অভিনয় দেখে হলভর্তি দর্শক হাততালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। নাটকের শেষে বন্ধুরা শুরু করে তার চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ। অনুভূতি জানিয়ে বন্ধুকে অভিনন্দিত করতে কেউ কসুর করে না। লোকপ্রশাসনের ছাত্র সবুজ হঠাৎ ছোটগল্প নিয়ে অনেক পড়াশুনা শুরু করে। বলা যায় মাথায় গল্পের ভূত ছেপেছে ওর। গল্পের কলকবজা নিয়ে সে দীর্ঘদিন মেতে থাকে। সে একদিন সানিকে বলে,

-দোস্ত, আমি সাহিত্যিক হতে চাই- কথাসাহিত্যিক। মানিক, ইলিয়াস ও হাসান আজিজুল হকের মতো বড়মানের সাহিত্যিক হতে চাই।

-কেন? তোমার তো প্রশাসক হওয়ার কথা; একদিন ডিসি এসপি সচিব হবে। বিসিএস করে সরকারের একজন বড় কর্মকর্তা হয়ে দেশসেবা করবে। কী বলো?

-না, বন্ধু। সাহিত্যচর্চা করেও দেশসেবা করা যায়। কেন, বঙ্কিমচন্দ্রের কথা তোমার মনে নাই। তিনি ব্রিটিশ সরকারের একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। বাংলাদেশেও অনেক কবি-লেখক সরকারের বড় আমলা হয়েছেন। যেমন ধরো, আসাদ মান্নান, কামাল চৌধুরী, মোশাররফ করিমসহ আরো অনেকে।

এক সময় সে ছোটগল্প লেখা শুরু করে। তার লেখা স্থানীয় পত্রিকাসহ জাতীয় পত্রিকার সাহিত্যপাতায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তরুণ গল্পকার হিসেবে সাহিত্যমহলে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। সে পাহাড়-অরণ্যে ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকে। তার ধারণা, গাছপালা. ফুল-পাখি, বন-বনানী মানুষের সাথে কখনো প্রতারণা করে না। প্রকৃতি মানবজীবনের এক অপরিহার্য অংশ। আত্মার আত্মীয়। প্রকৃতি ছাড়া মানুষ অসম্পূর্ণ। ‘অরণ্যের দিনলিপি’ নামে সে একটি গল্প রচনা করে বন্ধুমহলে গল্পকার হিসেবে  তোলপাড় ফেলে দেয়। শেলীর বন্ধুদের মধ্যে সানি কবিতা লেখে। তার কবিতার মূল বিষয় প্রেম। উদীয়মান তরুণ কবি।  শেলীকে নিয়ে সে বেশ কিছু কবিতা লিখেছে। শেলী কেন যে তার কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে সে বুঝতে পারে না। শেলী সুন্দরী, স্মার্ট, আধুনিক তরুণী। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকে। রহস্যময়ী সোনালিসা হাসি। এ হাসির হদিস সে আবিষ্কার করতে পারে না। মনে মনে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। আহ! শেলী যদি তার জীবনসঙ্গী হতো ? সে কী শেলীকে ভালোবাসে ? যদি ভালো না বাসে, তাহলে কেন সে একের পর এক কবিতা লিখে চলেছে তাকে নিয়ে। আচ্ছা, সবুজ কী  শেলীকে ভালোবাসে ? ভাবতে ভাবতে তার মাথা ঘুর্ণিপাকের মতো ঘুরপাক খেতে থাকে। হতেই তো পারে। সবুজের প্রতিটি নিশ্বাস-প্রশ্বাসে শেলী আর শেলী। সবুজের সাথে শেলীর একটি সহজ বোঝাপোড়া সবার নজার কাড়ে। অনার্স ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত তাদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক দেখা গেছে। সানি একটি কবিতার বই বের করে। বইয়ের শিরোনাম দেয় ‘প্রেম ও প্রকৃতি’। প্রেম, প্রকৃতি আর নারী তার কবিতার বিষয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার কবিতায় প্রেমের আকুতি-বিকুতি ছাড়া তেমন কিছু নেই। অনেকটা প্রেমের বিলাপও বলা যায়। সে কাউকে প্রপোজ করতে পারে না। কোথাও যেন একটা দেয়াল তার সামনে এসে দাঁড়ায়। সানি কয়েকজন বন্ধু মিলে শহরে ব্যাচেলর থাকে। সে কারণে সবুজের চেয়ে শেলীর সাথে সানির যোগাযোগ বেশি হয়। সান্ধ্য আড্ডাটা সে বেশ উপভোগ করে। সানি গ্রামের ছেলে। তার বাবা গ্রামের প্রাইমানি স্কুলের শিক্ষক। অনেক কষ্ট করে সে এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। সে কারো মনোবেদনার উপলক্ষ হতে চায় না। তাকে মানুষ হতে হবে। তাকে নিয়ে মা-বাবার অনেক স্বপ্ন। পুরো পরিবার তার দিকে চেয়ে আছে। এ রকম ভাবনায় সে যখন বিভোর ঠিক সে সময়ে জানতে পারে শেলী সিরিয়াস অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। বন্ধুদের সে দেখতে চায়। বিশেষ করে সবুজকে। ঘুমের মধ্যেও নাকি সবুজের নাম সে বারবার উচ্চারণ করেছে।

তাহলে শেলী কি সবুজকে ভালোবাসতো? তা কি করে সম্ভব? সহজ-সরল ছেলেটি তলে তলে-ডুবে-ডুবে  কখন যে জল খেয়েছে সানি বুঝতে পারে না। তার মনে পড়ছে শেলী মাঝে মাঝে ৫টার ট্রেনে শহরে আসতো। সানি জিজ্ঞাসা করলে বলতো, ‘লাইব্রেরি ওয়ার্ক ছিল।’ আসলে কি লাইব্রেরি ওয়ার্ক না অন্য কিছু? হয়তো দু’জনের সম্পর্ক এসময়ে আরো নিবিড় হয়েছে। কিন্তু একথা নিশ্চিত যে কেউ কাউকে প্রপ্রোজ করেনি। এসবের কোনো উত্তর এখন সে  খোঁজার চেষ্টা করে না। কারণ  শেলীর ক্যান্সার ধরা পড়েছে, অবস্টথা সঙ্কটাপন্ন। ডাক্তার বলেছে, সে দু’সপ্তাহের বেশি বাঁচবে না। এ-রকম অবস্থায় কোনো কিছু জানতে চাওয়াও অমানবিক। সবুজ খুব ভেঙে পড়েছে। সে মেনে নিতে পারছে না শেলীর অকালে চলে যাওয়া। সবাই মাস্টার্স পাস করলেও শেলীর আর পরীক্ষায় বসা হলো না। হায়রে মানবজীবন, কখন যে কার ডাক আসবে, কেউ বলতে পারে না। সবুজের জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গেল। শেলীকে তার অনেক কথা বলার ছিল। না বলা কথাগুলো বেদনা হয়ে তাকে কুরে-কুরে খায়। প্রিয়বন্ধু যে এভাবে অবেলায় অসময়ে বিদায় নিবে সে ভাবতেই পারে না। পেছনে ফেলা আসা দিনগুলো তার স্মৃতিপটে ফ্ল্যাশব্যাক হয়ে ফিরে আসে। সেই জারুলতলা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, মউর দোকান, কু ঝিক ঝিক শার্টল ট্রেন, ভার্সিটি লাইব্রেরি, শিল্পকলা একাডেমি, চারুকলার সামনের ঝুপড়ির আড্ডা আর জমবে না।

আহা! মানবজীবন এতো ছোট কেন?